জনবান্ধব পুলিশিংয়ের বাস্তবতা
বেঙ্গল বার্ষিক প্রতিবেদন ১৮৫৯-৬০ সূত্রে শ্রীরাম সুরেশ শর্মা উল্লেখ করেছেন, বাংলায় পুলিশ সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করত; একটি হচ্ছে সামরিক, অন্যটি বেসামরিক। সামরিক পুলিশ স্বাভাবিকভাবে দাঙ্গাসহ শান্তির পথে সহিংস কর্মকাণ্ডকে দমনে ব্যবহৃত হতো এবং বেসামরিক পুলিশ অপরাধ সনাক্তকরণ ও অপরাধীর বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে কাজ করত। বর্তমানে পুলিশ অনুরূপ কাজ করছে, বিশেষভাবে অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধে পুলিশের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
তা ছাড়া জনগণের জানমালের নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি শান্তি এবং সম্প্রীতির সুবাতাস ছড়িয়ে দিতেও পুলিশ বাহিনী বদ্ধপরিকর। তথাপি জনবান্ধব পুলিশের যে আকাঙ্খা, সেটির প্রতিপালনে অন্তরায় হিসেবে বহুবিধ উদ্দীপক কাজ করছে।
জনসাধারণের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রদানের লক্ষ্যে পুলিশের সদস্যরা পুলিশিং করে থাকে। পুলিশিং হচ্ছে পুলিশ কর্তৃক বৈধভাবে সম্পাদিত সব প্রকারের কার্যাদি, যার প্রতিপালনে জনগণ উপকৃত হয় এবং স্বাধীন ও স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপনের অধিকার ভোগ করে তথা সম্পত্তির সুরক্ষা প্রদানের নৈতিক ভিত সুসংহত হয়। পুলিশিংয়ের ভিন্ন ধরনের টেকটিকস ও টেকনিকের মাধ্যমে বিশ্বময় পুলিশ কর্মকর্তারা জনগণকে সেবা ও নিরাপত্তা প্রদানের চেষ্টা করে থাকে। উইলসনকে (১৯৬৮) এক গবেষণায় দেখান যে পুলিশ বিভাগ সাধারণত তিন ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, আইন প্রয়োগ করা (আইনি কাঠামো মেনে কঠোর পরিকল্পনায় পুলিশিং বাস্তবায়ন); অন্যটি হচ্ছে আদেশ-নিষেধ প্রতিপালন করা (সর্বসময় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা) এবং শেষেরটি হচ্ছে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা (জনসাধারণের চাহিদা মোতাবেক সেবা প্রদান)। এ তিন ধরনের পুলিশিংয়ের মধ্যে বাংলাদেশে জনগণের প্রত্যাশা ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় সেবা প্রদানের নজির সৃষ্টি করতে পারলেই খুব সহজে জনবান্ধব পুলিশিংয়ের চর্চা করা সম্ভব হবে। জনবান্ধব পুলিশিং এমন একটি পরিকল্পিত পদ্ধতি, যে ব্যবস্থায় জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা তথা সন্তুষ্টিকে গুরুত্ব প্রদান করা হয় এবং তৎসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কমিউনিটির প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, এ ব্যবস্থাপনায় বেসামরিক জনগণের সঙ্গে পুলিশের নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষিত হয় এবং অনেক অমীমাংসিত ইস্যু অভিযোগের বাইরে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে।
দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের নিরলস ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ও অনস্বীকার্য। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের ধর্মীয় উৎসব, পার্বণ ও জাতীয় উৎসবগুলোতে নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।
বাংলাদেশ পুলিশ আদৌ কি জনবান্ধব পুলিশের দায়িত্ব পালন করছে? এই প্রশ্নটি বিভিন্ন সময়ে ঘুরে ফিরে আমাদের সামনে এসে যায়। অবশ্য করোনার সময়ের দায়িত্বের কারণে বাংলাদেশ পুলিশ মানবিক পুলিশের তকমা পেয়েছে। মূল প্রত্যাশা হচ্ছে; মানবিক পুলিশের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে এবং জনগণের প্রত্যাশা ও চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ পুলিশ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পুলিশ-পাবলিকের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সময়ে সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ করছে। তদুপরি পুলিশকে নিয়ে নেতিবাচক সংবাদের