বাংলা নববর্ষ: ইতিহাস এবং উদ্‌যাপনের ধারাক্রম

প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশের সব মানুষ মনপ্রাণ উজাড় করে যে উৎসবটা উদ্‌যাপন করে, সেটা হলো বাংলা নববর্ষ। এই উৎসবে জড়িয়ে থাকে খাবারদাবার, গানবাজনা নানা কিছু। যেকোনো বৈশাখী মেলায় গেলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়। অন্যদিকে বহুকাল ধরেই পয়লা বৈশাখের সঙ্গে আবার ব্যবসায়িক লেনদেনের সম্পর্ক জড়িত, যা হালখাতা হিসেবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পালিত হয়। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে নববর্ষ উদ্‌যাপনে যুক্ত হয়েছে পান্তা-ইলিশ। ইউনেসকোর স্বীকৃতি পাওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার বয়সও কিন্তু খুব বেশি নয়। এমন আয়োজন অবশ্য শহরকেন্দ্রিক। গ্রামগঞ্জে এ ধরনের শোভাযাত্রার চর্চা খুব একটা দেখা যায় না। শহর এলাকায় আবার বাংলা ক্যালেন্ডার ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। বাংলা সনের কোন দিন কোন তারিখ, তা কেউ কিন্তু সহজে বলতে পারে না। যেটা ইংরেজি দিন-তারিখের ক্ষেত্রে কারোরই ভুল হয় না। তার মানে আমরা বৈশাখ বরণ যত বেশি করছি, সেই তুলনায় বাংলা মাসের হিসাব রাখি না।

আমাদের অঞ্চলে বহুকাল ধরে বৈশাখী মেলা হয়ে থাকে। কিন্তু আগেকার সময় কিন্তু চৈত্রসংক্রান্তি বা চৈত্র মাসের শেষ দিনেও বেশ কিছু আয়োজন থাকত। পয়লা বৈশাখের দিনও ভালোমন্দ খাওয়া, মেলায় যাওয়ার রীতি ছিল। সমাজে কারও কারও মধ্যে একটা ধারণা ছিল এসব আয়োজন বাঙালি মুসলমানের নয়। এটা আসলে ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, বাংলা সন প্রবর্তনই করেছেন উপমহাদেশের মুসলিম শাসকেরা, যেটা মূলত ছিল মোগল আমল।

বাংলা সনের প্রবর্তন যেভাবে

পৃথিবীর বিভিন্ন সন-তারিখ ব্যক্তির জন্ম, ব্যক্তির সফর—এ ধরনের বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বাংলা সন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন—এই বর্ষপঞ্জির নামকরণ একটি জাতিগোষ্ঠী বা অঞ্চলের নামের ওপর হয়েছে। এ অঞ্চলের নিজস্ব সন-তারিখের উদ্ভব কীভাবে হলো? এ নিয়ে বেশ কিছু মত রয়েছে। তবে ঐতিহাসিক গবেষণায় বেশির ভাগ মতই টিকে না। যেটা যৌক্তিক ও ইতিহাস পরম্পরায় প্রমাণিত হয়, সেটা হলো: ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেন। এ বিষয়ে বাংলাপিডিয়ার বিবরণ হচ্ছে, এই নতুন বর্ষপঞ্জি প্রথমে তারিখ-ই-এলাহী নামে পরিচিত ছিল। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ এটি বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। নতুন এই সালটি আকবরের রাজত্বের ২৯তম বর্ষে প্রবর্তিত হলেও তা গণনা করা হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে, কারণ এদিন আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। দিনটি স্মরণীয় রাখতে নতুন বর্ষপঞ্জি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

তবে নতুন সৌরবর্ষ চালুর পেছনে তৎকালীন কৃষিনির্ভর অর্থনীতি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। কারণ, সম্রাট আকবরের বঙ্গাব্দ চালুর পেছনে চান্দ্র-মাসের হিসেবে খাজনা আদায়ে যে সমস্যা তৈরি হয়, তার সমাধানের বিষয়টি ছিল। ইতিহাসের বিবরণ মতে, ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটেরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন ছিল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল। যে কারণে ফসল উৎপাদনের সময়ের সঙ্গে মিলত না। তাই চাষিদের অসময়ে খাজনা দিতে হতো। এতে নানা রকম সংকট তৈরি হতো। মূলত এ থেকে উত্তরণ পেতেই বাংলা সনের সূচনা হয়।

