দেশের ইতিহাসে প্রথম উচ্চকক্ষ, কেমন হবে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা?

জাতীয় সংসদ ভবনফাইল ছবি

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছর ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইতিমধ্যেই এ ঘোষণা দিয়েছেন। আসন্ন সংসদ নির্বাচনের দিনে জুলাই সনদের আলোকে গণভোটও হবে। জুলাই সনদের প্রস্তাবিত সুপারিশসমূহের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, যেখানে থাকবে নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন ৩০০ আসনের সংসদ সদস্যরা। এই ৩০০ জন সদস্য বসবেন জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষে। জনগণ ভোট দিয়ে নিম্নকক্ষে যেমন সব সময়ের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচন করবেন, তেমনি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটদানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষেও আসন নির্ধারিত হবে। যে দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, ঠিক ততটি আসনই উচ্চকক্ষে নির্ধারিত হবে সেই দলের জন্য। মূল কথা, কোনো দলকে ন্যূনতম ১ শতাংশ ভোট পেতে হবে উচ্চকক্ষে অন্তত ১টি আসন পেতে।

উচ্চকক্ষের কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলো উচ্চকক্ষে আসন পেয়ে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে যেমন জনগণের বিশ্বস্ত দলগুলোই উচ্চকক্ষে আসন পাবে, তেমনি দলগুলোর প্রতিও জনগণের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তা ছাড়া উচ্চকক্ষে বসতে সব রাজনৈতিক দলসমূহের ম্যান্ডেট জনগণের স্বার্থকেন্দ্রিক হবে বলে আশা করা যায়। আবার উচ্চকক্ষে সরকারি দলের ওপর বিরোধী দল ও অন্য দলসমূহের চাপ বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। এ ছাড়া কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনে উচ্চকক্ষের ভূমিকাও ইতিবাচক হতে পারে বলে মনে করেন কিছু বিশ্লেষক।

জুলাই সনদে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশসমূহে দেখা যায়, উচ্চকক্ষের নিজস্ব কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু অর্থবিল বাদে সংসদে উত্থাপিত সব বিল উচ্চকক্ষে পাঠাতে হবে। উচ্চকক্ষ ওই বিলগুলো পর্যালোচনা করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেগুলো অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। তবে উচ্চকক্ষ কোনো বিল প্রত্যাখ্যান করে তা পুনর্বিবেচনার জন্য নিম্নকক্ষে পুনরায় পাঠাতে পারবে। অবশ্য উচ্চকক্ষের প্রস্তাবিত সংশোধনসমূহ সম্পূর্ণ বা আংশিক অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে নিম্নকক্ষ। তা ছাড়া নিম্নকক্ষে পরপর দুইটি সংসদ অধিবেশনে পাসকৃত বিল যদি উচ্চকক্ষ প্রত্যাখ্যান করে এবং নিম্নকক্ষ যদি পুনরায় পরবর্তী অধিবেশনে পাস করে, তাহলে উচ্চকক্ষের অনুমোদন ছাড়াই বিলটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। তাই সাধারণ বিলে উচ্চকক্ষের অনুমতি বা প্রভাব তেমন একটা নেই বললেই চলে। কিন্তু জুলাই সনদের সুপারিশ অনুযায়ী, সংবিধান সংশোধন করতে অবশ্যই উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠদের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।

যদিও উচ্চকক্ষের বেশ কিছু কার্যকারিতা রয়েছে, তবুও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চকক্ষের গঠন নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যায়। নিম্নকক্ষে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত দলসমূহের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন হওয়ার ঘোষণা হয়েছে জুলাই সনদে। সচরাচর বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষে নিজেদের মনোনীত প্রার্থীদের তালিকা দিয়ে থাকে রাজনৈতিক দলসমূহ। এই প্রচলিত পদ্ধতির অনুসরণ বাংলাদেশেও হবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে এসব দেশের প্রচলিত পদ্ধতিতে দেখা যায়, উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে ভিন্ন ভিন্ন প্রার্থী থাকেন নির্বাচিত দলসমূহের। অর্থাৎ নিম্নকক্ষের সদস্য যেমন উচ্চকক্ষে যেতে পারেন না, তেমনি উচ্চকক্ষের সদস্য নিম্নকক্ষে আসতে পারবেন না। মোট কথা, একজন প্রার্থী কখনোই নিম্ন ও উচ্চ উভয় কক্ষের সদস্য হতে পারেন না। যেমন জার্মানি, নেপাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্কসহ বেশ কিছু দেশে এমন পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

এখন কৌতূহল থেকে অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, আমাদের সংসদের উচ্চকক্ষে তাহলে কারা বসতে যাচ্ছেন? এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখতে পারেন, আমাদের দেশের বড়-ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় সব শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এঁদের মধ্যে অধিকাংশ নেতাই নির্বাচিত হওয়ার বেশ জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে, যা তাঁদের নিম্নকক্ষে আসন নিশ্চিত করে দেবে। তাই দলগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ যদি নিম্নকক্ষেই বসেন, তাহলে উচ্চকক্ষে বসবেন কারা? যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী কেউ নিম্ন ও উচ্চ উভয় কক্ষের সদস্য একসঙ্গে হতে পারবেন না। সেহেতু এই প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে আসন্ন নির্বাচনে দলগুলোর অধিকাংশ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ নির্বাচিত হয়ে নিম্নকক্ষে বসতে যাচ্ছেন বলে একপ্রকার ধারণা করাই যায়। এখন উচ্চকক্ষে দলগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ না বসে দলগুলোর মনোনীত অন্য নেতারা বসলে জনগণ এটাকে কীভাবে নেন, সেটাও প্রশ্ন থেকে যায়। আর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত পদ্ধতির উচ্চকক্ষে দলগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দকেই বেশির ভাগ সময়ে দেখা যায়। তাই আমাদের দেশের সংসদে উচ্চকক্ষে দলগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ না থাকলে উচ্চকক্ষ ঠিকভাবে কার্যকর থাকবে কি না, সে ব্যাপারেও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়া জুলাই সনদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, সাধারণ বিলগুলোতে উচ্চকক্ষের প্রভাব কম হলেও সংবিধান সংশোধন করতে উচ্চকক্ষেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা থাকবে। সে জন্য উচ্চকক্ষে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলসমূহের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের থাকার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করা যায়।

অবশ্য দেশগুলোর প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে, নির্বাচিত দলসমূহের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ চাইলে নিম্নকক্ষের আসন ছেড়ে দিয়ে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মনোনীত হয়ে উচ্চকক্ষে যাওয়ারও এখতিয়ার রাখে। সে ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষের আসন ছেড়ে দিলে সেই আসনে পুনরায় উপনির্বাচন হতে হবে। যদিও তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং কিছু জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে সংসদকে কার্যকর রাখতে। পরিশেষে বলা যায়, দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন হতে পারে আসন্ন নির্বাচনের পর। উচ্চকক্ষের বেশ উপকারিতা থাকলেও এখন উচ্চকক্ষের গঠন কীভাবে হবে, সেটা প্রাধান্য পাওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষ গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিষ্কার রোডম্যাপ দেওয়া উচিত। আশা করা যায়, সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে এ ব্যাপারে।

*লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়