প্রজাপতি
বাহারি রঙের ফুল ফুটেছে, হালকা বাতাস বইছে, বাতাসে যেন ফুলগুলো দোল খাচ্ছে। চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে ফুলের রেণু। কিছু প্রাণী আসে ফুলে বসে, মধু আহরণ করে, চলে যায়। নিজের শুঙ্গ দিয়ে ফুলের রস সব শোষণ করে নিচ্ছে। আকাশটাও রৌদ্রের চাকচিক্য ঘিরে রেখেছে, সূর্য মনে হয় আজ অনেক খুশি। একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভেসে যায় ......**।
আজ সকালটা খুব তাজা লাগছে। চারদিকে আবহাওয়া বেশ শান্ত। ভালোই লাগছে। জানালা খুলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কী বাতাস! ঘর গোছানো শুরু। খাট ঝাড়লাম, ফার্নিচারের ওপর লাগা ধুলা ঝাড়লাম। ধুলা এমনভাবে বসে যেন বহুদিন ধরে ঝাড়া হয়নি। প্রতিদিনের কাজ। যা–ই হোক, ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে একজনকে খুঁজছি কোথায় সে? কাল থেকে দেখি নাই। ও মা! কোন এক কোনায় পড়ে আছে নাকি? হ্যাঁ, তা–ই তো। কোনার আসবাব সরিয়ে তাকে ওঠালাম। প্রথমে, তাকে কতক্ষণ নাড়লাম-চাড়লাম।
কোনো সাড়া নেই। আমার ওই কোনে, পাশেই একটা বড় জানালা আছে, সেদিকে লক্ষ করলাম, আমি টের পেয়ে যাই। টের পাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে অনেক খারাপ লাগল। ঘটনা জন্য কি আমি দায়ী? আমার আজও ঐদিনের কথা মনে আছে, গোধূলি বেলায় আমি ঐ জানালার পাশে উকি দিই, জানালা কাজ বন্ধ ছিল। হঠাৎ জানালার গ্রিলটাতে এক ছোট্ট ক্ষুদ্র প্রাণী বসে আছে। আমি তাকে ভেতরে নেব, তা প্রথমে ভাবি নি, স্বল্পক্ষণে আমার নজর কাড়ে আর একটি প্রাণী। ওই প্রাণীটির থেকে এটি একটু বড় আকৃতির, শুধু আকৃতির বললে ভুল হবে আসলে ভিন্ন এক ধরনের। ভিন্ন প্রাণী। এই প্রাণীটির সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে কীটপতঙ্গ। কীট দেখলেই সহ্য করতে পারে না। মুহূর্তে দেখলাম এই প্রাণীটির ঐ ক্ষুদ্র প্রাণীর দিকে ধেয়ে আসার সুযোগ বেশি। আমার মনে হলো এইটাকে রক্ষা করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আমি তাকে জানালা খুলে তার দেহে হালকা ছুঁয়ে দিতেই সে উড়ে আমার ঘরে চলে আসে আর আমি তখনি কাচ বন্ধ করে দিই। সে পুরোটা ঘর উড়তে থাকে। ভাগ্যিস পাখা বন্ধ ছিল। তার বিশাল পাখা মেলে উড়তেই থাকে। কিছুক্ষণের জন্য মনে হয় আমার ঘরটা বাগান, ছোট্ট বাগান। যদিও ফুল নেই, কিন্তু তার ওড়াটা আমাকে বাগানের অনুভূতি দিচ্ছে। কি সুন্দর বাগান! চারদিকে নানা রঙের ফুল আর ফুল। বাতাসে পাপড়ি দুলছে তো দুলছে। কি সুবাস! মৌমাছি এসে বসেছে, আহা! উড়তে উড়তে দেয়ালের এক কোনে বসে রইল। দিন যায়, রাত যায়—সে আমার ঘরের এক অতিথি। অনেকদিন সে এখানে থাকছে। আমি বহুবার তাকে হাতের নরম তলায় রাখবার ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম, কিন্তু যতবার তাকে ছুঁই ততবার সে ভয়ে পালিয়ে উড়ে অন্য কোনায় বসে। আমি তাকে আর বিরক্ত করলাম না।
