জয়, বনবিবির জয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মোহনবাবু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঘর থেকে আনমনে পা বাড়ায় দখিনের ছোট্ট বারান্দার দিকে। চৈত্রের বৃহস্পতি। দখিনা হাওয়া, বসন্তদূতের পঞ্চম স্বর, প্রসন্ন প্রহর। কিন্তু অফিসফেরত মোহনবাবুর চিত্ত বড়ই বিষণ্ন। শহরের কলকারখানা, যন্ত্রযান আর জনকোলাহলে ক্লান্তশ্রান্ত তার দেহটা চাইছে মুক্ত হাওয়ার পরশ, খোলা মাঠের উদাস সান্নিধ্য; মনটা চাইছে নদীর কলতান, পাখির কাকলি, বনফুলের সুবাসে মগ্ন হতে; অতঃপর সন্ধ্যার আঁধারে বাঁশবনের আড়ালে জোনাকি পোকার মিছিলে হারিয়ে যেতে।

বারান্দায় পা দিতেই তার নজর চলে যায় পথের সঙ্গী ফিনিক্স সাইকেলটাতে। পর্দা সরিয়ে তিনি আবার ঘরে ঢোকেন। লুঙ্গি ছেড়ে পরেন পায়জামা-পাঞ্জাবি। আগামীকাল শুক্রবার ভেবে সাইকেলটা নিয়ে নামলেন তার ছোট্ট আঙিনায়। অতঃপর পা রাখলেন সাইকেলের প্যাডেলে। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে চললেন ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, স্মৃতিগাথা গ্রামের উদ্দেশে।

শহর থেকে দূরে বোরোর শ্যামল খেত। তাতে বইছে বাসন্তী হাওয়ার মতুয়া মাতম, নীলাকাশে দু-একখানা সাদা মেঘের নিরুদ্দেশ যাত্রা, বনবীথিতে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা। নিচে সাদা পাল বুকে করে ধলেশ্বরীর দ্রুত বয়ে চলা, ধবল বকেদের নীড়ে ফেরার প্রস্তুতি। ধীরে ধীরে প্রকৃতিজুড়ে গোধূলির আয়োজন। মোহনবাবুর মনে পড়ে যায়:
চৈত্রের গাঁজন, বোশেখের মেলা, আষাঢ়ের রথযাত্রা, আশ্বিনের বিজয়া, কার্তিকের দোল-দীপালি; বারোয়ারি তলার শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়া; বাড়ির আঙিনার তুলসীমঞ্চ, শিউলিতলা।

বালখিল্যের স্মৃতিসাগর সাঁতরাতে সাঁতরাতে, সাইকেলে সওয়ার হয়ে শহর পেরিয়ে পল্লির পিচঢালা পথে মোহনবাবু চলেছেন গ্রামের শ্যামলছায়ার পরশ পেতে, বাল্যবন্ধুদের সান্নিধ্য লাভে। হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল মেঠো পথের অদূরে ঝুরিদোলা সাতপুরুষের সেই অশ্বত্থের পানে, বিস্তীর্ণ ভূমিজুড়ে তার অবস্থান, শত শত তার শাখা-প্রশাখা। যার ছায়ায় চৈত্রসংক্রান্তিতে চলত গাঁজনের নাচ, পয়লা বৈশাখে বৈশাখী মেলা, আষাঢ়ে রথের মেলা, কার্তিকে রাস-উৎসব, অগ্রহায়ণে নবান্ন; যেখানে ফাগুনের দোল উৎসবে মোহনবাবু গিরিবালাসনে দুলেছিল বটের ঝুরির দোদুল দোলায়।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আজ দেখেন তার শ্রান্ত ছায়ায় হাজির আয়ুদায়ী, পর্ণমোচী, চিরহরিৎ, পত্রত্যাগী, ফলপাকান্ত, কল্পতরু, ঔষধি, অপুষ্পক-সপুষ্পক, নামগোত্রহীন কুলীন-অকুলীন, চেনা-অচেনা সব বৃক্ষ। বসেছে বর্ষশেষের চড়ক অধিবেশন। মোহনবাবু নামলেন সাইকেল থেকে। কান পাতলেন তাদের আলাপ-আলোচনায়। অ্যাজেন্ডা তাদের:

