সীমন্তিনী

আমাদের বাড়িটা চারতলা। আমরা দোতলায় থাকি। বাকি তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া। বাবার পেনশনের টাকায় আমাদের সংসার চলে। ফ্ল্যাট ভাড়া থেকেও প্রতি মাসে বেশ কিছু টাকা আসে। যার একটি অংশ বাবার ওষুধ ও হাতখরচের জন্য এবং একটি অংশ মায়ের নামে ব্যাংকে বাবা সঞ্চয় করেন। আর বাকি টাকা থেকে আমাকে ৫ হাজার এবং বোনকে ১২ হাজার টাকা পাঠান। বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজিতে পড়ে। আর আমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছি। সবকিছু নিয়মমতোই চলছিল। বিসিএস, বাংলাদেশ ব্যাংকের এডিসহ বেশ কয়েকটি চাকরির পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছিলাম আমি।

অপেক্ষা কেবল ভাইভার। কিন্তু করোনার বিস্তার রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা হওয়ার পর চাকরির পরীক্ষা, ভাইভা সবই স্থগিত হলো। বোনের সঙ্গে আমিও বাড়িতে চলে এলাম। বাবা, নিশ্চিন্ত হলেন। ‘অচেনা রোগ, চারপাশে উৎকণ্ঠা-হাহাকার। মরতে হলে সবাই একসঙ্গে মরব। আর বাঁচলে একসঙ্গেই বাঁচব। চাকরি একদিন না একদিন ঠিকই জোগাড় হবে। বাড়িতে বসেও যথেষ্ট ভালো প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব। বাড়ি থেকেই সময়টা কাজে লাগাও।’ বললেন বাবা।

 সারা দিন অতলান্ত অবসর। পড়ালেখা, গল্পের বই, উপন্যাস পড়ে সময় আর কাটছে না। বাবা পরিচিত কাঠমিস্ত্রি দিয়ে একটা ক্যারম বোর্ড তৈরি করে আনলেন। খারাপ সময়টা হইহুল্লোড় ও খেলাধুলার মধ্য দিয়ে কাটতে লাগল আমাদের।

তেমনি একদিন, বিকেলের নাশতা শেষ করে ক্যারম খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা। কলবেল বেজে উঠল। সিসিটিভিতে দেখলাম, চারতলার কাকিমা এসেছেন। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে দরজা খুললাম আমি। কাকিমার চোখে জল, কাকিমা চাপা স্বরে কাঁদছেন। বললাম—
কী হয়েছে কাকিমা, কাঁদবেন না! কী হয়েছে বলেন?

—তোমার কাকুর কয়েক দিন ধরে খুব জ্বর। করোনা টেস্ট করিয়েছিলাম, রিপোর্ট এখনো আসেনি। কিন্তু ও মোটেই ভালো নেই। আজকে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কী করব, কোথায় যাব—কিছুই তো মাথায় আসছে না! এর মধ্যে সিমুর শরীরটাও ভালো না, ওরও জ্বর এসেছে।

সিমু নামটা শুনতেই বুকের ভেতরটা একনদী জলে ভরে উঠল। এই মেয়েটির জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগটা হাসিমুখে ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। বরণ না করে সৌভাগ্যকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিদানে আমাকে সমুদ্রসম অপমান ও প্রত্যাখ্যান দিয়েছিল সিমু। আমার কি আজ শোধ নেওয়া উচিত, কাকিমাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত? জটিল হিসাব–নিকাশের মতো স্থিরচিত্তে ভাবছি আমি। বাবা পেছন থেকে চিৎকার করে উঠলেন। ‘খোকা, দাঁড়িয়ে আছিস যে, দ্রুত যা। কাকুর অক্সিজেন লেভেল কত দেখ, সেই হিসাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

