বড় হয়ে মানুষ হতে চাই

ছবি: চাকরি-বাকরি

বাংলাদেশে কে কোন ক্যারিয়ার গড়বে, এটা বলা বা বোঝা খুবই মুশকিল। একটা শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই তার ক্যারিয়ার নিয়ে যে পরিমাণ টানাহেঁচড়া হয়ে থাকে, তাতে কর্মক্ষেত্রে যে টিকে থাকে, সেটাই অনেক কিছু। আসলে ব্যপারটা কী, একটু দেখে নেওয়া যাক।

ছোটবেলা থেকেই ক্যারিয়ার নিয়ে সন্তানকে বাবা-মায়ের এক মতে যাওয়া খুবই কম দেখা যায়, আবার দেখা যে যায় না, সেটাও ঢালাওভাবে বলা যাবে না। ক্লাসে প্রথম হতেই হবে, তা ছাড়া ওর জীবন শেষ। শুরু হলো এখান থেকেই। এক গাদা বই আর ক্লাসের চাপে বাবা-মায়ের এই অদম্য আকাঙ্ক্ষায় কোথায় যেন ছোট্ট ওই শিশুটি অসহায়ের দলে যোগ দিয়ে ফেলে। পাড়ার মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে অনেক ইচ্ছা হলেও প্রথম হওয়ার তাগিদে সব যেন শিশুকাল থেকেই অকাল বিসর্জন হতে শুরু করে। এর মাঝেই হারিয়ে যায় শৈশবের দুষ্টুমি, অবাধ চলাফেরা আর জগৎকে নিজের মতো জানার চেষ্টা। সন্তান প্রথম হয়ে গেল, বাবা-মায়ের আজ বিজয়ের দিন। পাশের বাসার ভাইয়া-ভাবিকে তো বলতে পারবে, আমার সন্তান অনেক মেধাবী।

ক্লাসে প্রথম হতে গিয়ে জীবনের অনেক পরীক্ষায় যে অংশগ্রহণ করতেই পারল না, সে খেয়াল কি আছে! অপর দিকে আরেক সন্তান প্রথম হতে না পেরে বাবা-মাসহ পরিবারের অনেকের কাছে বকুনি খেয়ে হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। অথচ প্রথম সংখ্যাটি কিন্তু একটি, তার মানে ৫০ জন ছাত্র থাকলে প্রথম হবে কিন্তু ১ জনই। বাকি ৪৯ জনই কি জীবনযুদ্ধে হারিয়ে যাবে, বাস্তবে আসলে কী হচ্ছে, সেটা দেখা যাক।

আমার জীবনের লক্ষ্য নিয়ে ছোটবেলা থেকেই যেখানে ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার–বড় চাকুরীজীবী হওয়ার রচনা লেখানো হয়, সেখানে এর বাইরে হাজারো লক্ষ্য থাকলেও তা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়। লিওনেল মেসিকে দেখে কারও ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও পরিবার আর সামাজিক চাপে নিজেকেই ফুটবলের মতো দৌড়াতে হয় কিংবা সাকিব আল হাসানকে দেখে ভালো ক্রিকেটার দেখেও সে স্বপ্ন ভন্ডুল হয়ে যায়। উদ্যোক্তা হওয়ার কথা অনেক শোনা গেলেও সন্তান লেখাপড়া করে মুরগির খামার, গরুর ফার্ম কিংবা স্বাধীন ব্যবসা করবে, সেটাই–বা কজনে পারে! আবার ব্যাপক ইনভেস্টমেন্টও লাগে বটে। তাহলে উপায় কী!

গৎবাঁধা ক্যারিয়ার ম্যাচে গোলবারে গোল দিতে না পারলেই কি ম্যাচ হেরে যেতে হবে! ব্যাপারটা কিন্তু এ রকমই হচ্ছে। বাস্তবে এখন কী হচ্ছে! বাবা–মায়ের স্বপ্নের ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেল, দেশের প্রেক্ষাপটে সে এখন বড় বিসিএস কর্মকর্তা। বাবা–মায়ের প্রথম না হওয়া ছেলেটাও আজ কোনো বড় অফিসের বড় কর্মকর্তা, আবার প্রথম হওয়া ছেলেটাও আজ ভালো কোনো চাকরি না পেয়ে চরম হতাশায় ভুগে যাচ্ছে কিংবা বড় কোনো অফিসে চাকরি করে আজ দুর্নীতির দায়ে জেলে অবরুদ্ধ। তাহলে জীবনের লক্ষ্য কী? হিসাব মেলানো দায়। অন্য ক্ষেত্রে অতি আদরের ছেলেটি অনেক বড় হয়েও সেই বাবা-মাকে অনেক ছোট করে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় দিচ্ছে। আবার জীবনে ক্লাসের কোনো পরীক্ষায় প্রথম না হয়েও এলাকায় ওই দরিদ্র ছেলেটি বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে ডালভাত খেয়ে কোনো হতাশা ছাড়াই জীবনযুদ্ধে ঠিক প্রথম হয়ে যাচ্ছে। তার হিসাব কে রাখছে।

তাহলে জীবনের লক্ষ্য ছোটবেলার পঠিত সেই রচনার মতো সুগঠিত হয়ে উঠতে পারছে না, পরিবেশ–পরিস্থিতি মানুষের জীবনের গতিপথ নিয়মিত পাল্টে দিচ্ছে। কাল জীবনের বাঁক কোথায় যাবে, কেউ জানে না। তাই বলে কি জীবনের লক্ষ্য থাকবে না। অবশ্যই থাকবে, প্রতিটা কাজের একটি গোল থাকতেই হবে। বাবা-মায়েরা সব সময়ই সন্তানের মঙ্গল কামনা করে ভালো কিছু চান, তবে সেই চাওয়াটা অবশ্যই সন্তানের সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকতে হবে, তাহলেই হয়তো পরীক্ষায় ফেল করে কাউকে আত্মহত্যা করতে হবে না। দিন শেষে ভালো মানুষ হওয়ার কথা বললেও বাস্তব ক্ষেত্রে তা হয় না। বড় হওয়ার তাগিদে কখন যে ছেলেটি বড় দুর্নীতিবাজ আর বাবা-মা সমাজবিরোধী হয়ে যায়, সে খেয়াল এখনই না রাখলে জীবনযুদ্ধে বরাবরই পিছিয়ে থাকব।

*লেখক: মনোজিৎ কুমার রায়