পুঁজির কাছে সবই কেবল পণ্য

বর্তমান উত্তপ্ত পৃথিবীতে মানুষের নির্বুদ্ধিতা ও অসহায়ত্ব বিবেচনায় বয়লিং ফ্রগ সিনড্রোম একটা জনপ্রিয় মেটাফোর। এটি বর্তমান সময়ে আলোচনার দাবি রাখে।

একটি ব্যাঙকে যদি পানিভর্তি পাত্রে রাখা হয় এবং পাত্রটিকে উত্তপ্ত করতে থাকা হয়, তখন ব্যাঙটি পানির তাপমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকে। লাফ দেওয়ার পরিবর্তে পানির উষ্ণতায় সে আরাম বোধ করতে থাকে। কিন্তু তাপমাত্রা যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন সে আর লাফ দিতে পারে না। কারণ, ততক্ষণে সে তার সব শক্তি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে নিঃশেষ করেছে। অতঃপর সে পানিতে সেদ্ধ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

ইউরোপ থেকে এশিয়া, লন্ডন থেকে ঢাকা, সবখানে পুড়ছে মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, গাছপালা ও তরুলতা। পুড়ছে মনুষ্য জাতির ভবিষ্যৎ। এই আগুন যতটা না প্রকৃতির তার চেয়ে বেশি আমাদের লোভের। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে ক্রমেই আমরা একটা মহাপ্রলয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দিন যতই যাচ্ছে, ততই অসুস্থ হয়ে পড়ছে পৃথিবী। মানুষেরই কর্মফলে দিন দিন এই গ্রহ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। আজ থেকে প্রায় দুই শ কোটি বছর আগে যখন ধীরে ধীরে এই গ্রহ ঠান্ডা হলো, গড়ে উঠল বায়ুমণ্ডল, সব সৌরজগতের মধ্যে কেবল এই গ্রহেই প্রাণের সঞ্চার ঘটে।

বিজ্ঞানীদের গবেষণায়, আগামী দুই শ কোটি বছর পর পৃথিবী আবার নিষ্প্রাণ হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। মাঝের এই চার শ কোটি বছরে মানুষের প্রতিনিয়ত বেড়ে ওঠা লোভ, ভোগের লিপ্সা, সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সপ্রাণ এই গ্রহকে শীতল, অন্ধকার, নিষ্প্রাণ একটা গ্রহতে পরিণত করতে যাচ্ছে। জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ভূবিজ্ঞানী অধ্যাপক ক্রিস রেনহার্ড ও জাপানের তোহো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক কাজুমি ওজাকি জাবির মতে, সূর্যের তাপে ভস্মীভূত হওয়ার অনেক আগেই বিষাক্ত মিথেন গ্যাসে ভরে যাবে পৃথিবী।

অক্সিজেনের লেশমাত্র না থাকায় প্রাণ স্তব্ধ হয়ে যাবে। ক্ষতিকর বিকিরণ এবং সূর্যের প্রচণ্ড তাপে ধ্বংস হয়ে যাবে ওজোনস্তর, গোটা পৃথিবীতে ছেয়ে যাবে শুধু মিথেন গ্যাসে। দু-একটি অণুজীব ছাড়া মানুষ নামে কোথাও কোনো প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে না। অথচ মানুষের এমন ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে যাত্রার জন্য অন্য কোনো জীব নয়, কেবল মানুষই দায়ী।

এসব জানা ও উপলব্ধির পরও আমরা প্রতিকারহীন একধরনের বয়লিং ফ্রগ সিনড্রোমে ভুগছি। আর এই সিনড্রোম তৈরিতে ঘি ঢেলেছে পুঁজিবাদ। পুঁজি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আস্তিক, নাস্তিক ভেদাভেদ জ্ঞান করে না। পুঁজির কাছে সবই কেবল পণ্য।

মুনাফাই তার কাছে বড়। বিশ্বব্যাপী পুঁজি প্রাণ, প্রকৃতি, প্রতিবেশের যে বিনাশ ঘটাচ্ছে এবং মানুষসহ সব জীবের বেঁচে থাকা কঠিন করে তুলছে, তা আমরা আমলে নিচ্ছি না।

যদিও আমলে নিচ্ছি, তবে এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছি না। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর নানা প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সদিচ্ছার অভাবে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। কেবল আইনকানুন, কনভেনশন, চুক্তি আর সম্মেলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে পরিবেশভিত্তিক বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম। এভাবে চলতেই থাকবে, নাকি কোনো প্রতিকার আছে?

*লেখক: আজাদ খান ভাসানী, সভাপতি, মওলানা ভাসানী কৃষক সমিতি ও সদস্যসচিব, ভাসানী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি। সন্তোষ, টাঙ্গাইল