আর নয়! চিরতরে বন্ধ হোক দলীয় ছাত্ররাজনীতি
অবশেষে আমরা এক নতুন বাংলাদেশে বাস করছি। অদম্য সৎসাহসের বলে আমাদের দেশ এক ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে। সাহসী, যৌক্তিক এবং সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনে ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছিলেন সেই সব সাধারণ মানুষ, যাঁরা আর কোনো অপশক্তিকে ভয় না পাওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তাঁরা সবাই মিলে এ পর্যায়ে দেশকে এক সম্ভাবনাময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দিতে সফল হয়েছেন। দেশকে এখন প্রস্তুত করতে হবে নতুন যুগের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সূচনা জয় করার লক্ষ্যে।
অন্তর্বর্তী সরকার যেসব কার্যকর ও গণমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে বলে আমরা আশা করছি, সেগুলোর সবই আমরা সাদরে গ্রহণ ও সমর্থন করতে আগ্রহী। তার মধ্যে দলীয় ও সহিংস ছাত্ররাজনীতি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি অপরিহার্যভাবে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আমি একজন শান্তি ও শৃঙ্খলা-সমর্থক শিক্ষার্থী হিসেবে সবিনয়ে নিবেদন জ্ঞাপন করছি। অবশ্য ইতিমধ্যে খবর একটির পর একটি এসে যাচ্ছে যে স্বনামধন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষাঙ্গনে সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা স্থায়ীভাবে ধরে রাখাও যে অদূর ভবিষ্যতে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে, সে ব্যাপারে মানসিক ও সাংবিধানিক প্রস্তুতি থাকাটা প্রয়োজন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদিও এগুলো থেকে সর্বদা মুক্ত ছিল, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও দলীয় রাজনৈতিক কমিটি গঠনের একাধিক চেষ্টার প্রমাণ রয়েছে। এ ধরনের শিক্ষাবিমুখ কার্যকলাপের দায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণ পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বিরক্ত, বিপর্যস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
নিশ্চয়ই একটি প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য রাজনীতিতে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। রাজপথ থেকে শুরু করে সরকার পর্যায় অবধি আমাদের জেন-জি যোদ্ধাদের চলমান উদ্যোগসমূহ ও স্পৃহা যে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে, তা দেখায় যে তারা কতটা রাজনৈতিকভাবে অবহিত এবং স্বদেশমুখী হয়ে নিবেদিত। গঠনমূলকভাবে বিশ্লেষণ, যৌক্তিক প্রশ্ন তোলা এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মার্জিতরূপে অংশগ্রহণের জন্য তরুণদের পর্যাপ্ত সুযোগ নিশ্চিত করে দিতে হবে। একই সঙ্গে এটা নিশ্চিত করতে হবে, এ ধরনের চর্চা যেন পক্ষপাতহীন ও দেশমুখী উপায়ে পরিচালিত হয়, যা সহিংস সংঘর্ষের চেয়ে সংলাপ ও সুস্থ বিতর্ককে অগ্রাধিকার দেয়।
আমাদের আশপাশে যথেষ্ট নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে যদি লক্ষ করি, তবে আমরা নিঃসন্দেহে এই উপসংহারে এসে দাঁড়াব যে বৈধ রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং পক্ষপাতদুষ্ট উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের শোষণের মধ্যে পার্থক্য করা কতটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। অবশ্যই সবার মতো একজন শিক্ষার্থীরও তার মতামত এবং ভিন্ন রাজনৈতিক রুচিশীলতা প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসগুলোকে সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন বা বিদ্বেষপূর্ণ আধিপত্যের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে অপব্যবহার করার অধিকার কোনো সভ্য গণতন্ত্র কখনোই দিতে পারে না।