নজিরও দেখা যায়। তথাপি কাঙ্ক্ষিত জনবান্ধব পুলিশের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ পুলিশকে নানাবিধ প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ পুলিশকে সাধারণত সার্ভিস অরিয়েন্টেডের তুলনায় সিকিউরিটির দিকে অতিমাত্রায় মনোযোগ প্রদান করতে হয়। বিশেষ করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, বিদেশি দূতাবাসসহ অন্যান্য সব প্রোগ্রাম ও আয়োজনে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। পাবলিক পরীক্ষা এবং চাকরির পরীক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশকে নিরাপত্তায় থাকতে হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। সাম্প্রদায়িক উসকানি ও দাঙ্গা প্রতিহত করতে পুলিশকে সার্বক্ষণিক তৎপরতা দেখাতে হয়। নির্বাচনকালিন সংঘাত ও নির্বাচন–পরবর্তী পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বও পুলিশ সদস্যদের পালন করতে হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দূর্যোগের শিকার হয়ে থাকে।
দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের নিরলস ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ও অনস্বীকার্য। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের ধর্মীয় উৎসব, পার্বণ ও জাতীয় উৎসবগুলোতে নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন কারণে তাদের কার্যকারিতা হারিয়েছে। একটা সময়ে অনেক অমীমাসিংত ইস্যু সামাজিক ব্যবস্থাপনায় নিষ্পত্তি হয়ে যেত। বর্তমানে সামান্য বিষয়ের প্রতিকারেও পুলিশের দ্বারস্থ হতে হয়। অথচ এ ধরনের সমস্যার সমাধান সমাজের সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনায় সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্লিপ্ততার কারণে সামাজিক সমস্যাসমূহের প্রতিকারেও পুলিশকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। অনলাইনে জিডি করার সুযোগে জিডির সংখ্যা বাড়ছে এবং সঙ্গত কারণেই অভিযোগ নিয়ে এবং মামলাগুলোর ব্যাপারে পুলিশকে তদন্তে মনোযোগী হতে হয়। পূর্বোক্ত ব্যস্ততা ও কার্যক্রম জনবান্ধব পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে থাকে।
সুপ্রাচীনকাল থেকে পুলিশের সঙ্গে জনগণের একটি অঘোষিত দূরত্ব রয়েছে। এ দূরত্ব ক্রমান্বয়ে কমে আসলেও দূরত্ব এখনো বিদ্যমান। সিটি কর্পোরেশন কিংবা বিভাগীয় শহর ব্যবস্থাপনার কারণে পুলিশের সঙ্গে পাবলিকের দূরত্ব কমে এলেও বাংলাদেশের অসংখ্য এলাকায় এখনো পুলিশের দ্বারস্থ হতে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভয়, শঙ্কা ও আতঙ্ক কাজ করে থাকে। কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা নানাবিধ কারণে কার্যকারিতা হারিয়েছে, এটি স্বীকার করতেই হবে। পুলিশ-পাবলিকের দূরত্ব কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কমিউনিটি পুলিশিং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। কমিউনিটি পুলিশিং এর যে ধারণা রবার্ট পিল প্রদান করেছেন, সে জায়গা ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় কমিউনিটি পুলিশ শুরুতে আলোর দিকে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমান বাস্তবতায় এটি কেবলই ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে।
দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি চাকুরিতে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয় পুলিশ সদস্যদের। এ ধরনের সমস্যা পুলিশ সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন পুলিশের সুনির্দিষ্ট কোন কর্মঘণ্টা নেই। তা ছাড়া পদোন্নতি, ট্রান্সফার, পদায়ন ইত্যাদিতে পুলিশ সদস্যদের বঞ্চিত হতে হয়। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যারা থাকে, তাদের জন্য মেডিকেল ফ্যাসিলিটিজ নেই বললেই চলে। বিশেষ করে মেট্রোপলিটন এলাকাতে যে সকল পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন; তারা বিভিন্ন রকমের রোগে ভোগেন; গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। পুলিশ সদস্যদের রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যবহার করা হয় এমন অভিযোগও রয়েছে। এ সকল কারণে পুলিশ সদস্যরা মানসিক দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবন অতিক্রম করে। জনবান্ধব পুলিশিং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এসব বিষয়গুলো প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।