পৃথিবীতে বাবাই একমাত্র মানুষ, যে একই সঙ্গে আমার বন্ধু ও অভিভাবক। বাবা, আমার কাছে আকাশের মতো বিশাল, নদীর মতো স্নিগ্ধ। ছোট থেকে আজ পর্যন্ত কোনো দিন বাবাকে স্বার্থপর চিন্তা করতে দেখিনি। আমার কোনো বন্ধু ছিল না কখনো, আজও নেই। বাবাই আমার একমাত্র বন্ধু, সোনালি অহংকার। আমার জীবনে এমন একটিও ঘটনা নেই, যা বাবাকে বলিনি আমি। বাবা আমাকে সীমাহীন স্বাধীনতা দিয়েছেন। কখনো কোনো কিছুর জন্য জোর করেননি, চাপিয়ে দেননি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর, সিমুর কাছাকাছি থাকতে পারব, এ আশা নিয়ে বাবাকে যখন বললাম, ‘বাবা, ইন্টারমিডিয়েট সিটি কলেজে পড়বে সিমু। আমি খুলনাতেই থাকি, মেডিকেল পড়ব না।’ বিনা বাক্য ব্যয়ে সেদিন আমার আবদার মেনে নিয়েছিলেন বাবা। বলেছিলেন, ‘গোলাপ যেখানেই থাকুক সৌরভ ছড়াবে। সৌরভ ছড়ানোর জন্যই তার জন্ম। যোগ্য লোক ও গোলাপ তাই সমার্থক। আর এই একটিমাত্র কারণেই পৃথিবীতে যোগ্য লোকের এত কদর। মন যা চাই, তাই করো। নিজেকে যোগ্য করে তোলো। আমি মাকে সামলে নেব।’

পরিচিত চিকিৎসকদের সহযোগিতায় অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই কাকুর চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো। অক্সিজেন লেভেল ও শ্বাসপ্রশ্বাসের হার স্বাভাবিক হলে নিশ্চিন্ত হলাম আমরা। কিন্তু বিপত্তি বাধল সিমুকে নিয়ে, ওর শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। ওকে কষ্ট পেতে দেখে সব অভিমান কোথায় যেন হারিয়ে গেল। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে ওর কাছে গিয়ে গভীর আর্তনাদে ভেঙে পড়লাম আমি।

দিন ১৫ পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো। আমরা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এলাম। মা-বাবা ও বোন জড়িয়ে ধরল আমাকে। পরিবার মন্দিরসম শুনেছিলাম, ওই দিনই প্রথম অনুভব করলাম। এক অসীম ভালো লাগায় পুরো শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। আমার ভাবনার আকাশে উঁকি দিল কিছু পুরোনো প্রশ্ন। ‘জীবন কী বিচিত্রকর, মন কী ভয়ানক রকমের প্রতারক। মুহূর্তে বদলে নেয় সিদ্ধান্ত।’ মায়ের ড্রয়ার খোলার শব্দে স্বাভাবিক হলাম। ওয়ার্ডরোবে কাপড় গুছিয়ে রেখে মা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন—

খোকা, একটা কথা বললে রাখবি? আমার কথা তো কোনো দিন শুনলি না। যদি বলিস রাখবি, তাহলেই শুধু বলব। এমনি এমনি বলব না।
—এভাবে কেন বলছ, মা! বলো, কী বলবে।


—সিমুর মা এসেছিলেন। সিমুর বাবা এ বছর রিটায়ারমেন্টে যাচ্ছেন। তার আগেই সিমুর বিয়েটা সেরে ফেলতে চান। তোকে খুব পছন্দ ওদের। আর আমারও সিমুকে তোর জন্য খুব পছন্দ। তোর বাবাকে এখনো কিছু জানায়নি আমি। তুই কথা দিলে বলব।
—তোমার বেকার ছেলেকে মেডিকেল পড়ুয়া মেয়ের জন্য ওঁদের কেন পছন্দ মা? বিপদের দিনে নিজেদের কথা না ভেবে পাশে দাঁড়িয়েছিলাম বলে।
—বাপের মতো যুক্তি-তর্ক দিস নে খোকা। ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বল।

—‘না’ বললে তুমি কি খুব কষ্ট পাবে মা?
—ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নটা তো পূরণ করলি না। ভর্তি হয়েও, বাপ-বেটা যুক্তি করে ভর্তি বাতিল করে এলি। জীবনে কী পেলাম বল! সারাটা জীবন দাসীর মতো কেবল তোদের জন্য খেটেই মরলাম। তোরা আমার কথা কেউ ভাবলি না। এক ফোঁটাও গুরুত্ব দিলি না কেউ আমারে।

—এ জন্য বুঝি ডাক্তার বউ-মা চাও!
— কথা পেঁচাস না খোকা। তোর পছন্দের কেউ থাকলে বল। আমি তোকে জোর করব না। আর না থাকলে সিমুকেই বিয়ে করতে হবে।