১. দুর্বৃত্ত দুরাচারী আদমসন্তান,
২. বৃক্ষকুলের অস্তিত্ব রক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম,
৩. বিবিধ।

অধিবেশনে পৌরোহিত্য করছেন বৃক্ষকুলের প্রপিতামহ লাখ পত্রপল্লবে শোভিত অশীতিপর অশ্বত্থ বৃক্ষ।

একই সঙ্গে যিনি কয়েক হাজার অমৃতের সন্তানকে ছায়া দিতে পারেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় আছেন চিত্রকূট পর্বত থেকে আসা অর্জুন বৃক্ষ। সভা শুরু। সমবেত পাদপকুলের আকুল মিনতি:

‘আমরা দুর্বৃত্ত মানবসন্তানের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার বলি হতে চাই না। তাদের নিষ্ঠুর কুঠারে-করাতে আর আত্মাহুতি নয়, আর নয় বৃক্ষরাজির ধ্বংসযজ্ঞ। সম্মানিত সভাপতি, আপনার মাধ্যমে আমরা সভার সিদ্ধান্ত চাই।’

সাইকেল থেকে বাঁ পা মাটিতে নামিয়ে মোহনবাবু বিস্ময়ের সঙ্গে অধীর আগ্রহে কান পেতে তাঁদের বক্তব্য শুনতে লাগলেন। কয়েক ঝাঁক পাখি এসে সভাপতি মহোদয়ের শাখা-প্রশাখায়, পত্রপল্লবের আড়ালে আশ্রয় নিল। সভাপতি মহোদয় নড়েচড়ে বসলেন। সমবেত কণ্ঠের প্রতিবাদধ্বনি ভেসে এল মোহনবাবুর কর্ণকুহরে:

‘পরিত্রাণ চাই। কৃতঘ্ন মানবকুলের হাত থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই, মুক্তি চাই।’

ঔষধি বৃক্ষরাজি হরীতকী, আমলকী, বহেড়া, নিম, নিশিন্দা, শিউলি, চিরতা, তুলসী প্রভৃতির প্রতিনিধি গন্ধমাদন পর্বত থেকে আসা বিশল্যকরণী বলল, ‘মান্যবর সভাপতি, আপনি অবগত আছেন সৃষ্টির আদি থেকে আমরা নিঃস্বার্থভাবে মানবসন্তানদের সেবায় নিয়োজিত। আমাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।

কিন্তু মানবজাতি নিমকহারাম। তারা আমাদের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি প্রকাশ করে না। কারণে-অকারণে তারা আমাদের নিধনে ব্যস্ত। আর আমরা সারাব না উদরাময়, অতিসার, অগ্নিমান্দ্য, অরুচি, জন্ডিস, কর্কট, শ্লেষ্মা, বাধক, সুতিকা, মধুমেহ, ধনুষ্টঙ্কার প্রভৃতির মতো দুরারোগ্য ব্যাধিসমূহ। ঔষধি হিসেবে আর আমরা হব না ব্যবহৃত।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ফলপাকান্তের প্রতিনিধি ফলের রাজা আমের গর্ভধারিণী রসালো বলল, ‘আজ থেকে আমরা ফলাব না ফল।’

বশরা থেকে আসা সৌন্দর্য ও সুগন্ধি পুষ্পের প্রতিনিধি, রূপের রানি গোলাপ সপ্তম সুরে ঘোষণা দিল, ‘আজ থেকে আমরা ফুটব না, মেলব না আঁখি, বিলাব না গন্ধ, ঢালব না নির্যাস।’

সাগরপাড় থেকে আসা নারিকেল বৃক্ষ তার লম্বা শাখা দুলিয়ে বলল, ‘আজ থেকে আমরা দিব না সুস্বাদু জল, দিব না দুগ্ধসর শাস।’

শাল, সেগুন, মেহগনি একত্রে ধ্বনি তুলল, ‘আজ থেকে আমরা হব না মানব-মানবীর শয্যাসঙ্গিনী। হব না দ্বারের প্রহরী।’

উপস্থিত বৃক্ষ প্রজাতির লাখ সদস্যের কণ্ঠে একযোগে ধ্বনিত হলো: ‘এ মুহূর্ত থেকে আমরা দুলাব না শাখা-প্রশাখা, নাড়ব না পত্রপল্লব, আমরা বিলাব না ফুল, ফল, ঔষধি; বিলাব না জীবন নির্যাস অম্লজান।

