দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় র‌ইল না...

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সম্প্রতি আমার স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। আমি যা ফল করেছি তা নৃবিজ্ঞান বিভাগ বিবেচনায় ভালো বলা চলে। কাজেই আমার খুশি হ‌ওয়ার কথা এবং খুশি আমি হয়েছিও বটে। তবে খুশির সঙ্গে এসে মিশেছে এক প্রচ্ছন্ন বেদনা। মনের গহিনে শুনতে পাই এক অস্ফুট আর্তনাদ।

স্নাতকোত্তরে উত্তীর্ণ হ‌ওয়ার মধ্য দিয়ে আমার উত্থান-পতনময় শিক্ষাজীবনের আপাত পরিসমাপ্তি ঘটল। শিক্ষাজীবনে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া, এ+ পাওয়া অথবা কোনো পরীক্ষায় বা শ্রেণিতে প্রথম হ‌ওয়ার নজির যেমন আছে, তেমনি অকৃতকার্য হ‌ওয়ার‌ও নজির আছে। এমন‌ও সময়‌ এসেছিল, যখন পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। যাহোক, শেষটা যেহেতু মোটামুটি ভালো হলো, সেহেতু তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলা যায় ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’!

কিন্তু এই যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেল, এটা এখন বড় বাজে। বর্তমানে আমার পরিচয় কী? বাসে যখন ‘ছাত্র’ বলে হাফ ভাড়া দিই, তখন বিবেক দংশন করে। বলা যায় এখন পরিচয় সংকটে (আইডেন্টিটি ক্রাইসিস) ভুগছি। ‘বেকার’ তো কোনো সুখকর পরিচয় হতে পারে না।

বোধ করি জীবনের স্বর্ণালি সময়টাই পেছনে ফেলে এলাম। চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ  ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়ানোর; নির্ভার, নির্ঝঞ্ঝাট, পিছুটানহীন জীবনযাপনের প্রশান্ত সুন্দর দিনগুলোকে বিদায় জানালাম। উচ্ছল গল্প-হাসি-আড্ডার দিনগুলো বুঝি শেষ। কত কথা, কত স্বপ্ন এই ছাত্রজীবনকে ঘিরে আমাদের। ছোটবেলায় আমরা রচনা লিখি ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, আমার জীবনের লক্ষ্য, দেশপ্রেম ইত্যাদি। জীবনের লক্ষ্য পূরণের ভিত্তি রচিত হয় এই ছাত্রজীবনেই; বিশেষত চিকিৎসা, প্রকৌশল, বিমান চালনা প্রভৃতি কারিগরি পেশার ক্ষেত্রে তা অধিক প্রযোজ্য। আমি ছাত্রজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মনোবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক-সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ব্যবসায়ী মেলা কিছু হতে চেয়েছি! আবার ‘ক্রাইম প্যাট্রোল’ দেখতে দেখতে পুলিশ অফিসার হয়ে মানুষকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা জেগেছে। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে অধ্যয়নকালে একবার গণিতের মৌয়েজ্জেমা ম্যাম সবার জীবনের লক্ষ্য জানতে চাইলেন। সবাই গতানুগতিকভাবে বলছিল। আমি বললাম চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চাই। সবাই নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে বললেও ম্যাম আমাকে ডায়াসে দাঁড়িয়ে বলতে বললেন কেন তা হতে চাই। পরে দেখেছি কলেজের অনেকে আমাকে সেই ছোট্ট ঘটনাটা দিয়ে মনে রেখেছে- তুই তো সেই, যে মৌয়েজ্জেমা ম্যামের ক্লাসে…।

দেশপ্রেম প্রমাণের মোক্ষম সময় এই ছাত্রজীবন, যা আমরা এই তো কয়েক মাস আগেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেখলাম। অকাতরে প্রাণ দিল কত ভাই, অন্ধত্ব-পঙ্গুত্ব বরণ করল কতজনে। অজস্র অশ্রুগাথা রচিত হলো এই আন্দোলনে। ‘১৮-র কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন মূলত ছাত্ররাই করেছে। এ বাদেও ’৫২, ’৬৯, ’৯০সহ ইতিহাসের পরতে পরতে রয়েছে ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা। উনসত্তরে হেলাল হাফিজ ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতায় লেখেন—

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

নজরুল লিখেছেন-

যুগে যুগে রক্তে মোদের

সিক্ত হ'ল পৃথ্বীতল

আমরা ছাত্রদল।

শামসুর রাহমান লিখেছেন-

স্বাধীনতা তুমি,

বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর ঝলকানি লাগা সতেজ ভাষণ।

আমার বিশ-বছর-ছাত্রজীবনের হিসাবের খাতা খুললে তাতে উল্লেখযোগ্য, লক্ষণীয় তেমন কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। জ্ঞান আহরণ বা উৎপাদন, খেলাধুলা, আন্দোলন-সংগ্রাম, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কোনো কিছুতেই দৃঢ় পদচারণ করা হয়নি। বড়‌ই নিরীহ, নিস্পৃহ ছাত্রজীবন কাটল আমার। অথচ মাত্র একুশ বছরেই পরলোকে পাড়ি জমানো কিশোর কবি সুকান্ত ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতায় বলেন-

এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য

প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য!

তো আমার অবস্থা-হেমন্তের গাওয়া একটি গানের ভাষায়-

বুঝিনি চলার পথে কী ছিল দেবার

সে পথে নিজের করে কী ছিল নেবার।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ভাষায়-

হায়! আমি কী করিলাম এত দিন?

দিন যত, গত তত, দিন দিন দীন!