চৈত্রসংক্রান্তির কথা

চৈত্র মাসের শেষ দিন, বিদায় নেবে বসন্তকাল। এই দিনে পালন করা হয় চৈত্রসংক্রান্তি। এই সংক্রান্তিও অন্যতম একটি উৎসব। বাংলা বছরের শেষ দিন উদ্‌যাপন করে জীর্ণতা দূর করার চেষ্টা রয়েছে অনেককাল ধরেই। আর বাংলা নববর্ষকে বরণের প্রস্তুতিও শুরু হয় এভাবে। চৈত্রসংক্রান্তির দিনেও গ্রামগঞ্জে খাওয়া নিয়ে আলাদা একটি রীতি ছিলো। সেটা হলো-১৪ রকমের কুড়ানো শাক খাওয়া। মূলত বাড়ির আলানে-পালানে, পথেঘাটে, আইলে প্রাকৃতিকভাবে যেসব শাক জন্ম নেয়, সেগুলো কুড়িয়ে এনে রান্না করা হতো। এ ছাড়া চৈত্রসংক্রান্তিতে বেশ কিছু লোকাচারমূলক অনুষ্ঠান থাকে। যেমন চড়কপূজা, সংক্রান্তির মেলা ইত্যাদি।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

হালখাতার হালচাল

ফারসি ‘হাল’ শব্দের অর্থ নতুন। আমাদের এখানে যা দিয়ে বোঝানো হয় চলতি সময়, সমকাল বা বর্তমান। তাই হালখাতা মানে সমকালের খাতা বা নবায়নকৃত খাতা বা নতুন খাতা। পয়লা বৈশাখ থেকে নতুন খাতা খোলেন ব্যবসায়ীরা। সেখানে ক্রেতাদের আগের বছরের বকেয়া পরিশোধ করে নতুন করে খাতায় নাম লেখাতে হয়। হালখাতায় তাই দোকানগুলোয় ক্রেতা-বিক্রেতার মিলনমেলায় রূপ নেয়। দোকানিরা আগতের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন।

এই হালখাতা বহন করছে সেই নবাবি ও জমিদারি আমলের ঐতিহ্য। সেকালে পয়লা বৈশাখে পালিত হতো ‘পুণ্যাহ’ উৎসব। এর মাধ্যমে নবাব ও জমিদারেরা কৃষকদের কাছ থেকে এই উৎসবের মাধ্যমে খাজনা আদায় করতেন। তখন ফসল উঠত চৈত্র মাসের শেষ দিকে। প্রজারা খাজনা দিয়ে জমিদারবাড়িতে আপ্যায়িত হতেন উৎসবের মাধ্যমে। কালের প্রবাহে সেই জমিদারি ও নবাবি প্রথা আর নেই। তাই হারিয়ে গেছে পুণ্যাহ উৎসবও।

আগের মতো হালখাতার জৌলুশও আর নেই। তবু টিকে আছে এই উৎসব। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বর্ণকারেরা গুরুত্ব দিয়েই হালখাতা উৎসব পালন করেন। সারা বছর যে খাতাটিতে হিসাবপত্র লিখে থাকেন, সেই খাতাটি পরিবর্তন করেন বছরের প্রথম দিন। পয়লা বৈশাখে খোলা হয় নতুন খাতা। আদি ব্যবসায়ীরাই মূলত হালখাতা উৎসব ধরে রেখেছেন।

বৈশাখী মেলার একাল-সেকাল

বাংলা নববর্ষের যত আয়োজন তার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় বৈশাখী মেলা। শহরাঞ্চলে এর প্রভাব কমে এলেও গ্রামগঞ্জে এখনো মেলার আবেদন রয়ে গেছে। বছরের প্রথম দিন শুরু হওয়া মেলা কোথাও হয় এক দিন আবার কোথাও চলে সপ্তাহব্যাপী। এই মেলার মাধ্যমে বাঙালির ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতির অনেক কিছু তুলে ধরা হয়। মেলায় হস্তশিল্প, মাটির খেলনা, কাঠ ও বাঁশের সামগ্রী, তাঁতবস্ত্র, গয়নার তো পণ্য বিক্রি হয়, যা লোকজ পণ্য ও কুটিরশিল্পের প্রসারে সহায়ক। এ ছাড়া নানা খাদ্যসম্ভার থাকে মেলায়। এর মধ্যে আছে মুড়ি, মুড়কি, খই, নিমকি, সন্দেশ, বাতাসা, নকশি পিঠা ইত্যাদি।

