ভোজবাজি
বিশ্ব রোডে বাস থেকে নামার পর হেঁটে লাগে এক-দেড় ঘণ্টা আর ভ্যানে লাগে ২০-২৫ মিনিট। বন্ধু রকি বলেছিল, মনে রয়েছে রনির। রকির বাবার কথা বললেই সবাই দেখিয়ে দেবে বাড়ি।
আসলে শীতের সময়ে খেজুরের রসের মজাই আলাদা। রকিদের এলাকার খেজুরের রসের নাম রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, রকিদের বাড়িতেই গাছি থাকছে! এই সুযোগ বারবার মিস করলেও এবার রনি ও আরেক বন্ধু জিতু মিস করতে চায়নি।
বাস আসার কথা ছিল রাত ১২টার মধ্যে। মাঝপথে বাস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দুই ঘণ্টা দেরিতে বাস আসে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বাস থেকে নামার পর তারা দেখল, কোনো ভ্যান সেখানে ছিল না। রকিকে কল দিতে গিয়ে রকির মোবাইল বন্ধ পেল। রাত ১২টা পর্যন্ত রকির মোবাইল খোলা ছিল। সেদিন শীতের তীব্র দাপট ছিল।
উপায় না দেখে জিতু আর রনি গ্রামের নাম উল্লেখ করে সামনের দিকে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তাদের অপর বন্ধু সনু দুর্দান্ত সাহসী। সনুর পেছন পেছন হাঁটতে লাগল রনি আর জিতু।
প্রায় দুই কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখতে পেল, খাটিয়ায় করে লাশ বহন করে আনছে কয়েকজন। কিন্তু এত রাতে কেন? কেউ একজন বলল, লাশের মানুষ বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না! পুলিশ কেস ময়নাতদন্তের পর রাতারাতি দাফন করতে হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়েছে। আর সঙ্গে যারা এসেছে, অধিকাংশ মানুষ অনেক বৃদ্ধ; তারা ভ্যানে চড়ে আসছে। এ জন্যই আজ বিশ্ব রোডে ভ্যান ছিল না! ভ্যানের মানুষদের শরীর থেকে জিতু তীব্র আতরের গন্ধ অনুভব করল।
রকির মোবাইল তখনো বন্ধ ছিল। রকিদের কথা বলতেই মুর্দার এক আত্মীয় বলে উঠল, এই নামে দশ গ্রামে কেউ নেই; আর থাকলে তিনি চিনতেন। তিনিই এই গ্রামের সব থেকে বেশি বয়স্কদের মধ্যে একজন। পাশের আরেকজন বলল, তিন ক্রোশ দূরে হতে পারে। সেখানে যেতে হলে চাকলের বিল পেরিয়ে যেতে হবে।
এসব শুনে তিন বন্ধুর রকির প্রতি খুব রাগ হতে লাগল। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে হেঁটে উষ্ণতায় তাদের ভালো লাগছিল। পেছন থেকে কেউ যেন ফিসফিস করে বলল, ওদিকের রাস্তা সুবিধার নয়!
তিন বন্ধু আবার হাঁটতে লাগল। শীতের দিন না হাঁটলেই বিপদ; ঠান্ডা লাগে যাবে। ডান-বাঁ না বুঝেই চলছে তিনজন। তাদের আপাতত গন্তব্য চাকলের বিল পার হওয়া। দেখা যাক, কতটা খারাপ এলাকা! তারাও তো তিনজন টগবগে তরুণ।
তখনো রকির মোবাইল বন্ধ। তিন বন্ধু হাঁটছে অভীষ্ট লক্ষ্যে। নিশুতি রাত জনমানবহীন।
নৌকায় নদী পাড়ি দিলেই বিল। মাঝি নৌকাতে বসা। এত রাতে মাঝি কী করছে? এত শীতে মাঝি একটা শার্ট পরে রয়েছে। মাঝির শরীর থেকে আতরের গন্ধ আসছে! এই গ্রামের সব মানুষ কি একই ব্র্যান্ডের আতর ব্যবহার করে! রকিদের বাড়িতে যেতে এই রকম খেয়া পাড়ি দিতে হয়, তা রকি বলেনি। জিতু ভাবতে ভাবতেই সনু মাঝির নৌকায় ওঠে পড়ল। রনি আর জিতু নৌকায় ওঠার আগে ভাবতে লাগল।
হঠাৎ করেই একটা নৌকা ঘাটে ভিড়ল। নৌকা থেকে পুলিশ নামছে, সাথে রকি! রকিকে ডাক দিল রনি। স্তম্ভিত হয়ে রকি জানল, আজ রাত ১২টায় তার চাচার অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। এখান থেকে থানায় যেতে হলে নৌকাতেই যেতে হয়।
কিন্তু বিশ্ব রোডে তোদের রিসিভ কেউ করেনি? রনিরা না-সূচক জবাব দিল। এসব শুনে রকি অচেনা মানুষের মতো অন্য দিকে ফিরে হাঁটা দিল। রনি বারবার ডাকলেও রকি না শোনার ভান করল। রকি কিছু সময়ের মধ্যে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। রনি আর জিতু পুলিশের সন্ধানে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল, সেখানে কেউ নেই!
কিন্তু সনু আর মাঝি কোথায়? নৌকা মাঝনদীতে, মাঝি নৌকা বাইছে কি না, তা বোঝা যাচ্ছে না; তবে নৌকা চলছে। নৌকাতে কোনো আরোহী আছে কি না, বুঝতে পারা যাচ্ছে না। সনুটা আবার কোথায় গেল!
রনির মোবাইল বেজে ওঠে। একি রকির ফোন! দুই বন্ধু উল্লাসে মেতে উঠল। কিন্তু যা শুনল, তাতে তাদের রক্ত হিম হয়ে গেল। তিন বন্ধু ভুল করে বাস থেকে এক স্টপেজ আগে নামে পড়েছে। তারপর তারা ভুল পথেই চলেছে। তাদের জন্য রাখা ভ্যান এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। একটা কাজে আটকে রকির আসতে দেরি হচ্ছিল।
কিন্তু রনি যে স্থানের বর্ণনা দিল, তা রকি চিনতে পারছে না। তবে রকি যে গ্রাম আন্দাজ করেছে, সেখানে এত রাতে কোনো ভ্যান যাবে না। জায়গাটা ভালো নয়; মানুষ খুন করে সেখানে বিলে ফেলা হয়। মাঝেমধ্যে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে! কথা বলতে বলতে রনির মোবাইল বন্ধ হয়ে গেল। সুনসান রাতের নীরবতা চারদিকে।
কোনো অপঘাতেই রকির চাচার মৃত্যু হয়নি। দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ-বিভ্রাটে রকির মোবাইলে চার্জ ছিল না। এতেই যা বিপত্তি! তবে জিতুরা যেখানে এখন অবস্থান করছে, সেখানে প্রয়োজন ছাড়া সচরাচর কেউ যায় না। আর রাস্তা এত খারাপ! বলাই বাহুল্য। রাতে অন্ধকারে আরও বেহাল। তবু রকি বন্ধুদের উদ্ধার করতে ভ্যান নিয়ে ছুটে চলল। বন্ধুর বিপদে বন্ধু দূরে থাকতে পারে না।