প্রি-সার্ভিস শিক্ষক প্রশিক্ষণের গুরুত্ব

শিক্ষকতাপ্রথম আলো ফাইল ছবি

স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে মানুষকে শিক্ষা প্রদান করা হয়, তাকে বলা হয় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। অপর দিকে আমরা যেসব জ্ঞান আমাদের চারপাশ থেকে দৈনন্দিন জীবনে অর্জন করি, তা হলো অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা। আর যে শিক্ষা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাঝখানে পড়ে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে অর্জিত হয়, তাকে বলা হয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা। এই আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সঠিক বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষককে অবশ্যই কিছু গুণাবলি ধারণ করতে হয়। যেমন বিষয়বস্তুর জ্ঞান, শিক্ষাদানের কৌশল, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা ও যথাযথ মূল্যায়নের ক্ষমতা। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সদ্য স্নাতকধারী শিক্ষার্থীকে এই গুণাবলিসম্পন্ন একজন দক্ষ শিক্ষক হিসেবে ভাবা যায় না। তাঁকে শিক্ষক বলা গেলেও প্রকৃত অর্থে একজন যোগ্য শিক্ষক হওয়ার জন্য এসব গুণ অর্জন করা প্রয়োজন। আর এ গুণ অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো শিক্ষক প্রশিক্ষণ। শিক্ষকের হাতেই আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ গঠনের দায়িত্ব। তাই এই গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য একজন শিক্ষককে প্রস্তুত থাকতে হয়।

একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদের মতে, ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ বলতে আমরা বুঝি, সেসব কোর্স বা যোগ্যতা, যা শিক্ষক তাঁর পেশাগত জীবনের শুরুতে অর্জন করেন অথবা স্বল্পমেয়াদি কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে গ্রহণ করেন।’ এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষক শেখেন, কীভাবে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা, মূল্যবোধ ও আচরণগত দিকগুলো গঠনে ভূমিকা রাখতে হয়।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ দুটি ভাগে বিভক্ত—প্রি–সার্ভিস (পেশার আগে) ও ইন–সার্ভিস (চাকরিরত অবস্থায়)। নতুন শিক্ষককে সংগঠিত ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে ও শ্রেণিকক্ষে বিচিত্র ধরনের শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে পাঠদানে সক্ষম করতে এই প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। শিক্ষাবিদদের মতে, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন শিক্ষক মৌলিক শিক্ষাদর্শন ও তার ব্যবহারিক দিকগুলো বোঝার সুযোগ পান, যা শ্রেণিকক্ষে বাস্তবায়ন করা যায়। শিক্ষক প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকে—পাঠ পরিকল্পনা, শিক্ষণের কৌশল, শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্ট প্রয়োগ ও বাস্তব শিক্ষণ অভিজ্ঞতা বা প্র্যাকটিকাম। একজন দক্ষ প্রশিক্ষক দ্বারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও প্রতিক্রিয়া পেলে একজন নতুন শিক্ষক দ্রুত দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শিক্ষক হিসেবে ১২ বছরের পেশাগত জীবনে এবং সাম্প্রতিক কোভিড মহামারির সময় আমি অনেক অনলাইন ও অফলাইন ক্লাসে দেখেছি, শিক্ষকেরা সঠিক শিক্ষণপদ্ধতি অনুসরণ করছেন না এবং পাঠ্যক্রমে বর্ণিত কৌশলগুলো বাস্তবায়ন করছেন না। বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষককে একাধিক বিষয় পড়াতে হয়। কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকেরা সাধারণত নির্দিষ্ট বিষয়ে নিয়োগ পান, তবে অনেক সময় একাধিক বিষয় পড়ানোর দায়িত্ব নিতে হয়। বিশেষ করে গ্রামের ছোট কলেজগুলোয় একজন শিক্ষকই পুরো বিষয় পরিচালনা করছেন, এ ধরনের চিত্র খুবই সাধারণ। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে ইংরেজি, গণিত, আইসিটি ইত্যাদি বিষয়ে কোনো শিক্ষকই থাকেন না।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০–এ বলা হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকেরা দুই মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ পাবেন এবং কলেজ শিক্ষকদের জন্য এই প্রশিক্ষণের মেয়াদ হবে চার মাস। সরকারি কলেজের শিক্ষকেরা সাধারণত নায়েম (NAEM) থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং বেসরকারি কলেজের শিক্ষকেরা এইচএসটিটিআই (HSTTI) থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের আগে বাধ্যতামূলক কোনো প্রি–সার্ভিস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষকেরা ৪ থেকে ১০ বছর বা তার বেশি সময় চাকরি করার পর ইন–সার্ভিস প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রম ও সময়সীমাও সমন্বিত নয়। ফলে অনেকে নিজের ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে শিক্ষকতা চালিয়ে যান।

এখন সময় এসেছে এই সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার। নবনিযুক্ত শিক্ষকদের জন্য নিয়োগের আগে বাধ্যতামূলকভাবে প্রি–সার্ভিস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে শিক্ষকেরা প্রথম দিন থেকেই শিক্ষার্থীদের উপযোগীভাবে পাঠদান করতে সক্ষম হবেন। জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য শিক্ষককে যথাযথভাবে প্রস্তুত করতেই হবে।

লেখক: শুভাশীষ দাশ, প্রভাষক, ইংরেজি, সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজ, ফেনী