থার্টি ফার্স্ট নাইট

থার্টি ফার্স্ট নাইটেরফাইল ছবি

মাসুদ আহমেদ আয়কর অফিসের কেরানি। ডিপার্টমেন্টে সৎ কর্মচারী হিসেবে নামডাক আছে তাঁর। নামডাক থাকবে না কেন? তাঁর সহকর্মী আবুল কালাম ঢাকা শহরে অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন এই চাকরি করে। কারও কারও গাড়িও আছে। তবে গাড়িতে করে তাঁরা অফিসে আসেন না। কেরানির চাকরি করে গাড়ি দিয়ে অফিসে এলে মানুষ কেমন যেন তাকায়। গাড়ি দিয়ে তাঁদের ছেলে–মেয়েরা স্কুলে যায়, কলেজে যায়। কোনো কেরানি কত বেশি ঘুষ খায়, তা গাড়ি দেখে বোঝা যায়।

মাসুদ সাহেবের অল্প বেতন। টানাপোড়নের সংসার। তাই বিয়েটাও করতে হয়েছে দেরিতে। পাঁচ বছরের এক ছেলে মিহির ও স্ত্রী মেহেরুনকে নিয়ে তিনজনের সংসার। কিছুদিন হলো মাসুদ সাহেব ঢাকায় বদলি হয়েছেন। কয়েক বছরে ঢাকা শহরের বাসাভাড়া বেড়েছে কয়েক গুণ, তাই অনেক হিসাব–নিকাশ করে আজিমপুর রোডে সাততলায় চিলেকোঠার বাসা ভাড়া নিয়েছেন। চিলেকোঠায় ভাড়া কম। ছাদে পাশাপাশি দুটি বাসা। একটায় থাকেন মাসুদ আহমেদ। কখনো রিকশা, কখনো হেঁটে অফিসে যাতায়াত করেন তিনি।

বাসার সামনে এক চিলতে খালি ছাদ। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে মিহিরকে সঙ্গে নিয়ে বসেন। কখনো ব্যাট–বল নিয়ে বাপ-ব্যাটা খেলতে শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গ দেয় কয়েকটি চড়ুই দম্পতি। চড়ুইগুলো কিছুদিন আগেই বাসা বেঁধেছে ছাদের পূর্ব কোণে। ঢাকা শহরে এখন পাখি দেখা যায় না। কিছুদিন আগেও কাক কা কা করত, কিন্তু এখন তাদের দেখা যায় না। বুঝতে অসুবিধা হয় না চড়ুইগুলো বেশ সুখে আছে। বিকেল বেলায় পার্কগুলোয় কপোত-কপোতীরা যেভাবে বসে প্রেম করে; চড়ুইগুলোও সন্ধ্যায় বাসায় যাওয়ার আগে সেভাবে গায়ে গা লাগিয়ে বসে থাকে। একটি চড়ুই ফুড়ুত করে উড়ে যায়। মুহূর্তেই ঠোঁটে করে শস্যদানা নিয়ে ফিরে আসে। অপরটির ঠোঁটে তুলে দেয় সেই খাবার। খুশিতে সে বিদ্যুতের বেগে পাখা দুটি নেড়ে আনন্দ প্রকাশ করে।

সকালে চড়ুইয়ের কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙল মাসুদ সাহেবের। তিনি বউকে ডেকে বললেন, ‘শহরে পাখির ডাক শুনতে কপাল লাগে, বুঝছ।’ সন্তানসম্ভবা মেহেরুনকে বললেন, ‘প্রতিদিন চড়ুইগুলোকে কিছু খাবার দেবে।’ বিকেলে মাসুদ মিহিরকে দিয়ে পাখিগুলোকে খাবার দেন। এত দিনে মিহির চড়ুইগুলোর বন্ধু হয়ে গেছে। ইটপাথরের শহরে মিহিরের বন্ধু পাওয়ায় তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন মাসুদ।

