বেদুইন–কন্যা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অদূরে খেজুরতলে ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি শোনা যায়! যুবক তাবু থেকে বেরিয়ে ভালোভাবে পরখ করে বিষয়টি। কালো বোরকায় আবৃত এক আরবীয় নারীর প্রতিবিম্ব। সাজানো বিস্ময়েরাও পরাভূত হলো যেন আজ। যুবকটি তার মনিবের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ। দূর বাংলায় যেমন অপেক্ষমাণ তার মা।

ঘোড়া ও তার আরোহী এদিকেই আসছে। আত্মরক্ষার ছোরাটি ভালোভাবে কোমরে গুঁজে নিল যুবক। বিদেশবিভুঁইয়ে কারও ভরসা নেই। বহুদিনের প্রেমও তো মানুষকে ধোঁকা দেয়। পিতাও তার ছোট সন্তানকে যেভাবে কোলে নেওয়ার হাত বাড়িয়ে হাত গুটিয়ে নেয়। এসব হচ্ছে সন্তানের শিক্ষা। অমূল্য দীক্ষা।

সওয়ারি এবার থেমে গেল। ঝড়ের কবলে পড়া নতজানু ধানগাছের মতো নুয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মুখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে আড়ালের বৃথা চেষ্টা শুধু। যুবক ঠাঁয় দাঁড়িয়ে স্বস্থানে। মনিবের কঠোর নির্দেশ, কাউকে ভেতরে আসতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু আমাদের বাংলার এক দারুণ ঐতিহ্য, অতিথির আপ্যায়নে কোনো কমতি নয়। যুবক উঁচিয়ে ধরল পানির বোতল। দেখল, এ যে দৃষ্টি হরণকারী এক উর্বর জমি। নেকাব সরিয়ে ঢক ঢক করে গিলতে লাগল, কী ভীষণ অমিয় পান।

অলংকরণ: আরাফাত করিম


কী নাম তোমার? ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে নামতে সওয়ারির প্রশ্ন।
-নামে কি আর পরিচয় থাকে?
-কেন, তুমি জানো না মানুষের নামেই পুরো বংশ থাকে। তোমার নাম শুনে কেউ চিনল না, হয়তো তোমার পিতার নামে চিনল, নয়তো দাদার নামে বা পর দাদার।
-হুম জানি, তবে আমাদের দেশে আমরা এসবে অভ্যস্ত নই।
-তবে যে বললে জানি, সেটা কীভাবে?
-মুহাম্মদ (সা.) সিরাত পড়েছি।
-বাহ্ ভালো, তুমি একাই এখানে?
-আপাতত, মনিব দক্ষিণে আধা মাইল দূরে।
-ভয় হচ্ছে না তোমার? আমি তোমাকে লুট করতে পারি। আমি কারাতেও পারদর্শী। তরবারিও বেশ চালাতে পারি।
-না হচ্ছে না। কারণ, আমি আরবের মরুর আচরণ সম্পর্কে অবগত আছি।
-সেটা কী রকম?

-আমার সঙ্গে একটা ঘোড়া আছে, আছে তরবারি। আমি একাকী দস্যুর সামনে অসহায় নই।
-আমি দস্যু নই, আমি হলাম ছলনা। আমার সামনে তুমি অসহায়।
-আপনি ছলনা নন, বড়জোর বিশ্বাসঘাতক হতে পারেন। বিশ্বাস হচ্ছে পৃথিবীর স্তম্ভ। যেদিন সেই স্তম্ভ গুঁড়িয়ে যাবে, সেদিনই পৃথিবীর ধ্বংস!
-তার মানে বলতে চাচ্ছো, পৃথিবীর স্থায়িত্ব বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
যুবক সায় মাথা নাড়ল।
-এই যেমন আমি আপনাকে পানি দিলাম। কোনো কিছু না ভেবেই আপনি পান করে গেলেন। পানিতে কিছু মিশিয়ে আমি যে আপনার ক্ষতি করব না, সেটা ভাবনাতেই এল না। আচ্ছা হঠাৎ এদিকে কেন?
-আমি ঘোড়া চালনা শিখছি, পুরোপুরি আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছি। তাই মাঝেমধ্যে সীমানা পেড়িয়ে এদিক–ওদিক ঘোরাফেরা করি। আর আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়, আমরা বেদুইন! বছর দেড়েক এ অঞ্চলেই আছি।

-আমার জাতীয়তা বাংলাদেশি। মনিবের সঙ্গে এসেছি, উনি আধা মাইল দূরে স্ত্রীসহ অবস্থান করছেন।
যুবক বেশিক্ষণ যুবতীর নয়ন স্ফুলিঙ্গে নজর রাখতে পারল না। নেকাবের আড়ালে মানুষি আদমে পরাভূত হতে সময় লাগবে না হয়তো। সে মনে মনে বিড়বিড় করে, আল্লাহ তুমি আমাকে রক্ষা করো যাবতীয় পাপ থেকে। আঁধার ঘনিয়ে আসছে। পশ্চিমের লালিমা জানান দিচ্ছে সূর্য বিদায়ের। যুবক বলতে শুরু করল,
-দেখুন, আমাদের প্রত্যেকের জন্যই কোথাও না কোথাও কেউ অপেক্ষা করছে। হতে পারে একটা পাখি, একটা কুকুর। অপেক্ষা করছে হয়তো কোনো মানুষ। অন্তত তাদের জন্য আমাদের বেঁচে থাকার ধৈর্য হোক।