আজ অনেক দিন হলো দেখি না। এভাবে তো সারা ঘর উড়ে উড়ে বেড়ায়। তার জন্য সিলিংয়ের পাখা বন্ধ থাকে, না হয় গতি কমিয়ে দিতে হয়। কিন্তু আজ সকালে উঠে তাকে দেখতে পাই। এভাবে পড়ে আছে কেন? এতদিন খুঁজেছিলাম, প্রথমে ভেবেছিলাম বোধ হয় চলে গিয়েছে। এখন দেখি না চলে যায়নি। এখানেই এতদিন ছিল, তাও এই অন্ধকার চিপার মধ্যে? এভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে, উড়ছেও না। আমার ঠিক মনে আছে, তাকে যতবার উড়তে দেখতাম, সে ঐ জানালার পাশে গিয়ে বসে থাকত বা ঘুরঘুর করত। হয়তো বের হতে চাইত। কিন্তু আমি তো তাকে বেঁধে রাখি নাই। এক পথ বন্ধ ছিল আর পথ তো খোলা ছিল। আমার দক্ষিণ পাশের জানালা ঠিক খুলে রেখেছিলাম যাতে সে স্বাচ্ছন্দ্যে উড়ে যেতে পারে। এমনকি তার এই ভঙ্গি দেখে ঐ জানালার পাশে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাই না কত করলাম। আসলে আমি সেই জানালা তো তার জন্যই খুলি নি। ঐ লেজওয়ালা প্রাণী ঐখানেই বসে থাকে। তার জন্য ও জানালাটা নিরাপদ নয়। তাই ...। ও ঠিক ঐ জানালার পাশে চিপায় পড়ে আছে। তাকে হাতে নিলাম। আমি এত কাছ থেকে এই প্রাণীটিকে কখনও দেখিনি। সব সময় উড়তে দেখেছি। আজ হাতে নিলাম। তবে সে জীবিত নয়, মৃত। আমার তাকে হাতে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল, তবে জীবিত। সে আমার হাতে উড়ে এসে বসবে আবার উড়ে চলেও যাবে। কিন্তু তা হলো কোথায়? সে তো নড়ছেও না উড়বে তো দূরের কথা।
তার পাখনার পিঠের ওপরের অংশটা গাঢ় বাদামি রঙের। তার মধ্যে ছটা ছিটিয়ে আছে। পাখনা দুই পাশের কোণায় একটু আগে সোনালি আর কালো বৃত্তাকারের মিশ্রণ। প্রাণীটির গায়ে লোমযুক্ত। কিনারায় কালো লাইন করে দাগ। আর সামনের বক্ষাংশতে হালকা বাদামি বা হলুদও বলতে পারা যায়। সেখানে সব কালো বৃত্তাকার আর রূপালি রঙ ছিটানো। কী চকচকে, ঝলমলে! মাথায় দুটি গোলাকার বলের মতো চোখ। বিজ্ঞানের ভাষায় পুঞ্জাক্ষি। তার ওপর দুটো অ্যান্টেনার মতো আছে। তার একটি সরু শৃঙ্গ আছে। চারটি পা। দেহ কিন্তু বড় নয়। সাধারণ কীটদের মতোই তবে তার বিশাল পাখনাটা তাকে আকৃষ্ট করে। এটাই তার সৌন্দর্যের প্রধান বাহন। এত বড় পাখা নিয়ে এই ছোট্ট দেহ পুরো ভ্রাম্য ঘুরে বেড়ায় আর চারদিকে ছড়িয়ে দেয় তার সৌন্দর্য। কিন্তু এখন এই প্রাণীটি আর পাখনা মেলে ঘরজুড়ে উড়বেও না। প্রাণীটি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
‘আচ্ছা, প্রাণীটির নাম কী?’
‘প্রজাপতি।’