মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি আরও নজর দেওয়া জরুরি
মাদ্রাসা শিক্ষা সাধারণত ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বোঝায়, যেখানে ছাত্ররা কোরআন, ইসলামি আইন, ধর্মতত্ত্ব ও আরবি ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন করতে পারে। ইসলামি স্বর্ণযুগে মাদ্রাসায় সমৃদ্ধ পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেখানে কেবল ধর্মীয় অধ্যয়নই নয়; বরং বিজ্ঞান, গণিত ও দর্শনের মতো বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করত। এর মধ্যে (অষ্টম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী) ইরাকের বাগদাদের বায়তুল হিকমাহর একটি উদাহরণ। বায়তুল হিকমাহ ছিল একটি প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র, যেখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মতাবলম্বীর শিক্ষাবিদেরা গ্রিক, রোমান, ফারসি, ভারতীয় এবং অন্য সভ্যতার শাস্ত্রীয় রচনাগুলো অনুবাদ, সংরক্ষণ ও অধ্যয়নের জন্য একত্র হয়েছিলেন। যদিও এটি ঐতিহ্যগত অর্থে আজকের মাদ্রাসার মতো মাদ্রাসা ছিল না। এটি বিভিন্ন সংস্কৃতি ও শৃঙ্খলাজুড়ে জ্ঞানের সংমিশ্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ সময়কালে ইসলামিক শিক্ষাবিদেরা জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসা, দর্শনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আল রাজি, ইবনে সিনা, আল কিন্দি ও আল ফারাবির মতো ব্যক্তিত্বরা চিকিৎসা, গণিত ও দর্শনে তাঁদের অবদানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এ শিক্ষাবিদেরা প্রায়ই ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ অধ্যয়নকে অন্তর্ভুক্ত করে এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।
বায়তুল হিকমাহ ছাড়াও ইসলামিক বিশ্বে শিক্ষার অন্যান্য কেন্দ্র ছিল, যেখানে বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হতো। মুসলিম স্পেনের কর্ডোভা (আল-আন্দালুস) একটি সমৃদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল, যেখানে ইসলামিক ও ধর্মনিরপেক্ষ উভয় বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত ছিল। এবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলা যাক। বাংলাদেশে বর্তমান মাদ্রাসা শিক্ষার প্রধানত দুটি পর্যায় দেখতে পারি। প্রথমত, আলিয়া মাদ্রাসা, যারা (ইসলামিক ও জেনারেল কারিকুলাম) অনুসরণ করে এবং দ্বিতীয়ত, কওমি মাদ্রাসা (ইসলামিক কারিকুলাম) অনুসরণ করে। একজন আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র হয়ে আলিয়া মাদ্রাসার বিদ্যমান সমস্যাই আমার উদ্দেশ্য।
ওপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, মাদ্রাসা শিক্ষা শুধুই যে ইসলামিক ধর্মতত্ত্বকেন্দ্রিক ছিল বিষয়টা এমন নয়। বর্তমানে আলিয়া মাদ্রাসায় দুই ধরনের ছাত্ররা ভর্তি হয়ে থাকে। প্রথমত, যারা তুলনামূলক আধুনিক জ্ঞানের পাশাপাশি ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান (আলেম) সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান আহরণ করতে চায় এবং দ্বিতীয়ত যারা বিস্তর আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি তুলনামূলক ইসলামি জ্ঞান আহরণ করতে চায়।
বর্তমানে আমরা যদি ‘আলিয়া’ মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা করি, তাহলে বুঝতে পারব ইসলামি স্বর্ণযুগে মাদ্রাসা শিক্ষার কার্যক্রমের সঙ্গে বিস্তর ফারাক যে আছে, তা কিন্তু নয়। তবে যেটা ভাবনার বিষয়, এত সমৃদ্ধ শিক্ষাক্রম থাকার পরও কেন দেশের উচ্চশিক্ষার স্তর, তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাদ্রাসা থেকে আমরা বেশিসংখ্যক ছাত্র দেখতে পারছি না। এর বিভিন্ন কারণ লক্ষণীয়। তন্মধ্যে যোগ্য শিক্ষক–সংকট অন্যতম সমস্যা। আমরা কিছু বছর ধরে দেখতে পারছি মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে পরিবর্তন হলেও যে বইগুলো ছাত্রদের হাতে দেওয়া হয়, এ বইগুলো সম্পর্কে ভালো জ্ঞান বা দক্ষতা মাদ্রাসার শিক্ষকদের কতটা আছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। অধিকাংশ আলিয়া মাদ্রাসায় না