এই যেমন আমার বাসার বিড়াল। প্রত্যহ বাসায় ফিরেই দেখি সে সিঁড়িতে গা এলিয়ে শুয়ে থাকে। দেখামাত্রই পায়ের সঙ্গে এসে গড়াগড়ি খায়। তারপর কি যেন বলে, আমি তার সব ভাষা বুঝি না। নিচু হয়ে বসে পড়ি, গায়ে হাত বোলাই। মাঝেমধ্যে হয়তো কাতুকুতু লাগে তার, আঁচড় কাটে। আমিও বেশ ঝাড়ি দিই। তখন মাথা নুয়ায়ে ফেলে। সেদিন ধরেছিলাম হাত–পায়ের নখগুলো কেটে দেব। ওমা সে কি রাগ তার। কয়েক দিন আর কাছে আসেনি। তারপর আমি নিজেই যেতাম। অভিমান ভাঙাতাম। কেমন ফুটফুটে প্রাণবন্ত লাগত তাকে।

সে আমার জন্য অপেক্ষা করে। অন্তত তার জন্যও বেঁচে থাকার ধৈর্য হোক। ধৈর্য হোক সেই মানুষদের, যারা আমার অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ। তিনি আজ আসুক এটা জিজ্ঞেস করব, ওটা জিজ্ঞেস করব। তিনি আসুক, ধার চাইব। এই যে এমন সব অতিপ্রাকৃত অপেক্ষা, এসবের জন্য হলেও বেঁচে থাকার ধৈর্য হোক।
তেমনি আপনার জন্যও কেউ অপেক্ষা করছে। হতে পারে গাছের একটা ফুল, খোদা হয়তো তাকে বলে রেখেছেন, তোমাকে অমুক বেদুইন–কন্যা এসে ছোঁবে! তারপর থেকেই ফুলের অপেক্ষা আপনারই জন্য। অন্তত সেসব ফুলেদের জন্য হলেও বেঁচে থাকার ধৈর্য হোক!

আঁধার ঢেকে দিচ্ছে বিরানভূমির সব হাস্যোজ্জ্বল দাম্ভিকতা। যুবক ঘড়ি দেখল। মাগরিবের সময় হয়েছে। তপ্ত বালুর গায়ে এক চিলতে জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে গেল নামাজে। কিছুক্ষণ পর সেই বেদুইন–কন্যাও অনুসরণ করল এই বাঙালি যুবকের পদচিহ্ন। তুমি যেখানেই থাকো, খোদার বড়ত্ব স্বীকারে তোমার কুণ্ঠাবোধ করা গাদ্দারি ছাড়া কিছুই নয়। তুমি বেদুইন হও, নারী হও, পুরুষ হও, খোদা তোমাকে দেখছে। তোমার দুঃখগুলো খোদা শুনছে। আর তোমাকে ধৈর্যের আদেশ দিচ্ছে।
নামাজ শেষে বিদায়ের পালা।

যুবতী ঘোড়ায় চড়ে বসল ঠিক। যাওয়ার ইচ্ছা যেন নেই। কি যেন খুঁজে পেয়েছে সে। সেটা কি বেঁচে থাকার? নাকি বেঁচে থাকতে আশা জাগানো এই বাঙালি যুবকের মাধুর্যতার? অবশ্য সে মরার জন্যও উদ্‌গ্রীব নয়, কিন্তু এই যুবক! সে তো সাধারণ কোনো যুবক নয়। এমন কিছু তো অবশ্যই আছে, যেটা তার গোত্রে বেড়ে ওঠা পুরুষের মধ্যে নেই। আজকের এই প্রহর স্মরণীয়। আজকের এই সালাত স্মরণীয়।
-মাইল দেড়েক দূরত্বে আমাদের খিমা, তুমি এসো কোনো দিন। তোমার গল্প শুনব, তোমার দেশের গল্প শুনব, বলল যুবতী।

প্রত্যুত্তরে যুবক মুচকি হেসে লুকাতে চাইল আকুতি। এই বেদুইন–কন্যার মুগ্ধতা হয়তো কোনো দিন কেটে যাবে, কিন্তু আজকের মুহূর্তটা রয়ে যাবে যুগযুগ। সব ফয়সালার গুরুভার খোদার হাতে। ভাগ্যে আমাদের কারও হাত নেই প্রভু, তবে আমি জানি, তুমি আমাকে নৈরাশ করবে না।

ছুটে চলছে ঘোড়া, ঘোড়সওয়ারির কণ্ঠে বেজে চলছে মাগরিবের সালাতে শোনা যুবকের তিলাওয়াত...

**নাগরিকে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারবেন যে কেউ। ঠিকানা: [email protected]