পরিবেশবান্ধব পর্যটন ও অর্থনীতিতে প্রজাপতি

সাদা বুনো ফুলের ওপর বসে আছে প্রজাপতিছবি: মংহাইসিং মারমা

কুয়াশা কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে জঙ্গলে ঢুকছে সোনারোদ। আর রোদের সঙ্গে মিল রেখে পাখিদের কলকাকলি বেড়ে যাচ্ছে সবুজ প্রকৃতিতে, আস্তে আস্তে ছরার ঠান্ডা পানিতে হাঁটা শুরু করলাম। মৌলভীবাজারের রাজকান্দী বন, আসলেই জীববৈচিত্র্যের রাজকীয় এক রূপ। এখানে হাজারো বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় জীববৈচিত্র্যের অপূর্ব সমাহার। যার মধ্যে অন্যতম বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি। সময় যত বাড়ছে, সূর্যের আলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রজাপতিরা তাদের রংবাহারি রূপ আর বর্ণচ্ছটার পসরা নিয়ে বসছে পুরো জঙ্গলের সবুজের মধ্যে। নান্দনিকতার এক অপূর্ব উপকরণ এই প্রজাপতি।

লেপিডোপ্টেরা বর্গের অন্তর্গত প্রজাপতি হলো রঙিন ও ডানাওয়ালা পতঙ্গ, যা বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলে, বিশেষত উষ্ণ ও উপ–উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় এদের বিস্তৃতি রয়েছে। এরা ফুলের মধু খেয়ে পরাগায়ণে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, ঠিক তেমনি প্রজাপতি পরিবেশের স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ছাড়া সৌন্দর্য ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও প্রজাপতির গুরুত্ব অনেক। আর সমসাময়িক সময়ে পরিবেশবান্ধব পর্যটনে প্রাণীটি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

প্রজাপতি অর্থনৈতিকভাবে বহুমাত্রিক মূল্য বহন করে, যা পর্যটন, কৃষি, শিক্ষা, সংরক্ষণ ও প্রযুক্তি খাতে সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে অবদান রাখে এবং এর পরিমাণগত মূল্যায়ন করলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।

পরিবেশবান্ধব পর্যটন বা ইকোট্যুরিজমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ এরা শুধু আকর্ষণীয় অমেরুদণ্ডী প্রাণীই নয়; বরং পরিবেশগত সুস্থতার জৈবসূচক হিসেবেও বিবেচিত হয় এবং প্রকৃতিপ্রেমী, গবেষক ও ফটোগ্রাফারদের আকৃষ্ট করে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখে।

বৈশ্বিকভাবে প্রজাপতি পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমে প্রায় ৫ কোটির বেশি মানুষ জড়িত, যা ভ্রমণ, আবাসন, গাইডিং এবং সংশ্লিষ্ট খাতে বছরে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কোস্টারিকায় ইকোট্যুরিজম আয়ের প্রায় ১২ শতাংশ সরাসরি প্রজাপতি উদ্যান ও সংরক্ষণকেন্দ্র থেকে আসে, আবার ভারতে সিকিম ও আসামের মতো রাজ্যগুলোতে প্রতিবছর প্রজাপতি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা হাজারো দেশি-বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করে এবং শুধু এই কার্যক্রম থেকেই বছরে গড়ে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব সৃষ্টি হয়, যার সঙ্গে যুক্ত থাকে প্রবেশমূল্য, ইকো-লজ, স্থানীয় হস্তশিল্প এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক গাইড সেবা।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে বৃহৎ আকারের প্রজাপতি উদ্যান ও শিক্ষামূলক পার্ক তৈরি হয়েছে, যেখানে বছরে প্রায় ৫ লাখ দর্শনার্থী ভ্রমণ করেন এবং টিকিট বিক্রয় ও রপ্তানির মাধ্যমে কয়েক মিলিয়ন ডলার আয় হয়।

বাংলাদেশে যদিও প্রজাপতিভিত্তিক পর্যটন এখনো বিকাশমান, তবু এখানে নথিভুক্ত প্রজাতির সংখ্যা ৪০০–এর বেশি, যার মধ্যে বিরল ও স্থানীয় প্রজাতিও রয়েছে, আর মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক, রাজকান্দী, আদমপুর রিজার্ভ ফরেস্ট, সাতছড়ি, খাদিমনগর ও লাওয়াছড়া, কাপ্তাই, জাতীয় উদ্যানের মতো জায়গাগুলোতে প্রজাপতি দর্শনার্থীদের আকর্ষণ বাড়াচ্ছে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত—যেমন গাইড সার্ভিস, হোমস্টে ও হস্তশিল্প বিক্রি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজাপতিকেন্দ্রিক ইকোট্যুরিজম উন্নয়নশীল দেশে স্থানীয় সম্প্রদায়ের আয় ২০–২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে, বিশেষ করে যখন এটি সংরক্ষণ শিক্ষা ও টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হয়। বাংলাদেশে এখনো প্রজাপতি এবং ইকোট্যুরিজম বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে না। মেগাফনার পাশাপাশি এই ছোট প্রাণিটির গুরুত্ব জাতীয়ভাবে উপেক্ষিত। তবে জাতীয়ভাবে গুরুত্ব দিলে প্রাণিটি ইকোট্যুরিজমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]

