রাজশাহীতে শীতকালীন শাকের মেলা

ভৌগোলিক কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন শহর রাজশাহীতে শীতের প্রকোপ অনেকটাই বেশি। তবে সেই শীতকে জয় করে রাজশাহীতে চলে নানা আয়োজন। শহরের দক্ষিণ দিয়ে বাহিত পদ্মা নদীর বাঁধ ঘেঁষে রাজশাহীর সিঅ্যান্ডবি মোড়। সন্ধ্যার পর সময় কাটানোর জন্য চমৎকার একটি জায়গা। বিকেল হলেই ফুটপাতজুড়ে বসে শাকের মেলা। লোকসমাগম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমে ওঠে শাক কাটাকুটির একরকম ব্যতিক্রম প্রতিযোগিতা।

বেশ কয়েক বছর থেকেই চলছে এমন কৌতূহলী বিরল আয়োজন। খেসারি, বথুয়া, সাঞ্ছি, বুট, শর্ষেসহ নানান পদের শীতকালীন শাক খেত থেকে তুলে আনেন গ্রামীণ নারীরা। এরপর সেগুলো কেটেকুটে গ্রাহকদের সামনেই রান্নার উপযোগী করে দেন।

প্রতি কেজি খেসারি শাক বিক্রির দর ১২০ টাকা আর কুচি করে কেটে পরিবেশনের জন্য মজুরি বাবদ ২০ টাকা বাড়তি রেখে সর্বোচ্চ মূল্য ধরা হয় ১৪০ টাকা। বথুয়া, বুট, শর্ষে কেজিপ্রতি ৬০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হলেও সরাসরি কেটে চূড়ান্তরূপে প্রস্তুত করে নিলে ৮০ টাকায় বিক্রি পারিশ্রমিকসহ। পছন্দের শাক সহজেই কেটে–বেছে পেতে ক্রেতারাও উৎসাহের সঙ্গে ভিড় জমাতে থাকে শাক কাটার এ আসরে। নিতান্তই নির্ঝঞ্ঝাট জুতসই টাটকা শাক খেতে কার না ভালো লাগে?

রাজশাহীর পদ্মার পাড়ের চর এলাকার গ্রামীণ নারীরা শাকগুলো খুব সকালেই খেত থেকে সংগ্রহ করে রওনা করেন শহরের উদ্দেশে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই ফুটপাতজুড়ে বসে পড়েন শাক কাটার এই প্রতিযোগিতায়। একেক জন ১০ থেকে ১৫ কেজি বোঝায় শাক বয়ে নিয়ে আসেন প্রত্যাশিত ক্রেতার আশায়। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণের শাক বিক্রি করতে না পারলেও গড়ে যা আয় হয়, তাতেই নিত্যদিনের সংসারে সামান্য শাক-ভাতের জন্য যথেষ্ট। উচ্ছিষ্ট শাকের অংশবিশেষ নিজের পরিবারের স্বস্তির জন্য বরাদ্দ থাকলেও দিন শেষে তা নিজ এলাকায় দৈনিক কমবেশি করে বিক্রিও করে ফেলেন নিমেষেই।

বিভিন্ন ধরনের শাক খাওয়াটা বাঙালির এক আদি খাদ্যাভ্যাস। কৃষিনির্ভর বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের খাদ্যসংস্কৃতির প্রধান খাবারের মধ্যে নানান ধরনের শাকসবজি অন্যতম। শীতের সতেজ শাকসবজির স্বাদই অন্য রকম। দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় শাকপাতা শরীরের জন্য খুবই উপকারী ও পুষ্টিকর! শীতকালীন শাক বাজারে এসে পড়লেও শীতের সকালে বাজার করাটা সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ কাজ।

ইন্টারনেটের কল্যাণে ফেসবুক ও অনলাইন বিভিন্ন সাইটে আজকাল রেডি টু কুক খাবার কিংবা হোম ডেলিভারির সেবাপদ্ধতি অহরহই চোখে পড়ে। হোমমেড খাবার বা হোম ডেলিভারি রীতি এখন বহুল পরিচিত একটি ব্যাপার। মাছ, মুরগি, হাঁসের মাংস থেকে শুরু করে রান্নার যাবতীয় উপাদান সবকিছুই মানুষ এখন সুবিধাপূর্ণভাবে প্রক্রিয়াজাত আকারে হাতের নাগালে পেতে চায়। ব্যস্ততার কারণে সময়সাপেক্ষ ও শ্রমসাপেক্ষ দক্ষতাগুলো আজ একটি পরিষেবায় পরিণত হয়েছে।

স্বাবলম্বী হওয়ার লক্ষ্যে উদ্যোক্তার মানসিকতা থেকেই বিভিন্নজন এ ধরনের সেবা দিয়ে থাকেন।

সাম্প্রতিক কালে স্কুল, কলেজ ও কর্মক্ষেত্রের ছোটাছুটিতে পরিবারের সবাই যখন ব্যস্ত, তখন রান্নার উপযোগী করা পর্যাপ্ত প্রস্তুতিটুকুর এই সেবা মানুষের জন্য অত্যন্ত উপকারী উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করে দেখা যায়। কিন্তু এসবের মধ্যে রাজশাহীতে দেখা গেছে এক ভিন্নচিত্র, যেখানে চরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ, তাঁরাও হয়তো ব্যাপারটি উপলব্ধি করেছেন যে শাক একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবারের অংশ হলেও শাক কাটা, বাছা ও রান্নার উপযোগী করে তোলা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও পরিশ্রম বা আয়াসসাধ্য!

ইউটিউব–ফেসবুক ব্যবহারকারী শিক্ষিত সমাজের একটি অংশের কাছে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার ব্যাপারটা খুব সহজে গ্রহণযোগ্য হলেও সেই অর্থে অনেকের কাছে সমাজের অনেকখানি পিছিয়ে পড়া নারীদের এই উদ্যোগ ব্যতিক্রমী মনে হতে পারে। তবু তাঁদের উদ্যোগ ভিন্নধর্মী এক প্রচেষ্টা। এগিয়ে যাক সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীরা।

*লেখক: শিউলী আকতার জেমি, রাজশাহী

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। মেইল অ্যাড্রেস [email protected]