ভারতে পুলিশ–পাবলিকের সম্পর্ককে মজবুতের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপে পুলিশকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়। যেমন: পুলিশে কেন দুর্নীতি হয়, পুলিশের নিকট এফআইআর কিংবা জিডি করতে কেন টাকা খরচ হয়, ভিকটিমদের পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে পুলিশের নিকট অভিযোগ প্রদান থেকে কেন বিরত থাকে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিতদের সন্তানদের বিরুদ্ধে যথাযথ অভিযোগ থাকা স্বত্ত্বেও ব্যবস্থা গ্রহণে কেন দেরি হয় ইত্যাদি প্রশ্ন করা হয়।এ ধরনের প্রশ্নের কারণে পুলিশ-পাবলিক দূরত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। এ দিকে, ব্রুকলিন পুলিশ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য জনগণের নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় আইন মেনে পুলিশিং চর্চা শুরু করে। কিন্তু এ অবস্থায় আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় ডেডলি ফোর্স (বল/শক্তি প্রয়োগ) প্রয়োগ করায় পুলিশের সঙ্গে জনগণের একটি দূরত্ব তৈরি হয় এবং এ দূরত্বের কারণে জনবান্ধব পুলিশের তকমা সহজে কোনো ইউনিটের সঙ্গে যায় না। অন্যদিকে শুরুতেই লন্ডন এবং নিউইয়র্ক পুলিশ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বলপ্রয়োগ করায় পুলিশ-পাবলিকের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকেনি। কাজেই জনবান্ধব পুলিশিং কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য।
পুলিশের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে পাবলিক অর্ডার মেইনটেনেন্স। কানাডায় আইন মানার ক্ষেত্রে সাধারণ জনতাকে ফ্রি স্টাইল প্রদান করা হয়েছিল। অর্থাৎ পাবলিক নিজ যোগ্যতায় ও নিয়মের ভিত্তিতে আইন মেনে চলবে। কিন্তু যখন এই স্বাভাবিকতার ব্যত্যয় হয় তখন পুলিশের সদস্যরা অ্যাগ্রেসিভ স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করে জনতাকে আইন মানার ক্ষেত্রে বাধ্য করে। সঙ্গত কারণে পুলিশ-পাবলিকের মধ্যকার সম্পর্ক একটি সমীকরণিক বিন্দুতে মিলে অর্থাৎ বিপরীতমুখী অবস্থানের সৃষ্টি হয়। কাজেই বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক-পুলিশের মধ্যকার সম্পর্ককে সুসংহত অবস্থায় নিয়ে আসার প্রয়াসে অনলাইন মাধ্যমে পুলিশের সহযোগিতার দ্বার উন্মোচন করা উচিত যার ভিত্তিতে একজন সাধারণ নাগরিক খুব সহজেই পুলিশের সহযোগিতা গ্রহণের সুযোগ লাভ করে। পরিপ্রেক্ষিতে এ সকল ক্ষেত্রে পুলিশের প্রোঅ্যাকটিভ ভূমিকা জনবান্ধব পুলিশের জন্য নিয়ামক হিসেবে আবির্ভূত হয়। অর্থাৎ অপরাধ সংঘটনের পূর্বেই পুলিশকে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ নারীদের জন্য বিশেষ করে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে নারীদের জন্য নারী পুলিশের ব্যবস্থা গ্রহণে ইতিবাচক কাজের অগ্রগতি হয়। বয়োজ্যেষ্ঠদের ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা একটি নির্দিষ্ট বিরতিতে হলেও বৃদ্ধাশ্রমে খোঁজখবর নিয়ে মানবিকতার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে পাড়ামহল্লায় বৈঠকে মিলিত হতে পারেন। এ ধরনের কার্যক্রম ও অবস্থান পুলিশের সঙ্গে পাবলিকের দূরত্বগত অবস্থানের বিপরীতে একটি সুসস্পর্কে স্থানান্তর করতে পারে যেটি মূলত জনবান্ধব পুলিশের নামান্তর।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]