নিঃসঙ্গতা, সম্পর্কের অবিশ্বাস ও একটি স্ন্যাপশট

প্রতীকী ছবিসংগৃহীত

মার্কিন কবি অ্যান সেক্সটন যে কাব্যের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন, তার নামই ছিল ‘বাঁচো অথবা মরো’। দীর্ঘকাল ধরে চলা আবেগতাড়িত হতাশা আর মানসিক যন্ত্রণা থেকে লেখা কবিতা ‘মৃত্যুবরণ করতে চাই’-এ বলেন, ‘মৃত্যু আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।’ এ কবিতা লেখার কিছুদিন পরই অ্যান সেক্সটন ৪৫ বছর বয়সে জীবনের ইতি টানেন।

মাত্র ২০ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।’ মৃত্যু মানে কী অথবা জীবনের ওপারে কী আছে, তা দেখার জন্য ব্যাকুল ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে জন্যই চিকিৎসকেরা যখন দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচারের প্রস্তাব করলেন, তিনি রাজি হলেন না। বললেন, ‘আমার ডাক এসে গেছে।’ ক্রিটিক বলছেন, তিনি যেন ওপারে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করছেন।

১৯৪১ সালে এক সাহিত্যসভায় কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘...আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম, সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ পরের বছরই নজরুল চিরকালের মতো অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর কখনো তিনি কোনো কিছু লিখতে পারেননি।

স্বাভাবিক মৃত্যুর পরিবর্তে যাঁরা আত্মহননকে বেছে নেন, তাঁরা মনে করেন, ‘এ পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য।’

প্রতিভাধর ও সৃষ্টিশীল যেসব মানুষ আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের সবাই পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করে যান, কেউ লেখেন আবার কেউ–বা লেখেন না। তাঁদের মধ্যে যাঁদের খ্যাতি ছিল, তাঁরা হলেন রাশিয়ার কবি মায়োকভস্কি, ব্রিটিশ লেখক ভার্জিনিয়া উলফ আর মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।

২.

কিছুদিন আগে একটা ছোট্ট নোটে লিখেছিলাম, ‘পৃথিবীটা অনেক সুন্দর।’ কিন্তু এই সুন্দর পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে, যারা চিরকালই বসবাসের অযোগ্য। কিংবা কুৎসিত। তাদের বেঁচে থাকাটা অনেকটাই পরজীবীর মতো। এ সমাজের মানুষগুলো তাদের সেই দৃষ্টিতে নিয়ে যায়। তার দায় সমাজের ও রাষ্ট্রের, সমাজে বসবাসরত সব মানুষের। এটা হয়তো তত্ত্বগত জায়গায় ঠিক, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা তা বলে না।

বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষের মনে সীমাহীন অভিঘাত তৈরি করে, যা একসময় মানুষকে আত্মহননে প্ররোচিত করে। কার্ল মার্ক্সের পুঁজিবাদের সংজ্ঞার মধ্যেই ‘শোষণ’ শব্দটি বহুলভাবে আছে। পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকেরাও, এই ব্যবস্থায় যে শোষণ হয়, অস্বীকার করেন না। কেননা, মার্ক্সের ‘থিওরি অব সারপ্লাস ভ্যালু’ গাণিতিক প্রমাণসিদ্ধ। বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা–ও শোষণমূলক ও পক্ষপাতদুষ্ট।
বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা পুঁজিবাদীব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুঁজিবাদীব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিযোগিতা।

প্রতিযোগিতা হলে পরে কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে পড়বে। কারও এগিয়ে যাওয়া আর কারও পিছিয়ে পড়া মানে বৈষম্য সৃষ্টি হওয়া। এগিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা উঁচু শ্রেণিতে উঠে গিয়ে নিচের দিকে আর ফিরে তাকান না। যাঁরা নিচে পড়ে গেলেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁরা আর মেলামেশা করেন না। উঁচুতে ওঠার পরেও প্রতিযোগিতা থামে না; বরং আরও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ব্যবধান। আর ব্যবধানই সৃষ্টি করে নিঃসঙ্গতা। বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা আত্মহত্যার প্রধান কারণ। সামাজিক বৈষম্য, ব্যবধান, সম্পর্কের কাটাছেঁড়া, সম্পর্কের ভেতর অবিশ্বাস, টানাপোড়েন; সর্বোপরি নিঃসঙ্গতা মানুষকে যে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়, বিভিন্ন পরিসংখ্যানও এর সাক্ষ্য দেয়।

৩.

