দুর্বার গতিতে ধাবমান চাঁদহাট বাজার হাইস্কুল
দশম শ্রেণির প্রাক্ নির্বাচনী পরীক্ষা শেষ হয়েছে। প্রশস্ত ঘরে গোল হয়ে সেই খাতা দেখছেন শিক্ষকেরা। কেননা আগামীকাল ঈদের ছুটি শুরু। সুতরাং আজই ফলাফল ঘোষণা করতে হবে। সে জন্য সবাই ব্যস্ত, মহাব্যস্ত। আমি এসে পড়লাম এরই মধ্যে।
মিজানুল হক কনক ক্রীড়া শিক্ষক। আমাদের ছোট ভাই। অন্য স্কুলে বেড়ানোর ওপর প্রতিবেদন দেখে কিছুটা আক্ষেপের সুরেই বলেছিল, দাদা নিজ স্কুলে এলেন না! সত্যিতো নিজ গ্রামের প্রতিষ্ঠান ফরিদপুরের চাঁদহাট বাজার হাইস্কুল। এখানে আমি দুই বছর পড়েছি। তখন বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়নি।
তাই আমি ফিরে গেলাম গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর হাইস্কুলে। ফিরে গেলাম বলছি এই জন্যই যে আমি আগে ওই স্কুলেই ছিলাম। আজ ছোট ভাইয়ের কথা রাখলাম। সেভাবেই যোগাযোগ করে আসা।
কৃষ্ণপদ বসু। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। কনকের মাধ্যমে পরিচয় হলো তাঁর সঙ্গে। কথাপ্রসঙ্গে বললেন, এখন গ্রাম পাচ্ছে শিক্ষার শতভাগ সুযোগ। আগের মতো অবস্থা আর নেই। কথাটি মনে ধরল।
জানুয়ারিতেই বিনা পয়সায় এখন শিক্ষার্থীরা বই হাতে পেয়ে যাচ্ছে। নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন শিক্ষকেরা।
আসল বেড়ানো শুরু হলো। গেলাম নবম শ্রেণির ঘরে।
একই সঙ্গে ছেলে মেয়েদের ক্লাস। চোখে মুখে মেধার দীপ্তি। ইউনিফর্ম পরনে। ছেলেরা সাদা শার্ট, নেভি ব্লু প্যান্ট। মেয়েরা নীল কামিজ, সাদা সালোয়ার আর ওড়না। আলাদা ছন্দ তাদের কথাবার্তায়। এ স্কুলের পুরোনো ছাত্র আমি। সালের কথা শুনে ওদের চোখ কপালে উঠল।
কী পরিবর্তন! তুলনা করি নিজের সময়কার সঙ্গে। এরা পাঁচ ক্লাসে সংখ্যায় ৭০০, আমরা ছিলাম এক ১৭৫। পরতাম গতানুগতিক জামা–পাজামা।
পায়ে ছিল চটি কিন্তু ওদের জুতা। স্কুল থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ছিল টিন আর মলি বাঁশের লম্বা ঘর। এখন সেখানে চারতলা ভবন।
ছিল অফিস এবং একটি টিন-কাঠের ঘর। এখন যুক্ত হয়েছে আরও দুটি পাকা দালান। এর একটি লাইব্রেরি। জায়গাটি এখন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এমন পরিবেশে ছোটরা বেড়ে উঠছে। তাহলে এমন চৌকষ তারা হবেই।
মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর নিয়ে কথা বললেও তারা এখন আটকায় না। চটপট তাদের উত্তর। আমি বিস্মিত না হয়ে পারি না।
অষ্টম শ্রেণিতে যেন সবাই সরব। প্রাণের সে কি উচ্ছলতা! বললাম ওই...ওই সিটে বসতাম আমি। ক্লাসের সবগুলো চোখ ঝাঁপিয়ে পড়লো ওখানে। আসলে তখন তো পাকা দালান ছিল না। তাহলে ওই সিট আসবে কোথা থেকে! ওদের সঙ্গে এবার আমি পার্থক্য নির্ণয় করার চেষ্টা করি।
আমরা খেলাধুলা করতাম। ফুটবল। ওরা ক্রিকেটে বেশি উৎসাহী। আমরা বল খেলতাম দারুণ উত্তেজনা নিয়ে। বর্ষা মৌসুমে এ নিয়ে চারপাশে সারা পরে যেত। এ জন্য গ্রামের লেবুর বাগান যে উজাড় হয়ে যেত, সে খবর কেউ চেষ্টা করেও রাখতে পারত না।
