যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন…
আতিয়ার রহমান। মুকসুদপুর তোমার জন্মস্থান। এ মাটি সবাইকে কাছে টেনেছে। এই মাটি ধন্য। এই মা চিরগর্বিত। এই পবিত্র ভূমি লড়েছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগপর্যন্ত যুদ্ধ জারি রেখেছে। বৃহত্তর এ মাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্ম নিয়েছেন। এ যে বাংলার তীর্থভূমি।
একাত্তরের মুক্ত এলাকায় সিভিল প্রশাসন গড়া হয়েছিল তোমারই নেতৃত্বে। তুমি ছিলে আঞ্চলিক প্রশাসক। তখন তুমি টগবগে তরুণ। আহা কী সেই দিন! সেই প্রশাসনের সদস্য ছিলেন মুন্সী আতিয়ার রহমান। গোপালগঞ্জ জেলা বারের এখনকার সভাপতি। আরও দুই সদস্য ছিলেন মুকসুদপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. রওশন আলী মিয়া এবং আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জব্বার মোল্লা। এত বড় বড় লোকের সমাবেশ ঘটিয়েছিলে তোমার প্রশাসনে। সত্যিই বর্ণাঢ্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলে তুমি।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তোমার আছে গর্বের স্মৃতি। ১৯৬৬ সালে ছাত্রাবস্থায় কারারুদ্ধ হয়েছিলে তুমি। তখন যশোর কারাগারে দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ১৯৬৯ সালে দিগনগর জনসভা শেষে বঙ্গবন্ধু তোমাকে মুকসুদপুর থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত করেন। ১৯৭০–এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে তোমারই নেতৃত্বে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুকে এস জে হাইস্কুল মাঠে নিয়ে আসেন। সবাই ‘শাবাশ আতিয়ার’ বলে অকুণ্ঠ ভালোবাসা জানিয়েছিলেন তোমাকে।
তুমি একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করেছ। দেশের মানুষের হয়ে অস্ত্র ধরেছ। এ কারণেই থানা পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা এসেই রাজাকারদের সমন্বয়ে প্রথম অগ্নিসংযোগ করে তোমার বাড়িতে। তারপরও ওরা তোমাকে টলাতে পারেনি। জীবনকে বাজি রেখে ছুটেছ হাজার সন্তানকে সংগঠিত করার কাজে।
তুমি তোয়াক্কা করোনি পাকিস্তানি বাহিনীকে। বিলি কেটে এগিয়েছ শত্রুর হাত থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে। কিন্তু এত সতর্কতার পরও রেহাই পাওনি। ধরা পড়েছ। নেওয়া হয়েছে শত্রুশিবিরে। অকথ্য নির্যাতন সয়েছ। তবে নিজের জায়গা থেকে সরোনি। তোমার জ্বলজ্বলে মুখ আর লাগাতার সংগ্রামের প্রত্যয় কার না নজর কেড়েছে?
খেলায় কোথায় না তুমি শ্রেষ্ঠ ছিলে? তোমার ছিল অসাধারণ নৈপুণ্য। সে খেলায় কোনো ঔদ্ধত্য ছিল না, ছিল ছন্দ। ছন্দছাড়া খেলে একজন তরুণের ছন্নছাড়া হওয়া কাম্য হতে পারে না। সেদিন সদর ঈদগাহ ময়দানে তোমার বন্ধুরা সে কথাই বলে গেলেন। আতিয়ার রহমান তুমি ফুটবলে সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলতে। স্যান্ডো গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট আর বুট—সবই তোমার সাদা রঙের। এমন কম্বিনেশনে দেখতাম তোমাকে। নগরকান্দার মারুফ হোসেন চৌধুরী বললেন, ফুটবলে আতিয়ার রহমানের শট, তাঁর ছুটে যাওয়া আজও নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে সবার মানসলোকে। রবিউল-টুটুল-সাইয়েদ জামানার রবিউল আলম শিকদার শ্রদ্ধায় স্মরণ করলেন খেলায় আতিয়ার রহমানের ধ্রুপদী পদচারণ। আর সাংগঠনিক কর্ম?
