একজন মা, গ্রামীণ ব্যাংক, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও একটি চিঠি

ছবি : লেখকের পাঠানো

শুরুতেই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ১৯৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাদের আত্মত্যাগের ফলে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। স্মরণ করছি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সেই বীর শহীদদের এবং আহত যোদ্ধাদের যাদের আত্মত্যাগের কারণে আমি আজকে এই লেখা নিয়ে উপস্থিত হতে পেরেছি।

ছোটবেলা থেকেই মায়ের সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান। মা তাঁর জীবনের অনেক গল্পই আমার সাথে বলেন।মায়ের কাছ থেকে জানতে পারি, আমার মা অল্প বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যখন তিনি কেবল ক্লাস ফাইভে পড়তেন। ক্লাসের রোল ছিল ২। অল্প বয়সে বিয়ের কারণে তার পড়াশোনার ছেদ ঘটে। মা প্রায় সময় আমাদের বলতেন, যদি সম্ভব হতো তোদের সাথে স্কুলে যেতাম। পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে আমার মায়ের পড়াশোনার প্রতি ছিল অগাথ টান। যে কারণে আমাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনার পেছনে উনার ছিল অপরিসীম প্রচেষ্টা। তবে বিপত্তি বাধে অন্যখানে। আমার স্বল্প উপার্জনকারী বাবার পক্ষে দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাওয়া ছিল রীতিমতো বিলাসিতার মতো। আমাদের আর্থিক দৈন্য দশায় কেউ এগিয়ে আসেনি। মা, বাবার সাথে সমানতালে মাঠে কাজ করতেন, তবে কোনদিন আমাদের দুই ভাইকে মাঠে কাজ করতে দেননি। এজন্য যে যাতে আমাদের পড়াশোনার ব্যাঘাত না ঘটে।

আজ থেকে প্রায় ১৯ বছর আগের কথা। আমি তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা ও পড়াশোনার খরচ বাবদ আমার প্রায় ১৫০০ টাকা দরকার ছিল। সেই টাকাটা দেওয়ার সাধ্য ছিল না আমার পরিবারের। ভাগ্যক্রমে মা তখন গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ছিলেন। মা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৫০০০ টাকা ঋণ নিলেন, যা থেকে আমাকে দিলেন দুই হাজার টাকা। আর বাকি টাকা পরিবারের কাজে লাগালেন। টাকা পেয়ে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপর পরীক্ষা দিলাম। আমার স্কুল থেকে দুইজন জিপিএ ফাইভ পেলাম, তার মধ্যে আমি একজন! তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। গ্রামীণ ব্যাংকের তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা স্যার আমাকে একটি অভিনন্দনপত্র পাঠালেন। আমি সেই পত্রটি আজও সংরক্ষণ করে রেখেছি!

এই চিঠিটি আমাকে পরবর্তী জীবন যুদ্ধে নিরন্তর অনুপ্রেরণা যুগিয়ে গিয়েছে। মাঝেমধ্যেই আমি চিঠিটি খুলে দেখি। এটি পড়ে মনে হয় যে এটি শুধু একটি চিঠি নয়, বরং এটি হচ্ছে একজন মহীয়সী মায়ের ত্যাগ তিতীক্ষার স্বীকৃতি। সেইসাথে একজন গ্রাম্য ছেলের অনুপ্রেরণার উৎস।

পরবর্তীতে গ্রামীণ ব্যাংকের বৃত্তি আমাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আমার জীবনে একের পর এক সাফল্য আসতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হই। পড়াশুনা শেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হই। ২০১৮ সালের ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলে একটি ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ প্রাপ্ত হই। এতে আমার মা অনেক খুশি হলেন আর আমি চিঠিটি বের করে আবার পড়লাম।

কিন্তু ২০১৯ সালের ২০ মার্চ এল এক বিশাল ধাক্কা। এ যেন বিনামেঘে বজ্রপাতের মত। ৩৬তম বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে অন্য একটি সরকারি চাকরিতে গেজেট প্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে বিসিএস গেজেটে আমার নাম অন্তর্ভূক্ত হয়নি।

এই তথ্যটি আমার পরিবারে এক করুন দৃশ্যের অবতারণা করে। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর এক অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দিনাতিপাত করেছে আমার পুরো পরিবার।

তারপর এল সেই আবিস্মরণীয় ৩৬ জুলাই! আবু সাঈদ, মুগ্ধ ও ওয়াসিম তথা বাংলার ছাত্র-জনতা নিজেদের জীবন দিয়ে এ দেশের ভাগ্যাকাশ হতে অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে বৈষম্যহীন এক নতুন দিনের সূচনা করল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ আগস্ট প্রকাশিত গেজেটে আমার নাম অন্তর্ভূক্ত হলো! শুরুতেই মাকে ফোন করে জানালাম। মা আনন্দে কেঁদে দিলেন।

বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের যাত্রার সাথে আমিও একটি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন জীবনে পদার্পণ করলাম। সেই নতুন বাংলাদেশের নেতৃত্বে আছেন আমার অনুপ্রেরণা যোগানো চিঠির সেই স্বপ্নের মানুষ, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস স্যার! আমার জন্য এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে!

এই পর্যায়ে সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, দয়া করে কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পক্ষে কাজ না করে আসুন আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করি। এই দেশকে কে গড়ে তুলি এবং সর্বদা জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দেশপ্রেমের অনন্য নজির স্থাপন করি।

পরিশেষে আমি প্রত্যাশা করি, সবাই মিলে আমরা এক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যাব। যেখানে থাকবে না কোন বৈষম্য। দল মত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কেউ যেন রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয় সেই আশাবাদ রইল।