একজন রিকশাওয়ালার গল্প

প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঘুম থেকে উঠে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছিলাম। হঠাৎ ঘড়িতে নজর যেতেই চোখ আমার কপালে, ৯টা বেজে গেছে। অথচ ৯টা ৩০-এ জাকির স্যারের ক্লাস। এক মিনিটও যদি দেরি হয়, তাহলে আর ক্লাসে ঢুকতে দেবে না। তাই ঝটপট বিছানা থেকে উঠে ব্রাশ করে, মুখ ধুয়ে কোনোরকম প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

একটু হাঁটার পর জিয়া মোড়ে এসে দেখি, আমার হাতে সময় আছে মাত্র পাঁচ মিনিট। হেঁটে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এদিক-ওদিক তাকালাম, কিন্তু কোনো রিকশা চোখে পড়ল না। পাশেই এক বৃদ্ধ রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁকে পাত্তা দিলাম না। ভাবলাম, এই রিকশায় গেলে ক্লাসে আরও দেরি হয়ে যাবে।

ঠিক তখনই তিনি রিকশা নিয়ে কাছে এসে ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবা, কোথায় যাবেন?’ আমি কোনো উত্তর না দিয়ে ঘড়ি আর রাস্তার দিকে তাকাতে লাগলাম, যদি অন্য কোনো রিকশা পাই।

কিন্তু একদিকে প্রচণ্ড রোদ, অন্যদিকে সময়ের চাপে কোনো উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধের রিকশাতেই উঠলাম। বৃদ্ধের কুঁচকে যাওয়া চামড়া দেখে বুঝতে বাকি রইল না, যে বয়স তাঁর সত্তরের কোটায়। তাই ‘মামা’ না ডেকে ‘চাচা’ সম্বোধন করে বললাম, ‘মীর মোশারফ হোসেন ভবন, চাচা। একটু জোরে চালাবেন প্লিজ। ক্লাস আছে তো, দেরি হলে ক্লাসে ঢুকতে পারব না!’ চাচা হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, ‘আচ্ছা বাবা।’

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

চাচা বেশ দ্রুতগতিতেই রিকশা চালাতে শুরু করলেন, কিন্তু একটু যেতেই রিকশা মন্থরগতির হয়ে গেল! আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোনো সমস্যা, চাচা?’ চাচা কোনো উত্তর না দিয়ে রিকশা থামিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। চাচার শরীর ঘামছে আর হাত-পা থরথর করে কাঁপছে! আমি রিকশা থেকে নেমে দৌড়ে পাশের দোকান থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি এনে দিলাম। এক নিশ্বাসে তিনি পুরো পানি শেষ করে ফেললেন। এরপর পাশেই একটা গাছে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বড় বড় নিশ্বাস নিতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ পর বলে উঠলেন, ‘বয়স হয়েছো তো বাবা! জোরে চালাতে গেলে বুকে ব্যথা ওঠে। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই। দেরি করে ফেললাম তোমার।’ আমি বললাম, ‘আপনাকে আর উঠতে হবে না চাচা, আপনি বিশ্রাম নিন। এমনি দেরি হয়ে গেছে, আজ আর ক্লাসে যেতেও ইচ্ছা করছে না।’ চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘সে কী কথা? ক্লাসে যাবে না কেন?’ আমি বললাম, ‘এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না, আপনি আগে বিশ্রাম নিন!’ চাচা বিষণ্ন মুখে বললেন, ‘আমার জন্য আজকে তোমার ক্লাস যাওয়া হলো না!’

আমি তাঁর শেষ কথাটা এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সকালে কিছু খেয়েছেন, চাচা?’ চাচা মাথা নিচু করে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘না বাবা। ইনকাম যা হয়, তা দিয়ে দুই বেলা ভাত জোটে না আবার নাশতা!’ আমি দোকান থেকে একটা রুটি আর একটা কলা এনে তাঁর হাতে দিলাম। প্রথমে তিনি নিতে চাচ্ছিলেন না, আমি বললাম, ‘নিন তো চাচা। এমনি আপনার শরীর খারাপ, তার ওপর সকাল থেকে কিছুই খাননি। এখন না খেলে শরীর আরও খারাপ করবে!’ আমার জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত তিনি আর না করতে পারলেন না।

ব্যাগটা পাশে রেখে আমিও গাছের নিচে বসলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাসায় আপনার কে কে আছেন, চাচা?’ চাচা খেতে খেতে উত্তর দিলেন, ‘দুই ছেলে, এক মেয়ে আর তোমার চাচি।’ আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ছেলেরা কী করে?’ তিনি বললেন, ‘দুই ছেলেই রিকশা চালায়। দেশে সবকিছুর দাম যে হারে বাড়ছে, নিজেরাই ঠিকমতো চলতে পারে না! বাবাকে কী সাহায্য করবে?’ এরপর একটু থেমে মলিন মুখে বললেন, ‘মেয়ের বিয়ে দিছিলাম, কিন্তু সে সংসার বেশি দিন টেকেনি! দুই সন্তান নিয়ে মেয়ে এখন আমার কাছেই থাকে। জামাই ভালা মানুষ ছিল না। নেশা করত, মেয়েকে মারধর করত!’
চাচার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কত বছর ধরে তিনি এই পেশায় আছেন?’ চাচা বললেন, ‘তা প্রায় ২০ বছর তো হবেই। ভাটি অঞ্চলে আমাদের বাড়ি ছিল। এক বন্যায় সবকিছু ভেসে যায়। বাধ্য হয়ে শহরে এসে আশ্রয় নিই। দেশে সরকার আসে–যায়, কিন্তু আমাদের খোঁজ কেউ নেয় না, বাবা।’

চাচার কথা শুনে ভাবলাম, আসলেই তো, যাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তাঁরাই যেন সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।

তখন চাচাকে বললাম, ‘আমার একটা অনুরোধ আছে, আপনি না করতে পারবেন না!’ তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘কী অনুরোধ, বাবা।’ আমি বললাম, ‘আজকে আমি রিকশা চালাব। আপনি পেছনে বসবেন।’ চাচা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘না! না! বাবা, তা কী করে হয়। লোকে দেখলে তোমাকে পাগল বলবে!’ আমি হেসে উত্তর দিলাম, ‘আপনি উঠুন তো, লোকে কী বলবে, সেটা আমি দেখব। চলেন আপনাকে মেডিকেলে নিয়ে যাই।’

রিকশার হাতল ধরে মনে হচ্ছিল, আজ আমি শুধু একটি রিকশা চালাচ্ছি না, বহন করছি এই শহরের অবহেলিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, ক্লান্তি আর নীরব কষ্ট।

  • লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়