এ পৃথিবী হয়তো গাজার শিশুদের জন্যে নয় কিংবা ওরা পৃথিবীর কেউ না

ইসরায়েলের হামলার মুখে দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায় পালাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা
ছবি: রয়টার্স

আজ আমরা মঙ্গলে রোবট পাঠাচ্ছি, চাঁদে যাচ্ছি—আরও কত না জানা তথ্য খুঁজে বেড়াচ্ছি মহাকাশজুড়ে। এ সবই আমাদের সভ্যতার বাহ্যিক রূপ। এ পৃথিবী হয়তো এখনো আত্মার সভ্যতাকে লালন করতে পারে নাই, তাই সে মেনে নিতে পেরেছে ইসরায়েলি বাহিনীর গাজায় চলমান ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম শিশুহত্যা। আজ গাজার ওই ছোট্ট ভূমিটা যেন এক টুকরা নরকে পরিণত হয়েছে, পুরো পৃথিবীর মানুষগুলো এ ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী। মাঝেমধ্যে নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব ভাবতে  ঘৃণা হয়। কারণ, যখন দেখি ওই সব নিষ্পাপ শিশুদের আহাজারি, পৈশাচিক আঘাতের তীব্রতা, আর শত শত লাশের সারি আমাদের বিবেককে জাগ্রত করতে পারেনি। মাঝেমধ্যে মনে হয় গাজার আকাশ, বাতাস, গাছ, পাখি—কেউই বোধ হয় শিশুগুলোর দীর্ঘশ্বাসের ভার আর নিতে পারছে না, তাদের ভাব প্রকাশের যদি কোনো ভাষা থাকত, তাহলে হয়তো আমাদের মতো আধুনিক সভ্যতার সজ্জিত নির্বাক শ্রোতা হয়ে বসে থাকতে পারত না। আমরা কেউই এ অভিশাপের বাইরে নই।

আমরা পৃথিবীতে অনেক সংস্থা এবং সংগঠন তৈরি করেছি। যেমন ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন, চাইল্ড রাইটস ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক, ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি। পৃথিবীজুড়ে মিলিয়ন মিলিয়ন অর্থ খরচ করছি শুধু আমাদের মতো আধুনিক এবং সভ্যতার মুখোশে আবৃত মানুষগুলোর ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রক্ষার্থে। শুধু তাই নয়, এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জনকারীকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে মর্যাদাও প্রদর্শন করি। কিন্তু এ অবস্থায় একটি উন্নত অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত ধর্মীয় উগ্র জনগোষ্ঠী যখন পৈশাচিক আক্রমণের মাধ্যমে হাজারো শিশুকে হত্যা করে চলছে পুরো পৃথিবীর মানুষের চোখের সামনে, তখন পৃথিবীর ওই উন্নত ও আধুনিক দেশগুলো তাদের শক্তির সামঞ্জস্যকরণ এবং তার প্রদর্শনে ব্যস্ত। তাহলে এসব শিশু অধিকার সংস্থাগুলোর কার্যকলাপ কিংবা মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ পুরস্কার প্রাপ্তির নৈতিক তৃপ্তিটা কোথায়? ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর আচরণ পৃথিবীর মানুষগুলোকে ভাবায় না কেন? তাহলে খুব স্পষ্ট করেই বলতে পারি ইসরায়েলের আত্মরক্ষার্থে হাজারো শিশুর মৃত্যুকে আমরা মেনে নিয়েছি? মাঝেমধ্যে মনে হয় পৃথিবীর আইনের বইগুলো মিথ্যা, পৃথিবীর সকল মানবাধিকার সংস্থা এবং বড় বড় দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়কেরা প্রতিনিয়তই মিথ্যাচার করে চলছেন। এখানে জর্জ অরওয়েল এর সেই বিখ্যাত উক্তির সারমর্ম থেকে বলা যায়, ‘সব মানুষের অধিকার সমান, কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে একটু বেশি সমান।’

সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় (নভেম্বরের ২০ তারিখ পর্যন্ত), দেখা যায় গাজায় বসবাসরত মানুষের প্রায় অর্ধেক শিশু। ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় চলা বর্বরোচিত হামলায় ৭ হাজারের (গাজার সরকারের গণমাধ্যমে কার্যালয়ের হিসাব) শিশু মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। আরও প্রায় ২ হাজার শিশু নিখোঁজ। তারা বিভিন্ন ধ্বংস স্থাপনার নিচে আছে, যাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ৯ হাজার শিশু খুবই মারাত্মকভাবে আহত। কিছুদিন আগেও যে সন্তানের সামান্যতম ব্যথায় মা–বাবা সর্বদাই ছিল ব্যাকুল, আজ তাদেরই চোখের সামনে সেই সন্তানের ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া যে কতটা বেদনাদায়ক, তা কি আঁচ করা সম্ভব? যে সন্তানের শত আবদার তার মা–বাবা হাসি মুখে মেনে নেয়, আজ সেই সন্তানেরই একটু বেঁচে থাকার আবদারটুকু রক্ষা করতে পারছে না তাদের লাখো কোটি ফোটা হৃদয় নিংড়ানো চোখের জলেও। যে সন্তানদের বুকে না জড়িয়ে হয় নাই কখনো রাতের ঘুম, সেই তাদের নিজ হাতে কবরদেশে চিরনিদ্রায় শুইয়ে রাখা যে কতটা কষ্টের, তা শুধু ওই সমস্ত গাজাবাসীই অনুভব করতে পারবেন, আর বাকি পৃথিবীর কাছে হয়তো কিছু বিছিন্ন ঘটনার আবরণে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে।

জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে স্থাপন করা শরণার্থী শিবিরের তাঁবুতে বসে আছে এক ফিলিস্তিনি শিশু। খান ইউনিস, ফিলিস্তিন, ৩ ডিসেম্বর
ছবি: রয়টার্স

ইউনিসেফ–এর তথ্য মতে গাজায় ইসরায়েলে বোমায় ২০০ স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত, যা সেখানকার মোট স্কুলের প্রায় ৪২ শতাংশ। ৪২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে।

গাজায় ৩১টি হাসপালের মধ্য ২১টি কার্যত বিকল হয়ে আছে, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী হাসপাতালের মতো স্পর্শকাতর স্থাপনাতেও হামলা চালানো থেকে বিরত থাকেনি। অথচ ১৯৪৯ জেনেভা কনভেনশন অনুসারে হাসপাতাল হচ্ছে বেসামরিক প্রতিষ্ঠান, যা সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষা পায়। গাজার শিশুদের ওপর অত্যাচারের চিত্র এতটাই বিভীষিকাময় যে সেখানে আক্রমণের এক মাসের মধ্যে যে পরিমাণ শিশু হত্যা করছে ইসরায়েলি বাহিনী, যা ইউক্রেন এবং রাশিয়া সংঘাতের ১ বছরের মৃত্যু সংখ্যার ৮ গুণ বেশি এবং ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইরাক যুদ্ধে মৃতের সংখ্যাও এর থেকে অনেক কম ছিল।

পৃথিবী তুমি সত্যি আজ একটি মুখোশে আবৃত সভ্যতার চরম শিখরে, যেখানে দেশ, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ মানুষের বেঁচে থাকা কিংবা অধিকার রক্ষার মানদণ্ড তৈরি করে, এখানে প্রতিনিয়তই বিরাজ করছে সীমাহীন অসমতা। আর এর বাস্তব উদহারণ হচ্ছে গাজার শিশুরা, যাদের ওই রক্তমাখা মুখ, অশ্রুসিক্ত চোখ, কিংবা ওই নিষ্পাপ আহাজারি কোনো কিছুই পৃথিবীর ওই সভ্য ও উন্নত মানব গোষ্ঠী কারও বিবেকে এক ফোটা দাগ কাটতে পারেনি। এই পৃথিবী সত্যি গাজার ওই শিশুদের জন্য নয়, কিংবা ওরা এই পৃথিবীর কেউ নয়।

*লেখক: মেহেদী হাসান রনি, জ্যেষ্ঠ মার্চেন্ডাইজার ব্যবস্থাপক, ঢাকা