বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস ২০২৫: সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় উপেক্ষিত ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা
আজ ২৫ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস ২০২৫। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য—ভাবনায় স্বাস্থ্য, ভাবনায় ফার্মাসিস্ট (Think Health, Think Pharmacist)। দিবসটি উপলক্ষে স্বাস্থ্য খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্র তুলে ধরা হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদাহরণ দিয়ে।
বেলা ১১টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ ফার্মেসির সামনে নারী-পুরুষের দীর্ঘ সারি। চিকিৎসক দেখানোর পর ব্যবস্থাপত্রের সঙ্গে একটি ছোট টোকেন দেওয়া হয়েছে। এতে রোগীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর, ওষুধের নাম ও পরিমাণ লেখা থাকে। টোকেনটি জমা দিলে ভেতর থেকে ওষুধ দেওয়া হয় এবং রোগীকে তা সেবনের নিয়ম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও করণীয় সম্পর্কে বুঝিয়ে বলা হয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এমন দৃশ্য নিত্যদিনের।
কিন্তু যাঁরা এই কাজটি করছেন, তাঁদের পরিচয় প্রায়শই আড়ালে থেকে যায়। অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, তাঁরা বাজারের সাধারণ ফার্মেসির কর্মচারীর মতোই কেউ। বাস্তবে তাঁদের একটি সুনির্দিষ্ট পরিচয় আছে—তাঁরা ফার্মাসিস্ট (ডিপ্লোমা)। চিকিৎসক ও নার্সদের আড়ালে থাকা এই পেশাজীবীরা জনস্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের অধীন ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-ফার্মেসি কোর্স সম্পন্ন করার পর একজন বি-গ্রেড ফার্মাসিস্ট হিসেবে তাঁরা নিবন্ধন লাভ করেন। বর্তমানে ৫৭টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর ১ থেকে ২ হাজার ফার্মাসিস্ট (ডিপ্লোমা) বের হচ্ছেন। এই কোর্সে ভর্তির জন্য বিজ্ঞান বিভাগ থেকে (জীববিজ্ঞানসহ) ন্যূনতম জিপিএ ৩.০০ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়া এবং এরপর ভর্তি পরীক্ষায় সফল হওয়া বাধ্যতামূলক। অন্যান্য ডিপ্লোমা কোর্সে যেখানে যেকোনো বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করলেই চলে, সেখানে ফার্মেসি কোর্সের মান বেশ কঠোর।
কোর্স কারিকুলামেও রয়েছে ভিন্নতা। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন পরিচালিত সাধারণ ডিপ্লোমা কোর্সে পাসের নম্বর ৪০% হলেও, ডিপ্লোমা ইন ফার্মেসি কোর্সে পাসের জন্য ৬০% নম্বর লাগে। এ ছাড়া সম্পূর্ণ কোর্সটি ইংরেজি মাধ্যমে এবং সিজিপিএ সিস্টেমে পরিচালিত হয়।
এত কঠোর নিয়ম ও উচ্চ মান সত্ত্বেও ফার্মাসিস্টরা (ডিপ্লোমা) সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন ১১তম বেতন গ্রেডে। অথচ সমমানের ৪ বছরের ডিপ্লোমাধারী প্রকৌশলীরা ১৯৯৪ সালে, নার্সরা ২০১১ সালে এবং কৃষিবিদেরা ২০১৮ সালে দশম গ্রেড পেয়েছেন। ফার্মাসিস্টদের (ডিপ্লোমা) দশম গ্রেডে উন্নীত করার প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ফাইলবন্দী হয়ে আছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, সরকারি কাঠামোতে ফার্মাসিস্টরা কি অবহেলার শিকার?
নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই হতাশা দেখা যায়। একটি ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফার্মেসি ছাড়াও এনসিডি কর্নার, আই ভিশন কর্নার এবং স্টোর স্থাপন করা হলেও সেখানে মাত্র দুজন ফার্মাসিস্টের পদ রয়েছে। এসব কর্নার সঠিকভাবে পরিচালনা করতে কমপক্ষে পাঁচজন ফার্মাসিস্ট প্রয়োজন। গত দুই দশকে সরকারি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্টের পদ বাড়েনি।
জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিস্থিতি আরও নাজুক। যেখানে দৈনিক দুই থেকে চার হাজার মানুষ সেবা নিতে আসে, সেখানে ফার্মাসিস্ট আছেন মাত্র চার-পাঁচজন। বাধ্য হয়ে অন্য পেশার কর্মীদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। অথচ প্রতি ১০টি শয্যার বিপরীতে একটি করে ফার্মাসিস্টের পদ সৃষ্টি করা হলে এই সংকট হতো না। এতে একদিকে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ ফার্মাসিস্টরা বেকার বসে আছেন, অন্যদিকে রোগীরা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
উচ্চশিক্ষা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের অন্য সব ডিপ্লোমা কোর্সের পর উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকলেও ডিপ্লোমা ইন ফার্মেসির জন্য সরকারিভাবে কোনো সুযোগ নেই। সরকার চাইলেই বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি, ঢাকাতে বি.ফার্ম ডিগ্রি চালু করতে পারে।
বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবসে পেশাজীবী ফার্মাসিস্টরা (ডিপ্লোমা) বিশ্বাস করে বর্তমান সরকার তাঁদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করে এ পেশার যাবতীয় সমস্যার সমাধান করবেন। কারণ, স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি ধাপে তাঁদের অবদান অপরিহার্য।
*লেখক: মোতাছিম বিল্লাহ মুন্না, ফার্মাসিস্ট (ডিপ্লোমা) ও সাবেক শিক্ষার্থী, আইএইচটি, বগুড়া
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]