১৯৮৬ সালের কথা। মহব্বতজান চৌধুরী তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গোপালগঞ্জ-১ আসনের ফলাফল ঘোষণায় নির্বাহী কর্মকর্তার ওপর ওই মন্ত্রী চাপ প্রয়োগ করলে তুমি স্থির থাকতে পারোনি। ছুটে গেছ গোপালগঞ্জে। শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে মুকসুদপুরের সাত কেন্দ্রের ফল স্থগিত করার ব্যবস্থা করেছ। এ তোমার সাংগঠনিক কৃতিত্ব। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন এই এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
একসময় কমলাপুর কিংবা মহারাজপুর খাল হয়ে স্পিডবোটে গোপালগঞ্জ যাত্রা ছিল তোমার জন্য অবারিত। যুব ফ্রন্টের সাংগঠনিক কাজে সদা তৎপর তুমি। প্রশাসনও তোমাকে সহযোগিতা করেছে কিংবা তাদের কাছ থেকে সেই সহানুভূতি আদায় করে নিয়েছ। সেই জন্যই সবার নির্ভরতা।
এরপর মোটরসাইকেলের ওপরই দেখেছি তোমায়। অমুক জায়গায় রাস্তাটি হয়নি। বেসরকারি অমুক উন্নয়ন সংস্থার হাতে আছে স্কুল উন্নয়ন প্রকল্প। তুমি মুকসুদপুর আর ঢাকায় যেতে লাগাতার। রাস্তা, স্কুল বা মসজিদের অনুকূলে বিশাল বাজেট নিয়ে এলাকায় ফিরতে বীরের বেশে। আমরা বিস্মিত হতাম।
মাত্র ২৪ বছর বয়সেই জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব নিতে হলো। চারবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছ। পরবর্তী সময়ে পৌরসভার মেয়র। হাতে–কলমে প্রশিক্ষণের জন্য এ সময় ১৩ দেশ ভ্রমণ করেছ। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছ শতভাগ। প্রতিষ্ঠানটিকে তৃতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেছ। তোমার অবদান ভুলে যাওয়ার নয়।
কর্মের সঙ্গে মানবিকতার যোগ ছিল তোমার প্রতিটি পদক্ষেপে। ফরিদপুরের চরযশোরদী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ‘সাহেব ফকির’ সেই কথাটিই বোঝালেন আরও পরিষ্কার করে। চোখে দেখা মানুষের মধ্যে আতিয়ার রহমান এমন এক ব্যক্তি, যিনি সই করতে সময় নেননি।
মাত্র কয়েক দিন তোমার ক্লাস করেছি। কিন্তু সারা জীবন শিখেছি তোমার সাহচর্যে। দুই সূত্রেই তুমি আমার শিক্ষক। তোমার কাগুজে নাম আতিকুর রহমান মিয়া। কিন্তু আতিয়ার রহমান নামেই সবাই জানেন। বলেন, আতিয়ার মিয়া। রাজনীতির সম্পর্কে সবাই তোমাকে আতিয়ার ভাই বললেও আমি কিন্তু ওই অভ্যাস রপ্ত করতে পারিনি। স্যারই বলতাম। একইভাবে আমার অর্ধাঙ্গিনী উল্কা সরকারকে তুমি পেয়েছ কন্যা হিসেবে। যেমন করে আরিফা রহমান রত্না, বিউটি ধর আর রাকিবা ইয়াসমিন রোজীকে জানে সবাই।
কী অদ্ভুত টান ছিল হৃদয়ে! চোখের অসুস্থতার সময়ও দূর থেকে উল্কাকে চিহ্নিত করতে বেগ পেতে হতো না। ‘এস উল্কা, এস।’ যেন স্নেহের আঁচল পেতে বসে আছ। কিংবা প্রবাসী হওয়ার পরও যাত্রাপথে আবুধাবি বিরতিতে চলে এসেছ প্রিয় ছাত্রের বাসভবনে। আতিথ্য গ্রহণ করেছ আর বরাবরের মতোই শাকান্নে তৃপ্ত থেকেছ।
এই তো সেদিন আমরা দুজন দেখা করলাম তোমার কমলাপুরের বাসভবনে। তখন আমরা কি জানতাম, এরই মধ্যে বিদায় নিতে হবে তোমাকে! আমাদের ঢাকায় যেতে হবে আগামীকালই। শুনতেই গাড়ির বন্দোবস্ত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লে। আমরা গাড়ি নিইনি, তবে ভালোবাসা ফেলে আসিনি।
সত্য আর সুন্দরের পূজারি ছিলে তুমি হে গুরুদেব! তাই তো সেই সময় আজকের মন্ত্রী ফারুক খানকে মুকসুদপুরের রাজনীতিতে স্বাগত জানাতে ভুল করোনি। এই কর্ম পরিচালনা করা হতো ঢাকার রামপুরার আমাদের সেই সময়কার বাসা থেকেই। এ ঘটনায় আমরা ছিলাম তোমার সহযাত্রী। বলা যায়, তোমার সেই প্রয়াসে আমরা পেয়েছি যোগ্য প্রতিনিধি, মানুষ পেয়েছে দেশপ্রেমিক এক।
বুকের ভেতরে বড় অভিমান জমেছিল বুঝি তোমার!
না আগে এমনটা দেখিনি। বাউল ছিলে না কখনো। পরিচ্ছন্ন পোশাক, পরিপাটি জুতা। কথাবার্তায় আধুনিক। সব সামলানো এক তরুণ।
চৌকষ মানুষটি কি তাহলে ভেতরে–ভেতরে বাউল রাগে দাদরা তালে ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ গলায় ভাজতো? হয়তোবা তা–ই। তা না হলে কী করে বাংলার প্রকৃতি, গ্রামীণ সৌন্দর্য, মানুষের মধ্যে মানুষের সম্পর্ক সামনে এনেছ প্রগাঢ় ভালোবাসায়!