আমরা ছাত্র সংগঠন করতাম। ওরা বেশি সময় দেয় পড়াশোনায়, প্রাইভেটে। ওই সময় পাশের গ্রামের কৃতি সন্তান আতিয়ার রহমান ছিলেন ছাত্রনেতা। জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। আমরা ওই সংগঠন করতাম। অনেকে ছাত্রলীগ করত। আমাদের এলাকায় জন্ম জেলা যুবনেতা সোলায়মান আলীর। যুবলীগের নেতা হলেও ছাত্রদের সঙ্গে ছিল তাঁর যোগাযোগ। একই কারণে এই সংগঠনের নেতা–কর্মীরাও ছিল সক্রিয় এবং প্রাণবন্ত।
ওই সময়েই ছাত্র সংসদ নির্বাচন কথাটি সামনে আসে। এ নিয়ে অগ্রজরা আমাদের নিয়ে বসে। প্রার্থী হিসেবে বেশ উৎসাহিত হওয়ার ব্যাপার! সাংগঠনিকভাবে তৎপর হয়ে উঠি। যদিও কোনো নির্বাচন হয়নি। আহারে...এক ধরনের সুস্থ প্রতিযোগিতা, বিশুদ্ধ উদ্যাপন! তবে এরা এই নির্বাচনের আনন্দ আমাদের মতো চিত্তলোকেও আনতে পারেনি।
চাঁদহাট মুক্তিযুদ্ধের পীঠস্থান। এলাকার কোলের মধ্যে এর অবস্থান। একাত্তরে এখানকার গ্রাম পুড়িয়েছে রাজাকারেরা। পাকিস্তানের সেনা সদস্যরা নিঃশেষ করেছে তাজা তাজা প্রাণ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হার মানতে হয়েছে তাদের। এশিয়ান হাইওয়ের পাশে আছে কৃতির স্মারক। অস্ত্র উঁচিয়ে ‘জয় বাংলা’ নামে দাঁড়িয়ে আছে সে ভাস্কর্য। কিন্তু স্কুল চত্বরে নেই কোনো শহীদ মিনার। বার্তাটি বেমানান।
এই নিয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা সভাপতি আরিফুর রহমান পথিকের সঙ্গে। তিনি এর আগে এখানকার ইউনিয়ন পরিষদেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। আন্তরিক তাঁর উপলব্ধি। বললেন, শহীদ মিনার নির্মাণে এখন আর দেরি করার সুযোগ নেই। শীত মৌসুমের আগেই কাজটি সম্পন্ন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। জানালেন, একজন দক্ষ প্রধান শিক্ষক খুঁজছেন তাঁরা।
দেখা হয় ব্যবস্থাপনা পরিষদের দাতা-সদস্য ইমারত হোসেন দুলালের সঙ্গে। তিনি শিক্ষক এবং ব্যবস্থাপনা সদস্যের মধ্যেকার সম্পর্কের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, লাইব্রেরি ভবনের মেরামতের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এখন ওই কাজটি নিয়েই ব্যস্ত তাঁরা।
এতক্ষণ তিন ক্লাসে কাটালাম। এবার শিক্ষকদের গোলটেবিলে বসি।
মো. চুন্নু শেখ সমাজবিজ্ঞানের ওপর পাঠদান করেন। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে কথা হলো। ভালোলাগে তাঁর এই গ্রাম, কুমার নদ এবং এর পারের বাগানবাড়ি।
সুরেশ চন্দ্র মণ্ডল। তাঁর বিষয় ইংরেজি সাহিত্য। শিক্ষকতা দিয়ে চাকরিজীবন শুরু। মাঝখানে গিয়েছিলেন নামকরা একটি এনজিওতে। শান্তি পাননি। তারপর আবার শিক্ষকতায়। বললেন, আনন্দময় জীবনে ফিরে এসেছি।
শিশির কুমারও ইংরেজির। ‘জীবন বৃত্তান্ত’ পড়ান। আমাদের সময় এমন বিষয় ছিল না। এখন অনেক বৈচিত্র্য। এই শিক্ষক স্বাচ্ছন্দ্য এই বিষয়ে।
সেলিম হোসেন খেলাধুলা পছন্দ করেন। নিজে ক্রিকেট খেলেন। ভারত–পাকিস্তান খেলায় অনিবার্যভাবে ভারতকে সমর্থন করেন। বললেন, একাত্তরে তারা আমাদের পাশে ছিল, একথা কি ভুলে যাওয়া ঠিক!