চলুন, আমরা বনবিবির কাছে যাই। তার কাছে পেশ করি স্মারকলিপি। সেবা কোনো দিন এক পক্ষের হয় না। আমরা চাই না অকৃতজ্ঞ মানবজাতির খেয়াল-খুশি, কামনা-বাসনার শিকার হতে। চাই না তাদের ভোগ-বিলাসের বলি হতে। আজ থেকে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আমরা নিরুপদ্রব বেঁচে থাকার অধিকার চাই। আর আমরা বসুধাকে রূপ-রস-গন্ধে যৌবনবতী করতে চাই না।’

সভার সভাপতি বটবৃক্ষের শাখা-প্রশাখায় তখন অবস্থান করছিল টিয়া, চন্দনা, শ্যামা, সারস, বায়স, বুলবুলি, কোকিল, দোয়েল, ডাহুকসহ হাজারো পাখি। তারা একযোগে ডানা ঝাপটাল। যে যার স্বরে উচ্চকণ্ঠে বলল: ‘হে বৃক্ষকুল, সৃষ্টির শুরু থেকে তোমরাই আমাদের আশ্রয়দাতা, আহারদাতাও। সুখে-দুঃখে তোমরাই আমাদের আশা-ভরসা। আমাদের বেঁচে থাকা তোমাদেরকে কেন্দ্র করে। আমরা আছি তোমাদের সঙ্গে। নিষাদ মানবকুল আমাদের বসতে দেয় না তোমাদের শাখায়, উড়তে দেয় না নীলাকাশে। ওদের তির-ধনুক, বন্দুকের ভয়ে আমরা সন্ত্রস্ত; ওদের যন্ত্রদানব আর কলকারখানার হুংকারে আমরা আতঙ্কিত। আর আমরা মিষ্টি কণ্ঠে ডাকব না, পঞ্চম স্বরে গাইব না গান। মধুর কাকলিতে ঘুম ভাঙাব না মানবজাতির। আমরা ওদের শিকারে পরিণত হতে চাই না। আমরা চলে যাব গ্রহান্তরে।’

তখন সভাপতি মহোদয় খুকখুকিয়ে কাশলেন। পক্ষিকুলকে শান্ত হয়ে তার শাখা-প্রশাখায় বসতে অনুরোধ করলেন। হুক্কাটা শালবৃক্ষের হাতে দিলেন। তারপর ধীরোদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন: ‘বন্ধুগণ, তোমাদের সবার বক্তব্য, সকল প্রস্তাব আমি গভীর মনোযোগসহকারে শুনেছি। তোমরা অনেক দূরদূরান্ত থেকে অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় করে নির্দিষ্ট সময়ে আমার এখানে এসেছ। এ জন্য আমি তোমাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমার অনেক বয়স হয়েছে। পরিচর্যার অভাবে আমার প্রজাতি আজ বিরল, বিলুপ্তপ্রায়। ক্ষোভে, শোকে, দুঃখে, বিরহে, যন্ত্রণায় আমি ক্লিষ্ট। আমার ব্যর্থতা তোমাদের অভিভাবক হিসেবে আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। তোমাদের সহযোগিতায় মানবকুলকে আমি ছায়া দিয়েছি, মায়া দিয়েছি; দিয়েছি আহার, আশ্রয় ও সুরক্ষা। বিনিময়ে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে ধরেছে কুঠার, চালিয়েছে করাত। আমার বয়সের নাড়ি-নক্ষত্র ওরা কেউ জানে না। তোমাদেরও আমি আজন্ম দেখছি।

