আমরা কেন ঈদে ব্যাকুল হয়ে বাড়ি যাই

প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

ঈদের সময় বাংলাদেশে মানুষের চলাচল যে হারে বৃদ্ধি পায়, তা অনেক দেশেই কল্পনাতীত। যাঁরা শুধু জীবনধারণের জন্য আপন আবাস ছেড়ে বাইরে চাকরি করেন এবং পরিবার-পরিজনের খরচ চালাতে অক্ষম, তাঁরা বাড়িতে ফিরে যাবেন—এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর বাইরে যাঁদের সামর্থ্য আছে বছরের অন্য সময়ে যাওয়ার, তাঁরাও কেন এই সময় হুমড়ি খান গ্রামের বাড়ি যেতে? অনেক বছর ধরে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি।

হ্যাঁ, ঈদে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু তারপরও জীবনের ঝক্কিঝামেলা, আর্থিক জরিমানা (পরিবহনকর্মীদের জন্য ঈদ হলো টাকা উপার্জনের মৌসুম, কাজেই বাড়তি ভাড়া না গুনে ঈদে বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই), ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরমে–ঘামে বসে থাকা—এত কষ্ট সহ্য করার অনুপ্রেরণা কি শুধুই অনেকের সঙ্গে দেখা করা?

এ বিষয়ে আমার একটি পর্যবেক্ষণ আছে, যার পেছনে ইতিবাচক মনোবিজ্ঞান (Positive Psychology) নিয়ে লেখা অনেক বই এবং সিনেমার ভূমিকা রয়েছে। চোখে আঙুল দিয়ে এটি বুঝিয়ে দিয়েছে ‘অক্টোবর’ নামের একটি সিনেমা।

এই সিনেমায় এক হোটেলকর্মী তরুণী গুরুতর আহত হয়। অপেক্ষাকৃত নতুন কাজে যোগ দেওয়া এক তরুণ পরবর্তী সময়ে জানতে পারে যে দুর্ঘটনার আগে সেই তরুণী তার খোঁজ করছিল। ব্যস, বোহেমিয়ান জীবনের হঠাৎ যেন একটা মানে পাওয়া গেল। এরপর সে প্রতিদিন হাসপাতালে যেতে থাকে। অন্যদিকে তরুণীর মা একা ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিতে থাকে। একসময় সেই কর্মযজ্ঞে তরুণটিও জড়িয়ে পড়ে।

অনেক দিন ধরে দুজনের প্রচেষ্টার পর, অনেক আশা জাগিয়ে, শেষ পর্যন্ত তরুণীটি মারা যায়। এরপর তরুণটি প্রথাগত পেশার বাইরে দূরে কোথাও হোটেল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হয়। তরুণীর মায়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়, মন খুলে কথা হয়। কারণ, দুজনেই তরুণীটির জন্য একই রকম আবেগ থেকে জীবনের অনেক সময় ব্যয় করেছে। ফলে জমা হয়েছে একই ধরনের স্মৃতি। মায়ের কাছে তাই মেয়েটির স্মৃতি স্মরণ করার সবচেয়ে ভালো উপলক্ষ হয়ে ওঠে সেই তরুণের সঙ্গে কথা বলা।

আমাদের গ্রামের নূর মোহাম্মদ আমার সঙ্গেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। আমরা যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করব, তখনই সে অকস্মাৎ আমাদের ছেড়ে চলে যায় পরপারে। ওর বাবা, রুহুল কাকা, যুবক ছেলে হারিয়ে নির্বাক হয়ে যান। যা কাটাতে অনেক সময় লেগেছে। গত ঈদে বালিপাড়া বাজারে কাকার সঙ্গে দেখা হলো। উনাকে বলেছিলাম, ‘আমাদের ব্যাচের একমাত্র ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল নূরের, যা ওর চেয়ে বেশি আমরাই ব্যবহার করতাম। এমন উদার মানুষ হয় না!’ কাকা তখন বললেন, কতভাবে টাকা ম্যানেজ করে নূরকে ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন! যেন হঠাৎ করেই সেই ১৫ বছর আগের দ্বিধান্বিত সিদ্ধান্ত একদম যৌক্তিক মনে হলো।

আসলে কাছের মানুষদের নিয়ে আমাদের একটি নিজস্ব স্মৃতির বাক্স তৈরি হয়। সেই বাক্সের স্মৃতিগুলো একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। জীবনে চলতে গেলে সেই স্মৃতিগুলো আমাদের প্রতিনিয়ত প্রেরণা জোগায়। আবার জীবনের দুঃসহ যাতনায় সেই স্মৃতি মলিন হয়ে যায়, তা থেকে জন্ম নেয় অপরাধবোধ। অন্যদিকে যারা আমাদের প্রিয় মানুষটিকে আমাদের মতোই ভালোবেসেছে, তাদের স্মৃতির ভান্ডার আবার অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি হয়। এমন দুটি স্মৃতির বাক্স মেলানোর অনন্য সুযোগ তৈরি হয় ঈদে! একবার এমন দুটি বাক্স মিলে গেলে মলিনতা ছাপিয়ে যাওয়া যায়!

এ কারণেই বোধ হয় আমাদের সম্পর্কে কবিরা বলেছেন, ‘স্মৃতি দিয়ে ঘেরা!’

*লেখক: মো. মাহবুব হাসান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

‘নাগরিক সংবাদ’-এ নানা সমস্যা, জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]