নির্নিমেষ চোখে মায়ের দিকে চেয়ে রইলাম আমি। কিছু বললাম না।
তোর জন্য সিমুকে আমার ভীষণ পছন্দ। তুই আমার কথাটা রাখ খোকা। সিমুকে বিয়ে করায় মত দে। তোর বাবার সঙ্গে কথা বলে ওদের জানিয়ে দিই আমি।
‘তুমি যা চাও, তাই হবে মা।’ বললাম আমি।

—মাথায় হাত রেখে বল। নইলে বাপ-ছেলেতে যুক্তি করে শেষে সব ভেস্তে দিবি। ওদের কাছে আমি আর মুখ দেখাতে পারব না। তোদের মোটেই বিশ্বাস করি না আমি।
বিয়ে প্রসঙ্গে বাবার সঙ্গে খুব সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা হলো আমার। বাবা সিমুকে বিয়ে করতে নিষেধ করলেন আমাকে। বললেন, ‘একপক্ষীয় কোনো কিছুই বেশি দিন টেকে না খোকা। তোর এত বড় ক্ষতি কী করে মেনে নিই বল! আমি খবর নিয়েছি, সিমুর একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। ছেলেটা ওর ব্যাচমেট, ওরা একসঙ্গে মেডিকেল কলেজে পড়ে। তোর মাকে বললে কোনোমতেই বিশ্বাস করবে না সে। ছোট থেকেই সিমুকে চেনে, সিমুর প্রতি ওর দারুণ বিশ্বাস। ভাববে, পরিচিতর মধ্যে বিয়ে দিতে চাই না বলে আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি। তুই সীমন্তিনীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধিস না খোকা। আমার কথা শোন…’

যে মানুষটা পৃথিবীর আলো দেখাল আমাকে, মুখে ভাত তুলে দিল। সেই মমতাময়ী মায়ের জন্য কিছুটা কষ্ট সয়ে নিতে পারব। এই চিন্তা থেকেই বাবাকে উত্তরে কিছু বললাম না। শুকনা মুখে আমার পাশ থেকে উঠে গেলেন বাবা। আমাকে ভুল বুঝলেন। ভাবলেন, গোপন ভালোবাসার কাছে আমি পরাজিত। তাঁর দেওয়া শিক্ষা, দর্শন মিথ্যা আমার জীবনে। আমাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ তাঁর। আমি মানুষ হতে পারিনি।

সিমুর সঙ্গে যা কথা হওয়ার তা হলো বিয়ের পর। বাবার সোর্স মিথ্যা খবর দেয়নি বাবাকে। তমল নামের একটি ছেলেকে সিমু ভালোবাসে। বিয়ের আগে কাকু-কাকিমাকে তমলের কথা জানিয়েছিল সিমু। কিন্তু তমলের পরিবার রক্ষণশীল। ভালোবাসা-প্রেমে দারুণ অ্যালার্জি বয়োজ্যেষ্ঠদের। তা ছাড়া সিমুর সঙ্গে তমলের গোত্রের ব্যবধানও অনেকটা। তমলের পরিবার কোনোমতেই সিমুকে মেনে নেবে না। যে কারণে সিমুর কিছু করার ছিল না। অনেকটা বাধ্য হয়েই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল সিমু।
এসব কথা কাউকে বলিনি আমি, কেউ জানে না। আজও আমার প্রতি বাবার গভীর অসন্তোষ। বাবার অভিমান এখনো কমেনি। মাকেও এসবের কিছুই বুঝতে দিইনি আমি। মা সিমু–অন্তঃপ্রাণ। জানতে পারলে খুবই কষ্ট পাবেন। সিমুও আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। আমার বই, চেয়ার-টেবিল যত্ন করে গুছিয়ে রাখে ও।

তমলের প্রতি এখনো ওর ভীষণ অভিমান। চোরের মতো সিমুর ডায়েরি পড়ে জেনেছি। এক পাতায় আমার সম্পর্কেও দুই কলম লিখেছে সিমু। ‘শুভ, মানুষটা খারাপ না। আমি ওকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই পারছি না। ওর কথা চিন্তা করতে গেলেই তমলের কথা মনে পড়ে। ঈশ্বর আমাকে শক্তি দাও।’ সিমুর প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। সিমুকে আগের মতোই ভালোবাসি আমি। আসলে ভালোবাসা যাকে খায়, এভাবেই খায়। নিয়তির কাছে জমা আছে জীবনের সব জয়–পরাজয়।