আছে আরবি শিক্ষাক্রমের জন্য যোগ্য শিক্ষক, না জেনারেল শিক্ষার জন্য যোগ্য শিক্ষক। এদিকে যোগ্য শিক্ষক না আসার বিভিন্ন কারণও থাকতে পারে, যা ভাবনার এবং সমাধানের সময় এসেছে। আবার স্কুল–কলেজের ছাত্রদের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রমে রয়েছে বিস্তর ফারাক, যদিও আগের তুলনায় এ হারটা কমেছে। তার কারণ হলো মাদ্রাসা ছাত্রদের আরবিকেন্দ্রিক অনেকগুলো বিষয় পড়তে হয়। যদিও এখানেও (আরবি শিক্ষা) রয়েছে যোগ্য শিক্ষকের অপ্রতুলতা, যার কারণে আমরা মেধাবী ছাত্রগুলোকে আলিম, তথা উচ্চমাধ্যমিকের পর ধরে রাখতে পারছি না। তারা কওমি মাদ্রাসায় চলে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষার জন্য, যা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার জন্য সুখকর কোনো বিষয় নয়। আবার এমনও ছাত্র আছে, যারা ভাবে যে আলিম পর্যন্ত মাদ্রাসায় পড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়বে। তারাও হচ্ছে ভোগান্তির শিকার।
আমরা জানি, বর্তমান সময়টা প্রতিযোগিতার সময়। একজন মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্র হয়ে বুঝতে পারি যে মাদ্রাসার ছাত্ররা স্কুল–কলেজের ছাত্রদের থেকে কম মেধাবী বা পিছিয়ে পড়া, এটা অবিশ্বাসযোগ্য। মাদ্রাসার ছাত্ররা সবচেয়ে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে যোগ্য শিক্ষকের অপ্রতুলতায়, যার ফলে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান–ভীতি কাজ করছে। আবার অনেক পর্যায়ে দেখা যায় এ বিষয়গুলো পাঠদানের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ অবহেলা দেখায়। যে কারণে নবম শ্রেণিতে উঠেই অনেক মেধাবী ছাত্র মানবিক শাখায় চলে যায়। মাদ্রাসার ছাত্র যারা চায় যে আলিম পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হতে, দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগই কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। কারণ, তাদের প্রধান দুর্বলতা ইংরেজিতে, যদি মানবিক শাখার ছাত্রদের কথা বলি। আর যেটার ভুক্তভোগী দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা হাজারো মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। ওরা তেমন যোগ্য শিক্ষক পাচ্ছে না যেমনটা কলেজের ছাত্ররা পাচ্ছে। যোগ্য শিক্ষক মাদ্রাসায় যদি নিয়োগ দেওয়াও হয়, তাহলে দেখা যায় ওই শিক্ষককে বেতন–ভাতা তুলনামূলক বেশি দেওয়া লাগছে, যা অনেক প্রাইভেট মাদ্রাসার পক্ষেই অসম্ভব।
ইংরেজির মতো গণিত, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা। দেখা যায় বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে যে ছাত্ররা বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়, তারাও কলেজের ছাত্রদের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে। কিছু ব্যতিক্রম তো থাকেই, যারা কলেজের বিভিন্ন শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ে উন্নতি করছে। আবার এদিকে একটা আশার কথা হলো দেশে বিভিন্ন ক্যাডেট মাদ্রাসায় যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে আর হতাশার কথা হলো ওখানে ধনী পরিবারের সন্তানেরাই পড়তে পারছে। এমনও মাদ্রাসা আছে বাংলাদেশে, যেখানে বিজ্ঞান বিভাগ আছে, তবে পড়াশোনা কোন পর্যায়ের হয়, তা প্রশ্নবিদ্ধ। মাদ্রাসা শিক্ষা কারিকুলামে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে, তবে যে শিক্ষকেরা এ বইগুলো পড়াবেন, তাঁরা কতটা প্রস্তুত আছেন, এটাও একটা প্রশ্ন। শুধু কারিকুলামে পরিবর্তন এনেই মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত করা যাবে না, এটা চিরন্তন সত্য। এখন একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। নতুন কারিকুলাম শিক্ষকদের হাতে দেওয়ার আগে তাঁদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের বেতন–ভাতা বৃদ্ধি এবং যারা আলেম হতে চায়, আলিম পরীক্ষার পর তাদের যেন আলিয়া মাদ্রাসায় রেখেই যোগ্য আলেম হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহলের ভূমিকা রাখা অপরিহার্য।
*লেখক: সাহীদ বিন আহমদ, শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।