গানে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য বুঝে নিতে হয়। সে জন্য প্রয়োজন হয় তালের। তালকে তুমি আত্মস্থ করে নিয়েছ। মৃদঙ্গের সঙ্গে তবলা। কী টলটলে যৌবন সে দাদরা দোলায়। এ বেলায় নিশ্চিত তুমি বিরহের কিনারা ছুঁয়েছ।
কোমল তখন মধুর রসে মনের গভীরে এক আজলা শান্ত রসের মোচড় যে অন্য রকম ব্যঞ্জনা আনে। আরও খোলতাই হয় বৈরাগ্য। তোমার অবর্তমানে সেই অনুভূতি আজ দমকা হাওয়ার মতো ছড়িয়ে যায়।
এক স্থান থেকে অন্যস্থানে সরানো হচ্ছিল তোমাকে। রাজনীতির আশরাফ আলী আশু মিয়া, মহিউদ্দিন আহমেদ মুক্তু, চলতি মেয়র আশরাফুল আলম শিমুল তখন বেদনায় বিমর্ষ। পারিবারিক সদস্য আহাজ্জাদ মহসিন খিপু, কাবীর মিয়া, হুজ্জাদ হোসেন লিটু ব্যস্ত তখন আনুষ্ঠানিক কর্ম পরিচালনায়। আমি দাঁড়িয়ে তোমার প্রাণপুত্র আশিকুর রহমান রনির সামনে। না, আমি তাকে কিচ্ছু বলতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে ফোনে কথা হয় তোমার দৌহিত্রা মাহানুরই রহমান তনিমার সঙ্গে। তাকেও কিচ্ছু বলা সম্ভব হয়নি আমার।
সংবাদের মানুষ হায়দার হোসেন, শিক্ষার নজরুল ইসলাম পান্নু, সংস্কৃতির কামরুজ্জামান মুক্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। হাত উঁচু করে শুধু উপস্থিতির বার্তা দিই। অল্পবিস্তর কথা হয় কলেজ থেকে অবসরে যাওয়া অধ্যাপক অমল দাশের সঙ্গে। নিকটতম বিশ্লেষণ করি। শেষ কয়টা দিন আরও একটু ভালো যেতে পারত, কিন্তু যায়নি। দায় কার, নির্মোহ দৃষ্টে সেটাও বুঝতে চাই আমরা।
রবীন্দ্রনাথের সুরে তাই বুঝি বলতে, তুমি না থাকলে খেয়াতরি বাওয়া হবে না। তানপুরার তারে ধুলা জমবে। কাঁটালতা ঘরের দরজা বেয়ে উঠবে। তোমার অবর্তমানে ঘন ঘাসের ফুলের বাগান বনবাসের মতো হয়ে যাবে। দিঘির ধারগুলো জড়িয়ে ধরবে শেওলারা।
তবে এ কথাও ঠিক, কোনো কিছুই ঠেকে থাকবে না। গরু চরবে, রাখাল খেলবে, বাঁশি বাজবে এবং এ–ও বুঝি, এসবের মধ্য দিয়েই তোমার প্রকাশ। নিজেও বলেছ সে কথা। তুমি সকল খেলায় খেলবে। আসবে–যাবে চিরদিনের সেই তুমি।
তোমার সেই বাণী এক শ ভাগ সত্য। দুঃখ আমাদের ওইখানে, এরপরও তোমার আপসোস। ‘তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে!’...এ কেমন কথা!
দার্জিলিংয়ের ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ বাড়িটাতে মারা যান মেজ কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী। পরে গাজীপুরের এই জমিদার ভাওয়াল সন্যাসী হয়ে ফিরে আসেন। ক্ষুদিরাম বসু ১০ মাস ১০ দিন পর মাসির ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন।
তুমি আতিয়ার রহমানও ফিরবে। তারও শক্তিশালী কারণ রয়েছে। আতিয়ার রহমান মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। আতিয়ার রহমানকে শত্রুশিবিরে বেঁধে রাখা সম্ভব হয়নি।
আতিয়ার রহমান মায়ের কোলভরা ছেলে। তা না হলে রাজনীতির মাঠে ফুল ফোটানো কিংবা খেলার মাঠে বিদ্যুৎ ছড়ানো কয়জনের পক্ষেই সম্ভব হয়।
প্রিয় আতিয়ার স্যার, তুমি মানুষকে ভালোবেসেছ। আবার তাঁদের ভালোবাসায় তুমিও সিক্ত হয়েছ বহুগুণে। তাহলে?
*লেখক: নিমাই সরকার: প্রকৌশলী ও গল্পকার
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]