কৃষি খাতে প্রজাপতি এক অপরিহার্য পরাগায়নকারী হিসেবে কাজ করে, যেখানে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ২০১৯) অনুযায়ী পতঙ্গ পরাগায়নকারীরা বিশ্ব কৃষিতে বছরে ২৩৫ বিলিয়ন থেকে ৫৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবদান রাখে এবং এর মধ্যে প্রজাপতির অবদান ৫ থেকে ৭ শতাংশ; অর্থাৎ বছরে আনুমানিক ১২ থেকে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ফল, শাকসবজি এবং বুনো উদ্ভিদ উৎপাদনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি প্রজাপতির পাখার ন্যানো কাঠামো ব্যবহার করে জীবপ্রযুক্তি ও উপাদান বিজ্ঞানে নতুন উদ্ভাবন হচ্ছে, যার বাজারমূল্য বহু মিলিয়ন ডলার, যেমন নকল প্রতিরোধী মুদ্রা নকশা থেকে শুরু করে চিকিৎসাপ্রযুক্তি পর্যন্ত।

গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার মতো অঞ্চলে প্রজাপতিভিত্তিক পরিবেশবান্ধব পর্যটন স্থানীয় পরিবারের আয় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সক্ষম। যেমন পাপুয়া নিউগিনিতে প্রজাপতি চাষ একজন কৃষককে বছরে ৩০০ থেকে ৫০০ ডলার অতিরিক্ত আয় প্রদান করে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। আবার আফ্রিকার কেনিয়া ও তানজানিয়ায় প্রজাপতি পিউপা রপ্তানি থেকে বছরে আনুমানিক ১ থেকে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয় এবং হাজার হাজার পরিবার সরাসরি উপকৃত হয়।

বাংলাদেশে যদিও প্রজাপতি পর্যটন এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এখানে তিন শতাধিক প্রজাতি লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং লাওয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুণ্ড পরিবেশবান্ধব উদ্যান ও সাতছড়ি বনে প্রজাপতি পর্যবেক্ষণ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে, যা থেকে বর্তমানে আনুমানিক শূন্য দশমিক ২ থেকে শূন্য দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয় এবং সঠিক বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে এক দশকের মধ্যে এই আয় ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এ ছাড়া প্রজাপতি জীববৈচিত্র্যের সূচক হিসেবে কাজ করে, যা দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দ্রুত শনাক্ত করতে সহায়তা করে এবং এর ফলে পরিবেশ পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যয়িত কোটি কোটি ডলার সাশ্রয় হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘর, উদ্ভিদ উদ্যান ও চিড়িয়াখানার প্রজাপতি ঘরগুলোতে শিক্ষামূলক পর্যটন থেকে প্রতিবছর মিলিয়ন ডলারের আয় হয়। তদুপরি, শিল্প, সাহিত্য ও ফ্যাশন খাতেও প্রজাপতি অন্যতম জনপ্রিয় মোটিফ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা সৃজনশীল অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

সামগ্রিকভাবে, সরাসরি পর্যটন আয় (এক বিলিয়ন ডলার), কৃষিক্ষেত্রে পরাগায়ন সেবা (১২ থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলার), বাণিজ্য ও চাষ (২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার), শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক খাত (প্রতিবছর কয়েক মিলিয়ন ডলার) এবং পরিবেশগত সেবার আর্থিক মূল্য (বিলিয়ন ডলারে) যোগ করলে দেখা যায় যে বৈশ্বিকভাবে প্রজাপতির অর্থনৈতিক মূল্য বছরে ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এভাবে প্রজাপতি শুধু নান্দনিক বা পরিবেশগত সম্পদ নয়, বরং টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপযোগ্য সম্পদ, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আয় বৈচিত্র্যকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন ও সংরক্ষণে বড় অবদান রাখতে পারে।

*লেখক: আশিকুর রহমান সমী, বন্য প্রাণী গবেষক ও পরিবেশবিদ