ফজরের নামাজ শেষ করে অফিসে যাওয়ার আগে মাসুদ সাহেব পাশের বালুমাঠে হাঁটতে যান। চড়ুইগুলোকে মাঠে দেখা যায়, ঘাসের ফাঁকে কিংবা শিশুদের খেলার জায়গায় খুঁজে খুঁজে খাবার বের করছে। মানুষ দেখলে উড়ে গিয়ে গাছের ডালে বসছে। মানুষ চলে গেলে আবার নামছে নিচে। তিনি লক্ষ করলেন, তাঁকে দেখে পাখিগুলো গাছে উড়ে যাচ্ছে না; বরং কিছুটা পিছু পিছু উড়ছে, তারপর আবার খাবারের সন্ধানে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। বাসায় ফিরে বললেন, ‘পাখিগুলো আমার পরিবারের সদস্য। বাসার বাইরেও তারা আমাকে চেনে, সঙ্গ দেয়।’ মেহেরুন হাসলেন। বললেন, ‘তুমি যে বলদামার্কা মানুষ, সবাই তোমার সামনে ভালো আচরণ করে আর পেছনে বাঁশ দেয়।’ সে অবশ্য খারাপ কিছু বলেনি। অফিসে মাসুদ সাহেব যে কাজ করেন, সেই কাজের জন্য ঘুষ নেন তাঁর সহকর্মী রফিক সাহেব। সে কারণে গত মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনে জবানবন্দি দিতে হয়েছে তাঁকে।

চিলেকোঠায় পাশের বাসায় সস্ত্রীক আসগর সাহেব থাকেন। বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন তিনি। তাঁর স্ত্রীকে অবশ্য বাইরে খুব বেশি দেখা যায় না। বাসার ভেতরেই থাকেন বেশির ভাগ সময়। দরজা খোলা কিংবা লাগানোর সময় মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে। দেখে বেজায় বিষণ্ন মনে হয়। সিঁড়িতে দেখা হলে আসগর সাহেব জিজ্ঞেস করেন, ‘নতুন বাসা কেমন লাগছে?’ ঈষৎ হেসে ‘ভালো লাগছে’ জবাব দেন মাসুদ সাহেব।

বেতন পেয়ে মাসুদ মিহিরের জন্য খেলনা আর চড়ুইগুলোর জন্য খাবারের একটা পাত্র নিয়ে এসেছেন। চড়ুইয়ের জন্য ভালোবাসা দেখে মেহেরুন বললেন, ‘কিছুদিন পর আমাদের মেয়ে আসবে, তখন দুজনের জন্য খেলনা কিনে চড়ুইয়ের জন্য কিছু কিনতে পারবা না।’ মাসুদের ঠোঁটের দুই পাশে হাসির রেখা, চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। সৃষ্টিকর্তার কাছে অনেক দোয়া করছে গর্ভের সন্তান যেন মেয়ে হয়। মেয়েরা বাবার দুঃখ–কষ্ট বোঝে। তিনি বললেন, ‘আমার মেয়ে এলে তাকে আকাশের চাঁদ এনে দেব।’ মাসুদ ভাবছেন সামনে ডিসেম্বর মাস; শীত শুরু হয়ে গেছে। শীতে মেহমান আসার আগেই কিছু জামাকাপড় কিনে রাখতে হবে।

মিহির চড়ুইকে খাবার দিলে শুধু একটি চড়ুই আসে। অন্যটি বাসায় বসে থাকে। তাকে খাবার ঠোঁটে তুলে দেয় অপরটি। মাসুদ চড়ুইয়ের বাসার কাছে এগিয়ে যান। দেখেন চড়ুই ডিমে তা দিচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা গেল ছোট ছোট চড়ুইছানা। চড়ুই দম্পতি ছানাগুলোকে সকাল–বিকেল খাবার খাওয়াচ্ছে। খাবারের জন্য আনা পাত্রে মাসুদ আগের তুলনায় বেশি করে খাবার দেওয়া শুরু করেছেন। চড়ুই পরিবারের নতুন সদস্য এসেছে, বেশি খাবার লাগবে। ছানাগুলো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।

কিছুদিন আগেই মিহিরের বোন মেহেরিমা এসেছে। মাসুদের চোখে–মুখে হাসি। অফিস থেকে ফিরে তিনি মিহির ও মেহরিমাকে দেখাশোনা করেন। মেহেরুন ঘরের কাজকর্ম করেন। চড়ুইগুলোর খোঁজ নেওয়া হচ্ছে না। এত দিনে ছানাগুলোর ডানা গজিয়েছে। বাসা থেকে বের হতে পারছে। মা–বাবা অল্প অল্প করে ওড়া শেখাচ্ছে। ছানাগুলো কিছুটা ওপরে উড়ে গিয়ে আবার নেমে আসছে। বিকেলে ঘরে বাসে জানালা দিয়ে পাখিদের প্রশিক্ষণ দেখছেন মাসুদ। সঙ্গে দেখছেন মেহেরিমার মায়াভরা তাকানো। মুগ্ধ হয়ে তিনি ভাবছেন, সন্তানের প্রতি বাবা–মায়ের কত দায়িত্ব, যা দুটি অবুঝ পাখি নৈপুণ্যের সঙ্গে পালন করছে। বাবা হিসেবে তিনি কি পারবেন মিহির, মেহেরিমাকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। ভাবতে ভাবতে কিছুটা তন্দ্রা চলে এল তাঁর। মেহেরিমাও এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে।