বৈশাখী মেলার ঐতিহ্য দীর্ঘ দিনের
ফাইল ছবি

বৈশাখী মেলার ঐতিহ্য কিন্তু অনেক দিনের। কয়েক শ বছর তো হবেই। সেই নবাবি আমলে যে পুণ্যাহ উৎসব হতো, তার সঙ্গে মেলার সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, সেই উৎসবে রাজা-প্রজার মিলনমেলা ঘিরে বসত মেলাও। সেখান থেকেই আসলে বৈশাখী মেলার সূত্রপাত, যা ঐতিহাসিক সূত্রেই প্রমাণিত।

সেকাল থেকেই বৈশাখী মেলা ঘিরে লোকজন সংস্কৃতির আয়োজনও থাকত। মেলা ঘিরে যাত্রাপালা, সার্কাস, পুতুলনাচ, বাউল আসরও বসত। থাকত নানা খেলার আয়োজন। ঢাকা শহরে বিসিকের বৈশাখী মেলা সেই ঐতিহ্য আজও কিছুটা ধরে রেখেছে।

পান্তা-ইলিশের ইতিবৃত্ত

আগেই বলেছি, বাংলা বছরের শেষ দিন তথা চৈত্রসংক্রান্তিতে শাকান্ন খাওয়ার একটা রীতি ছিল। আর বছরের প্রথম দিনে ভালোমন্দ খাওয়ার একটা প্রচেষ্টা থাকত। বিষয়টি এমন যে পয়লা বৈশাখে ভালো কিছু খেলে পুরো বছরটা ভালো কাটবে, এমন একটা আকাঙ্ক্ষা কাজ করত। তার জন্য সামর্থ্যমতো বাঙালিরা পোলাও-গোশত, মাছ-ভাতসহ বিশেষ খাবার রান্না করত। বর্তমানে পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষণীয়। এটা কিন্তু তুলনামূলক নতুন একটি সংযোজন। এর সূচনা হয়েছে ঢাকা শহরে। সেটা আশির দশকের শুরুর দিকে রমনা বটমূলের আয়োজন কেন্দ্র করে। ভোরে রমনায় ছায়ানটের আয়োজন দেখতে আসে অনেকেই। সেখানেই মেলার মতো বসে। অনেকেই পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসে। এমন কোনো গ্রুপই প্রথম পান্তা-ইলিশ খাওয়া শুরু করে। এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে নব্বই দশকের শুরু থেকে।

পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার চল রয়েছে
ফাইল ছবি

বর্তমানে পয়লা বৈশাখে অনেক ঘরেই সকাল শুরু হয় পান্তা-ইলিশ খেয়ে। আর বৈশাখী নানা আয়োজনে পান্তা-ইলিশ বেচাবিক্রি হতে দেখা যায়। লোকজন খুব আগ্রহ নিয়ে তা খেয়ে থাকে। পান্তা-ইলিশ না খেলে যেন নববর্ষ বরণ পূর্ণাঙ্গই হচ্ছে না। তুলনামূলক নতুন এই সংস্কৃতি নিয়ে সমালোচনাও আছে। তবু পান্তা-ইলিশ একধরনের রীতি হয়ে গেছে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের ক্ষেত্রে। তাই এই সময়ে চড়া দামে ইলিশ কিনতেও দ্বিধা করে না কেউ।

বৈশাখের শোভাযাত্রা

ঢাকা শহরে নববর্ষ উদ্‌যাপনে সেই ষাটের দশক থেকে রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজন বড় একটি বিষয়। সেটা ঘিরেই পরবর্তী সময়ে পয়লা বৈশাখের আয়োজন ছড়িয়ে পড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শাহবাগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা আলাদা বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছে, যা ইউনেসকো কর্তৃক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে নববর্ষের শোভাযাত্রা পয়লা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়
ফাইল ছবি

এই শোভাযাত্রা সূচনা কিন্তু ঢাকা শহরে হয়নি। সেটা ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ যশোরে প্রথমবারের মতো আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যেখানে পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরোনো বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতি ছিল। এটা অনুসরণ করেই ঢাকায় শুরু হয় আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। এরপর প্রতিবছর এই আয়োজন হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে এর নামকরণ করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। পরবর্তী সময়ে বৈশাখের এই শোভাযাত্রা চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ অনেক শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার আয়োজন অনুসরণ করে কলকাতা শহরেও এখন পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা করার খবর পাওয়া যায়।

শেষ কথা

বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন একধরনের সৌর পঞ্জিকা। এপ্রিলের শেষার্ধ থেকে মে মাসের প্রথমার্ধ নিয়ে বৈশাখ মাস। বৈশাখ নামের নামকরণ মূলত বিশাখা নামক নক্ষত্রের নামানুসারে। এই বিশাখার মতোই উজ্জ্বল হোক সবর জীবন। বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা রইল সবার জন্য।