বন্যা নিয়ে গেল কন্যা
আয়েশা দাঁড়িয়ে আছে জানালায়। বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছে। বৃষ্টি তার ভালো লাগে। জানালায় গাল ঠেকিয়ে পারুলকে ডাকল, ‘আম্মা ও আম্মা, শোনো না।’ পারুল কাঁথা সেলাই করতে করতে বলল, ‘কী বলবি, বল না।’
বৃষ্টি তোমার কাছে কেমন লাগে?
বৃষ্টি আবার কেমন লাগব? বৃষ্টি আমাদের কলঘরের পানির মতোই লাগে। আয়েশা শব্দ করে হেসে ওঠল।
উফ, মা, তুমি কিচ্ছু বুঝো না।
হয়েছে হয়েছে। পাকনা মেয়ে! তুই সবকিছুই বুঝিস, আমার কিচ্ছু বোঝা লাগবে না। আমাকে কাজ করতে দে।
তুমি হাত দিয়ে কাজ কর। মুখ দিয়ে গল্প করো আমার সঙ্গে।
উঁহু, অত গল্প করার টাইম নেই আমার। অনেক কাজ পড়ে আছে। ধান তুলতে হবে উঠান থেকে। তোর বাবা সেই কখন যে গেছে এখনো ফেরার নামগন্ধ নেই। আমি একা একা এই অবস্থায় কীভাবে এসব করব আল্লাহ মাবুদ জানে।
—আচ্ছা মা, তুমি আমার সঙ্গে গল্প কর না কেন? জানো, আমার খুব খারাপ লাগে। আমার যে ছোট্ট ভাইয়া আসতেছে আমি তার সঙ্গে সারাক্ষণই গল্প করব।
পারুল আয়েশার কথা শুনে একটু হাসল। হাসিটা মিলিয়ে গেল বিজলির চমকে। মেঘ ডেকে যাচ্ছে।
অন্ধকার নেমে আসছে চারদিক থেকে। প্রচণ্ড বাতাস বইতে লাগল। গাছপালা ডানে-বামে দোল খেতে লাগল। পারুল আয়েশাকে ঘরে রেখে দ্রুত চলে গেল উঠোনে। বৃষ্টি আসার আগেই তার সবধান জড়ো করে ঢিবি বানিয়ে রাখতে হবে। আয়েশা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে দেখছে। পারুল বলল, ‘ঘরে গিয়ে বস।
আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ। কখন কী হয় কে জানে।’ আয়েশা ভেতরে গেল না। সে দাঁড়িয়েই রইল।
যেন তার মায়ের কথা সে শুনতে পায় নি। পারুল সবধান জড়ো করে ঢিবি বানিয়ে উঠোনের মাঝখানে রাখল। একটু পরেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। আয়েশা বারান্দায় বসে বৃষ্টির ফোঁটা নাম খেলছে। বৃষ্টি দেখে তার খুব আনন্দ লাগছে আবার দুঃখও লাগছে। তার মা কত দৌড়াদৌড়ি করল,এটা ভেবে তার খুব খারাপ লাগল। কিন্তু সে তো এখনো ছোট। তা না হলে সে মাকে বসিয়ে রেখে কাজ করে দিতো। দুই দিন আগে স্কুলে একটা ছড়া পড়েছে সে। কবি ফররুখ আহমদের। ছড়াটা মনে করতে পারছে না। একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করছে। এরমধ্যে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দৌড়ে এলো ফরিদ হোসেন। বাবাকে দেখেই ছড়াটা মনে পড়ল।
‘বিষ্টি এল কাশ বনে
জাগল সাড়া ঘাস বনে,
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।’
ফরিদ হোসেন ভিজে একাকার হয়ে গেছে। আয়েশাকে বলল, ‘তোমার আম্মু কোথায় গেছে? দেখছি না যে।’
কলঘরে গেছে গোসল করতে।
তারে ঝুলানো তোয়ালেটা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ফরিদ বলল, ‘এই অসময়ে গোসল। ঠান্ডা বাঁধিয়ে একটা কাণ্ড না ঘটিয়ে এই মহিলা শান্ত হবে না।’ ঠোঁটে সিগারেট চেপে শার্টের পকেটে দেশলাই খুঁজতে গেল। দেশলাইয়ের বাক্স ভিজে গেছে। একটা কাঠিও জ্বলছে না। রাগ করে ফেলে দিল সিগারেট। পারুল গোসল সেরে বলল, ‘কোথায় গেছিলে? আসতে এত দেরি হল যে?’
—পশ্চিম পাড়া দেলোয়ার চাচার বাড়িতে।
—কোনো কাজটাজ পেলে?
—নাহ! বন্যা আসতেছে। সবারই ঠেকা। কে কারে কাজ দেয়, কও!
পারুল ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘হু, বুঝতে পারছি।’
বাইরে ঝুম বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ফরিদ হোসেন বিড়বিড় করে বলল, এভাবে বৃষ্টি হলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। পুরো শহর ডুবে যাবে। খেতের ধান খেতেই থেকে যাবে। ঘরে আর তোলা হবে না। এই বার কী হয় কে জানে। একটানা দুই দিন বৃষ্টি হলো। বৃষ্টি যেন না থামারই সংকল্প করেছে। বিকেলের দিকে বৃষ্টি একটু কমল, সে দেখে এলো জমিটা। পুরো জমি পানির নিচে পড়ে গেছে। এই বার ধান শেষ। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। চারদিক থেকে ভেসে এলো পানি আর মানুষের আর্তচিৎকার। বাঁচাও, আমাদের উদ্ধার করো। কে আছো তোমরা? সবারই একই সংলাপ, একই চিৎকার, কে কারে বাঁচায়! ফরিদ হোসেনের পুরো বাড়ি ডুবে গেল। জল উঠোন পেরিয়ে ঘরে, ঘর পেরিয়ে বিছানায়, কোথাও একটু শান্তিতে বসে থেকে পানি কমার অপেক্ষা করার ঠাঁই নেই। চোখের পলকে সবকিছু ডুবে যাচ্ছে। ডুবে যাচ্ছে পৃথিবী, বেঁচে থাকার একটুখানি নিভু নিভু আলো। টিনের চালে তোশক আর দুইটা বালিশ নিয়ে শেষ রাতে কোনো রকম উঠতে পেরেছিল। চোখের সামনে ঘরের ভেতরের সবকিছু ভেসে গেল বন্যার পানিতে।
জীবনটা ছাড়া কিছুই উদ্ধার করতে পারল না। আয়েশা ঘুম ভেঙে দেখল, মাথার ওপর আকাশ। চারদিকে পানির থৈ থৈ আওয়াজ। পাশেই বাবা-মা ক্লান্ত অবসাদ দেহ ফেলে চোখ বুজে ক্লান্তি দূর করছে। আয়েশা ডাকতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল পানিতে। মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে গেল দুর্ঘটনা। ফরিদ হোসেন লাফ দিয়ে জীবন বাজি রেখে তাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল। স্রোত এসে ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দিল আয়েশাকে। বাবা বাঁচাও, বাবা বাঁচাও বলে চিৎকার করে উঠল আয়েশা। কিন্তু কেউ তার ডাক শুনতে পেল না। তার কাছে পৌঁছানোর পথ পেল না। সে জল খেতে খেতে তলিয়ে গেল দূরে কোথাও! পারুল ও তার স্বামী ফরিদ হোসেন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলছে, কে আছো, বাঁচাও! বন্যা নিয়ে গেল আমাদের কন্যা!
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]