আদুরে মেয়ে
ঝুম বৃষ্টি। বাসের জানালা পথে তাকিয়ে আছে যাত্রীরা। কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখছে। গভীর আনন্দে।
দূরপাল্লার বাস চলছে। শাঁ শাঁ শব্দ তোলে।
রাস্তার এক পাশ দিয়ে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে সাবের মিয়া। একমনে। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না সে। শার্ট ভিজে একাকার।
তার কোনো তোয়াক্কা নেই। প্যাডেল মারছে দ্রুত। কিন্তু রিকশা তেমন একটা এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। বেলা ফুরানোর আগে বাড়ি যেতে হবে।
সাবের মিয়ার ছোট মেয়ে মিম। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। বাবার ভীষণ ভক্ত। বাবাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। পৃথিবীর সব বাবারা তাদের মেয়েদের একটু বেশি ভালোবাসে। আলাদা চোখে দেখে। সাবের মিয়া ছোটবেলায় তার মাকে হারায়। মা হারানোর কী যে যন্ত্রণা, সে এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
তার মা নেই তো কী হয়েছে! মেয়েটা তো আছে। মা যদি আজ বেঁচে থাকত, তাহলে সাবের মিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে। এই পিচ্চি মেয়েটা তার জন্য এখন অপেক্ষা করে। পথপানে চেয়ে থাকে। কখন আসবে বাবা! ঠিকমতো দুপুরেও খাই না। সে দূরে কোথাও ভাড়া পেলে সময় করে আসতে পারে না। মনটা ভীষণ খারাপ লাগে। কী আর করার, ভাগ্যে যা লেখা থাকে তাই তো হবে। এটা সে বিশ্বাস করে মনেপ্রাণে। সাবের মিয়ার বউ জোর করে ভাত খাওয়াতে চাইলে মিম বলে, ‘আমি কিচ্ছু মুখে দিতাম না। আব্বা আইলে খামু। হেয় আমারে খাওয়ায়ে দিলে খামু।’
রাতে মিম ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সাবের মিয়ার বউ তাকে এসব গল্প শোনায়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় সে। খুশিতে চোখে পানি এসে পড়ে। তার মা হারানোর যন্ত্রণা ভুলে যায়। মাঝেমধ্যে ঘুমন্ত মিমের গালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে, ‘আমার আম্মাটার কত বুদ্ধি!’
মিম দরজায় দাঁড়িয়ে বাবার আসার অপেক্ষার প্রহর গুনছে। একটু পর পর হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি নিচ্ছে হাতের মুঠোয়। মিমের মা শেফালী বেগম রান্নাঘর থেকে চেচিয়ে বলে, ‘এ-ই মাইয়া, ঘরের ভিতরে যা। আবার ঠান্ডা লাগলে কেডা তোরে নিয়ে হাসপাতালে ঘুইরা বেড়াইব। তর বাপ আইবো সন্ধ্যার টাইমে। এত বাপ দুলালী হইলে দুনিয়া চলে না।’
ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে যখন খাটে বই খুলে বসে, ঠিক তখনই রিকশার টুংটাং ধ্বনি ভেসে আসে। তার কর্ণকুহরে। বইটা কোনোমতো বন্ধ করে দরজায় উঁকি দেয়। বাবাকে দেখে খুশিতে লাফালাফি করে বলতে থাকে,
‘তুমি এত দেরি করলা ক্যান?
জানো না আমি তোমার লাইগ্যা খাড়ায়ে থাহি?’
সাবের মিয়া গামছা মাথা থেকে খুলে মুখটা মুছে বলে, ‘এ-ই যে আম্মা কতা দিসছি আর দেরি অইব না। তয় তোমার লাইগ্যা একটা জিনিস আনছি বাজার থেইক্যা।’ বুকপকেট থেকে ললিপপ বের করে বলে, ‘এই যে নাও। কিন্তু আম্মা বেশি খাওয়ান যাইত না, তাইলে অসুক করব। দাঁতে পোক অইবো। দুই দিন বাদে বাদে একটা নিয়ে আইমু।’
সে ঘাড় কাত করে হাসতে থাকে। কী নিষ্পাপ হাসি। সারা দিনের কষ্ট-ক্লেশ ভুলে যায় ছোট্ট মেয়ের মুখখানা দেখে। বাইরের ঝুম বৃষ্টিও তার হাসি দেখে হাসে!