তোমরা বড়ই সহিষ্ণু। তোমাদের সকল প্রস্তাব, সমস্ত দাবি যুক্তি, ন্যায় ও বোধে সুসংগত। কিন্তু তোমাদের মনে রাখতে হবে তোমরা ধৈর্যের প্রতীক, সহিষ্ণুতার ধারক, দানের বাহক, সেবায় অকৃপণ। তোমরা নীরব দানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টান্ত। তোমরা অকাতরে সর্বস্ব দিয়ে দাও, ফুল-ফল, পত্র-পল্লব, ছাল-বাকল, কাণ্ড-মূল সবই। বিনিময়ে চাও না কিছুই। জননী বসুমতী তোমাদের দাবি অস্বীকার করতে পারবে না। তোমরা তো ঈশ্বরের আশীর্বাদ। ধরিত্রীর সুবোধ সুশীল সন্তান। সেবাই তোমাদের ধর্ম, ত্যাগই তোমাদের ব্রত। এটাও মনে রেখো, মানুষ ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি; ওদের বলা হয় ‘অমৃতের সন্তান’, ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট সব জীবের মধ্যে একমাত্র মানুষকেই দিয়েছেন জ্ঞান, বুদ্ধি সর্বোপরি সুন্দর একটি মন, দিয়েছেন ঈশ্বরের অমূল্যধন-বিবেক। ওদের অভিষেক অনুষ্ঠানে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল।

প্রজাপতি ব্রহ্মা মানবজাতির অভিষেক অনুষ্ঠানে সভাপতির দীর্ঘ বক্তৃতায় মানবজাতিকে উপদেশ দিয়েছিলেন, তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, দিয়েছিলেন তাদের জীবনচলার বিধান। তাদের শপথবাক্যও পাঠ করিয়েছিলেন। কিন্তু মানবজাতি ভুলে গেছে ওদের প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞার কথা; ভুলে গেছে সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রতি ওদের দায় ও দায়িত্বের কথা। ওরা এখন ভোগ-বিলাস-ব্যসনে হাবুডুবু খাচ্ছে। ভোগের বাসনায় ওরা আজ অন্ধ, বিবেকবিবর্জিত। ওদের কারণেই স্রষ্টার অন্য সদস্যদের আজ এত দুঃখ, কষ্ট, বেদনা। মানুষেরও সুখের দিনের অবসান ঘটতে চলেছে। ওদের প্রতি ঈশ্বরের কৃপা অশেষ। কিন্তু মানুষ সীমা লঙ্ঘন করেছে। আর সীমা লঙ্ঘনকারীকে ঈশ্বর কখনো ক্ষমা করেন না। ওরা মরবে, ফাঁসিকাষ্ঠে নয়, কারাপ্রকোষ্ঠে, যাবজ্জীবন কয়েদির বেশে তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে।

ওদের রোগে ওষুধ জুটবে না, জ্বরায় পাবে না চিকিৎসা, পাশে থাকবে না কোনো সঙ্গী। মরণে শ্মশানযাত্রী হবে না কেউ। ঈশ্বর ওদের শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছে করোনা, এরপর আসবে বরুণা, তারপর হয়তো অরুণা কিংবা ভিন্ন কেউ। ওরা চক্রব্যূহে সপ্তরথী দ্বারা আক্রান্ত হবে। ওরা চক্রব্যূহে ঢুকতে শিখেছে, কিন্তু বের হওয়ার মন্ত্র ওদের জানা নেই। ওদের শিক্ষা সমাপ্ত হতে দাও। ওরা ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ দেখেনি। ওদের দেখার অনেক বাকি। আসছে ধরিত্রী সম্মেলন। দেখা যাক পশ্বাধমদের হালচাল, হিসাব-নিকাশ, ন্যায়-ন্যাকামি, প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতির ধরন-ধারণ; দেখা যাক ওদের দীক্ষা ও দর্শন।’

উপস্থিত সভ্যমণ্ডলী সমস্বরে ধ্বনি তুলল: ‘তথাস্তু!’

মোহনবাবু বিস্ময়ে হতবাক, সংবিৎহারা; লজ্জায় ম্রিয়মাণ, আত্মগ্লানিতে বিমর্ষ, সংকুচিত। সাইকেলের প্যাডেলে পা উঠছে না তার। পশ্চাৎ থেকে প্রশ্নবাণ:
‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?’

কম্পিতকণ্ঠে মোহনবাবু বললেন, ‘পেয়েছি পথের ঠিকানা। এসো বন্ধু, কাটো বলাকার টিকিট; চলো যাই ধরিত্রী সম্মেলনে।’

কিছু দূর যেতেই শৈশবের বন্ধুরা এসে মোহনবাবুকে ঘিরে ধরল। সবাই মিলে চলল ধরিত্রী সম্মেলনে। কণ্ঠে তাদের ধ্বনিত হলো:
‘জয়, বনবিবির জয়! জয় ধরিত্রীমাতার জয়!’

  • নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]