হোক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে-যেতে বা নিজের বাড়ির নিরাপদ চার দেয়ালের মধ্যে থেকে, ছাত্রীদের সর্বদা এই ভয়ে থাকতে হয় যে কোন আকস্মিক মুহূর্তে তাঁদের জীবন কিংবা সম্মান হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। র্যাগিং, অনর্থক হয়রানিসহ সব ধরনের নিগ্রহ–নিপীড়নের ভয়ে সর্বদাই চিন্তিত থাকতে হয় শিক্ষার্থীদের, তাঁদের সম্পূর্ণ শিক্ষাজীবন জুড়ে, এমনকি পরেও। এমন অসামাজিক রাজনৈতিক উপাদানের কারণে যে কেবল তাঁদের জানমালের নিরাপত্তাই অনিশ্চিত ও বিপন্ন হয় তা নয়, বরং তাঁদের উপযুক্ত পরিবেশে আগামীর সুশীল ভবিষ্যৎ হিসেবে নেতৃত্ব অনুশীলনের সুযোগও অপচিত হয়।
আমাদের সর্বপ্রথম এ ঐকমত্যে আসতে হবে যে গণতন্ত্র একটি অস্ত্র। আর ব্যবহারকারীদের ওপর নির্ভর করে এর ফলাফল। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ সংকটগুলো অবিলম্বে এবং অকপটে টেকসই পদক্ষেপের মাধ্যমে নিরসনের জন্য জরুরি আহ্বান জানাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর এবং একমাত্র প্রযোজ্য পদক্ষেপ হবে একটি দৃঢ় নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সব ধরনের দলীয়, অসুস্থ ও অসামাজিক রাজনীতি দেশের সব বিদ্যাকেন্দ্র থেকে অবিলম্বে ও স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা।
এ নিষেধাজ্ঞা অবশ্যই শিক্ষকেরা এবং প্রতিষ্ঠানের অন্য সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপরও একইভাবে প্রযোজ্য হবে। আদেশটি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব শিক্ষার্থী (অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে তাদের পক্ষে অভিভাবক), শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধ্যতামূলকভাবে লিখিত অঙ্গীকার প্রদান করতে হবে, যাতে আদেশটি আন্তরিকভাবে মেনে চলার বিষয়ে তাদের আশ্বাসকে আনুষ্ঠানিক করা হয়। যত দিন পর্যন্ত উক্ত নির্বাহী আদেশ বলবৎ থাকবে তত দিন অবধি এই লিখিত অঙ্গীকার গ্রহণ করার নিয়মটি কার্যকর থাকতে হবে। কেননা ভবিষ্যতে যখনই কেউ কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী বা শিক্ষার্থী হিসেবে নতুন যোগদান করবেন, তখনো যেন লিখিত অঙ্গীকারটি বাধ্যতামূলকভাবে নেওয়া হয়। উপরন্তু কোনো ব্যক্তি যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারবেন না। সেই সঙ্গে সব রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
এটি আমাদের শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি সারা দেশে সুরক্ষার ক্ষমতায়নের একমাত্র উপযুক্ত বিকল্প। জ্ঞান ও নৈতিকতার উৎকর্ষ রক্ষা করতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোয় কোনোভাবেই দলভিত্তিক বা অনৈতিক রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কোনো স্থান থাকা উচিত নয়।
তা ছাড়া সরকারের উচিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নৈতিক ও অবকাঠামোগত পুনর্নির্মাণে সম্পদ, তদারকি ও মূল্যবান মানবিক দিকনির্দেশনা বিনিয়োগ করা, যেন কেবল পেশাগত বা কর্মগত শ্রেষ্ঠত্বের কেন্দ্র হিসেবে নয়, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা এবং পরস্পর সহানুভূতির কারখানা হিসেবে পরিচালিত হয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। একমাত্র তখনই মানবিক ও সম্পদশালী মানবসম্পদ বিকাশের সংস্কৃতি স্থায়ীভাবে আমাদের এ বাংলার বুকে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
নতুন সম্ভাবনার বাংলাদেশ নিয়ে আসুন আমরা সবাই নিঃস্বার্থভাবে এমন একটি জাতি গঠনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হই, যেখানে জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, উৎকৃষ্ট মানবিকতা বজায় থাকে এবং উৎপাদনশীলতা শক্তিশালী হয়।
*লেখক: নাফিস এহসাস চৌধুরী, শিক্ষার্থী, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: ns@prothomalo. com