বছরের শেষ দিন। আগামীকাল থেকে নতুন বছর শুরু হবে। শীতে কাঁপছে পুরো শহর। বিকেলবেলায় ছোট ছানাগুলো বড় চড়ুইয়ের সঙ্গে খেলা করছে। খেলা শেষে চড়ুইগুলো সন্ধ্যার আগেই বাসায় ঢুকে গেছে। মেহেরিমাও হাত–পা নাড়ছে। বাবা, বাবা বলে ডাকতে চাচ্ছে, কিন্তু আওয়াজ এখনো স্পট হয়নি। তাতেই মাসুদের চোখে আনন্দের ঢেউ খেলে ওঠে। রাতে খেয়ে শুয়ে পরলেন তাঁরা। শোবার আগে মাসুদ মেহরুনকে বললেন, ‘দরজা–জানালা ভালো করে লাগিয়ে দাও।’ মাসুদের মনে পড়ে, শেষবার যখন ঢাকায় ছিল, থার্টি ফার্স্ট নাইটে পটকা–আতশবাজি ফুটেছিল অনেকক্ষণ। কানে তালা লাগার মতো প্রচণ্ড শব্দ।

রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে মাসুদ সাহেবের ঘুম ভাঙল। তিনি লাফ দিয়ে উঠলেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। পুরো আকাশে জ্বলছে লাল–নীল আলো; শব্দ ক্রমে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। মেহেরিমার ঘুম ভেঙে গেছে। বিছানায় বসে আছে মিহির। ভয়ে ও আতঙ্কে কান্না শুরু করছে মেহেরিমা, কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। মিহির তার মাকে জড়িয়ে ধরছে। মেহেরিমাকে মাসুদ বুকে শক্ত করে জড়িয়ে আছেন। কিন্তু ভয়ংকর শব্দে তার কাঁপুনি থামছে না। ভীত–শঙ্কিত মিহির। কী করবেন, মাসুদ বুঝতে পারছেন না। পাশের বাসা থেকে আসগর সাহেবের স্ত্রীর কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। তিনি বলছেন, ‘এমন! এমন শব্দে আমার কলিজার ধন কেঁপে কেঁপে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল। বন্ধ কর, বন্ধ কর এসব উদ্‌যাপন।’ আসগর সাহেবও কাঁদছেন। তাঁর কান্নার কোনো শব্দ আসছে না। তিনি স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে হয়তো সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

চড়ুইয়ের ছানাগুলোর কান্নার শব্দ আতশবাজির শব্দে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। শব্দ আর আলোর তীব্রতায় পাখিগুলো বাসা থেকে বের হয়ে আসছে। আতশবাজির উজ্জ্বল আলোয় দেখা যাচ্ছে চড়ুই, কাক, চিল এদিক–ওদিক উড়ছে। কোন দিকে যাবে দিশা পাচ্ছে না তারা। প্রচণ্ড শব্দে মানুষের প্রাণই বের হওয়ার উপক্রম হচ্ছে; পাখির প্রাণ আরও ক্ষীণ। রাত গভীর হলেও চলল আতশবাজির হুংকার।

নতুন বছরের প্রথম সকাল। আতশবাজির শব্দ বন্ধ হলেও থামছে না মেহেরিমার কাঁপন। মেয়ের কাঁপুনি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন মা মেহেরুন। হাসপাতালে নিতে হবে মেহেরিমাকে। সন্তানকে নিয়ে বের হলেন মাসুদ। বাসার সামনে খালি ছাদে মৃত চড়ুইয়ের ছানাগুলো দেখে আঁতকে উঠলেন। যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে দেখেন পড়ে আছে নিথর কাক, চিল, ফিঙেসহ আরও অনেক পাখি। হাসপাতালে ভর্তি করা হলো মেহেরিমাকে। ডাক্তার বিড়বিড় করে বললেন, ‘প্রতিবছর মানুষের সামান্য আনন্দে প্রাণ হারাচ্ছে অনেক শিশু।’ মেহেরিমাকে পরীক্ষা করে দেখলেন তিনি। তাঁর চাহনিতে কিছুটা আশ্বস্ত হলো মাসুদ। একদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে এলেন মেহেরিমাকে নিয়ে। বাসায় এসে স্ত্রীকে বিষণ্ন গলায় বললেন, ‘আগামী থার্টি ফার্স্ট নাইটে ঢাকায় থাকা যাবে না।’

  • নাগরিক সংবাদ-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]–এ