কবিগুরুর ভাষায়-

আমার জনম গেল বৃথা কাজে

আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে।

আমার তো ‘বৃথা’ কাজ‌ ও করা হলো না। কার‌ ও সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের আলাপে আমার ‘প্রমিত’ বচন ও বাচনভঙ্গি শুনে ঈষৎ মুগ্ধ হয়ে এক পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস করে বসেন আমি আবৃত্তি করি কি না, কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনে যুক্ত আছি কি না, আমার ‘হাই সিজি’ আছে কি না ইত্যাদি। উত্তরে কবি নীরব থাকেন! তবে ‘হিমুর’ একটা কথা মাঝেমধ্যে আমিও বলি, ‘কবিতা-টবিতা আমি পড়ি না। তবে কয়েকটা জটিল কবিতা মুখস্থ করে রেখেছি, যাতে মাঝেমধ্যে মানুষকে শুনিয়ে ভড়কে দেওয়া যায়!’ পয়লা আলাপে প্রায়ই আরেকটা প্রশ্নের মুখোমুখি হ‌ই- প্রেম করি কি না। কার‌ও কার‌ও ধারণা আমি ‘লেডি কিলার’! অথচ হকিকত একেবারে ভিন্ন। যেখানে হুমায়ুন আজাদ আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘তুমি শুধু আমার প্রতিভাকেই ভালোবাস, আর ভালোবাস ঐ পুঁজিপতি গাধাটাকে’- সেখানে আমার পুঁজি তো নেইই, প্রতিভাও নেই। এ ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলাম অবশ‌্য ভিন্নতর আহ্বান করেছেন- আমায় নহে গো, ভালোবাস শুধু, ভালোবাস মোর গান।

হ্যাঁ, সৃষ্টিশীল বা কাজের কিছু একেবারে‌ই যে করা হয়নি তা–ও অবশ্য নয়। না, এক্ষণে তার ফিরিস্তি দিতে উৎসাহী ন‌ই। মাঝে মাঝে মনে হয় মেধার অপচয় করেছি। অনেক কিছুই হয়তো করতে, বলতে বা লিখতে পারতাম। কিন্তু ভাবনাগুলোর উদ্‌গিরণ না হয়ে ধোঁয়ার ন্যায় কুণ্ডলী পাকিয়ে কেবলই গুমরে গুমরে মরেছে। অথচ- ‘কত যে কথা ছিল, কত যে ছিল গান/ কত যে বেদনা আর না-বলা অভিমান।’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সুইস মনোবিদ কার্ল জাংয়ের মনঃস্তত্ত্ব প্রকরণানুযায়ী নিজেকে আমার মূলত অন্তর্মুখী স্বভাবের মনে হয়। বড়জোর ‘এমবিভার্ট’ বলা যায়-অন্তর্মুখিতা এবং বহির্মুখিতার এক মিশেল রয়েছে আমার স্বভাবে। ক্যাম্পাসে অনেকের চেয়ে আমার পরিচিতি কম, আবার অনেকের চেয়ে বেশি। [পরিচিতি পাওয়া অবশ্য আমাদের বিশেষ প্রার্থিত কোনো বিষয় হ‌ওয়া উচিত নয়, বিশেষত, যখন তা ‘ফুটেজ খাওয়ার’ সমার্থক হয়।] আর এই অধুনাকালে ব্যক্তিসত্তা নির্মাণের অন্যতম বড় ক্ষেত্র হলো অন্তর্জালের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো, বিশেষত ফেসবুক। এখানেও আমি ভীষণ আনাড়ি। আমার সঙ্গে যেন এসব যায় না। তাই নিজেকে আমার ফেসবুক- পূর্ব জমানার সঙ্গে জুতস‌ই মনে হয় এবং প্রায়ই আমার খেয়ালি মনের মনে হয়- যোগাযোগ প্রযুক্তির এত অগ্রগতি হ‌ওয়ার না হলেও পারত, অ্যানালগ ফোন পর্যন্ত‌ই ঠিক ছিল!

সামনে কর্মজীবনে এবং হয়তো সংসারজীবনে প্রবেশ করতে হবে। ‘সংসার’ শব্দটা উচ্চারণ করলেই মনের মধ্যে তৈলাক্ত, যেন বা পঙ্কিল একটা ভাব আসে; স্টার জলসা কিংবা জি- বাংলার সিরিয়ালের সাংসারিক কূট-ক্যাঁচালের ন্যায়! জনৈক গল্পকার বলেছিলেন—

একটা চাকরি পেলেই বিয়েথা করে তৈলসিক্ত সংসারী বনে যাই। কতটুকুই বা আমাদের চাহিদা!

নৃবিদ্যার মানস স্যার বিবিধ বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ে পাঠ গ্রহণ বা যুক্তিতর্কের জন্য ছাত্রত্বকাল‌কেই শ্রেয় সাব্যস্ত করে বলেন—আর যখন সংসারী হয়ে বিভাগের পুনর্মিলনীতে আসবেন, তখন পুত্রের মেধা বর্ণনা বৈ অন্য কাজ আর হবে না!

পরিশেষে, মুকুল দত্তের লেখা একটি গানের ভাষায় নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিই—

যা কিছু পেয়েছি কাছে তাই সঞ্চয়

যা কিছু পেলাম না তো সে আমার নয়।

কিংবা লতার গানের ভাষায়-

যা কিছু হারায়ে গেল যাক না

নীল আকাশে মেলো পাখনা!

দাও দাও রে মেলে পাখনা…

*লেখক: আবুল বরকত জয়, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়