ভবসিন্ধু বিশ্বাস। তাঁর পছন্দেই যেন তৈরি হয়েছে তাঁর নিজস্ব বিষয় ‘শিল্প–সংস্কৃতি’। অপরাজেয় বাংলা, সাবাস বাংলাদেশ, বিজয় ’৭১ চিত্রপটে ভেসে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এসব ভাস্কর্য নিয়ে আলোচনা হতে পারে বিস্তর।
ইতি রানী বাগচী বলেন, যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেন তাঁদের নিয়ে আমার আনন্দ। নতুন পাঠ্যসূচিতে প্রমিত ভাষায় কথা বলা ভালো উদ্যোগ বলে মন্তব্য তাঁর। মিজানুর রহমান রসায়নশাস্ত্রে স্নাতক এবং স্নাতোকত্তর। আগে গণিত শেখালেও এখন ফিরে এসেছেন নিজের বিষয়ে। তারপরও বলেন, কবিতা, গল্প ও গান নিয়ে তাঁর জীবন চলা।
নুরুল আমিন কামিল–ফাজিল পড়েছেন। এখন শিক্ষক। চাকরিতে সুখী, বললেন এই ধর্ম-শিক্ষক।
তৃপ্তি কণা বোস তাঁর লেখাপড়ার সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন। শিক্ষার্থীদের নিয়ে রামায়ণ মহাভারতচর্চা করছেন। তৃপ্তি নিয়েই বললেন এ তরুণী শিক্ষক।
হ্যাঁ, শিক্ষকররা তৃপ্তি বা আনন্দের সঙ্গে পড়াতে পারলে সহজেই ছেলে মেয়েরা শিখতে পারে। স্কুলটাও সে জন্য হয়ে ওঠে ‘আনন্দ ভুবন’। সেটা কতটুকু তা বোঝার জন্য আগে থেকেই আমার একটা কৌতূহল। সে কারণেই আমার এই গোলটেবিল।
বঙ্গবন্ধু কর্নার বিজ্ঞানাগার ঘুরে দেখলাম। দুটো কঙ্কাল সামনে। ব্যালেন্সসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি পলিথিনে মোড়ানো। কমদামে জিনিস কিনে হাতে কলমে শেখান শিক্ষকেরা, বললেন ল্যাবকর্মী। মাইক্রোস্কোপ আছে দুটো। শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবে দেখলাম ১৮টি ল্যাপটপ। আধুনিক প্রযুক্তি আমারই স্কুলের শিক্ষার্থীর হাতে, ভেতরে ভেতরে অনেক গর্ব আমার!
আনন্দেরও আছে বৈচিত্র্য। শিক্ষক শিক্ষার্থী সবাই এলেন মাঠের পাশে গাছতলায়। তাঁরা ছবি তুললেন। ঘোষণা করলেন, আমরা আনন্দের দূত। আমাদের জীবন আনন্দময়।
এবার ফেরার পালা। চোখে পড়ে দেয়ালের লিখন। পণ্ডিত এ পি জে আবদুল কালামের কথা, ‘যে হৃদয় দিয়ে কাজ করে না, শূন্যতা ছাড়া সে কিছুই পায় না।’ এই স্কুলের বিশ্বাসটাও তা–ই। সে জন্যই এখানে শিক্ষার্থীরা গভীর মনোযোগে পড়াশোনা করছে। অন্যদিকে শিক্ষকেরা নিজেকে ঢেলে দিচ্ছেন ছেলেমেয়েদের জন্য। তার লক্ষণতো এই কথার মধ্য দিয়েই পরিষ্কার। ‘আজ রেজাল্ট না দিলে বাচ্চারা ছুটিতে বই ধরবে না।’ তাহলে বলতেই পারি, অদম্য এই প্রতিষ্ঠান। সেই সঙ্গে গভীর আমার পর্যবেক্ষণ, দুর্বার গতিতে সে ধাবমান।
*লেখক: নিমাই সরকার : প্রকৌশলী, কথাসাহিত্যিক
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]