বহু বছর ধরে গণমাধ্যমে কাজ করছি। অনেক আত্মহত্যার খবর নিজে ছাপিয়েছি, নিজে কলম চালিয়েছি এসব খবরে। সম্প্রতি সাদি মহম্মদের মৃত্যুর খবরটা দেখে ভয়ানক চমকে উঠেছি। বিপন্ন বোধ করেছি। আমার ভেতরে অন্য ধরনের প্রভাব তৈরি করেছে। একধরনের ‘ট্রমা’ তৈরি করেছে। তাঁর চলে যাওয়ায় মনে হলো, কতকাল ধরে এ রকম আমি বা আমরা অনেকেই এ ধরনের ভয়াবহ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কি, এর আগে আমাকে এতটা ছুঁয়ে যায়নি। কিংবা আমাকে তাঁর মতো করে ভাবায়নি। এতটা নিঃসঙ্গ আমার মনে হয়নি, আজকাল যতটা মনে হচ্ছে। কেন জানি না, আমার নিজের কাছে বড্ড ভয় লাগে। সম্প্রতি আমার বাবা প্রয়াত হলেন, সেই ভয়টা আরও বেশি চড়াও হলো। আজকাল অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়া ট্রেনের শব্দ আমাকে ভীষণ অস্থির করে। ভয় ধরায়।

একজন ঊনমানুষের গল্প বলি। অনিমেষ নামের সেই ছেলেটি দেখতে খাটো। সাধারণ মানুষের মতো তার চরিত্র নয়। কিন্তু অনিমেষের সঙ্গে একটি মেয়ের পরিচয় হয়। মেয়েটিকে ভালোবাসে সে। কিন্তু সে মেয়েটির কাছে যেতে পারত না। তার সংকোচ লাগত, ভয় হতো। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়। কথা বলতে বলতে একদিন সব ভয়–সংশয় উড়িয়ে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে। সে দেখাতে অনিমেষের ভালোবাসা প্রত্যাখ্যাত হয়।

গল্পটা বহু পুরোনো। কিংবা এটাকে নিছক গল্প বলাটা ভুল হবে। কিন্তু সমাজের এ চেহারা এখনো একই রকম হয়ে আছে। কোনোভাবেই মনে করতে পারি না, একজন প্রতিবন্ধী মানুষের ভেতরে প্রেমানুভূতি হয়, ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। তাদেরও কাউকে না কাউকে ভালো লাগার ব্যাপার থাকে। তাদের সেই ভালোবাসাটা উজাড় করা ভালোবাসা, স্বার্থহীন ভালোবাসা। কিন্তু সেই ভালোবাসা বা ভালো লাগাটা তারা প্রকাশ করতে পারে না। তাদের মধ্যে একটা দোদুল্যমানতা কাজ করে। দ্বিধা কাজ করে। তাদের মনে জিজ্ঞাসা থাকে, প্রশ্ন থাকে; তার ভালোবাসার মানুষ কি তাকে ভালোবাসবে? হয়তো ভালোবাসে। তবে সেটা খুব ব্যতিক্রম। কদাচিৎ দেখা যায় না। কালেভদ্রে দু-একটি ঘটনা হয়তো হয়। যখন প্রত্যাখ্যাত হয়, এই প্রত্যাখ্যানের জ্বালা তারা সইতে পারে না। নিতে পারে না। তারা নীরবে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে প্রায়ই বলতেন, ‘দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলির মতো, কিটসের মতো খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে, তুই প্রস্তুত হ।’ জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে কেন জানি মনে হয় আমার জীবনেও এ রকম ট্র্যাজেডি আছে। ইতালির লেরিসিতে ফেরার পথে মাত্র ৩০ বছর বয়সে ব্রিটিশ কবি জন কিটসের মৃত্যু হয়। তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন বলেই ধারণা করা হয়।

৪.

অনেকে বলত, সাদি মহম্মদ নাকি মানুষ হিসেবে ছিলেন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। কাউকে কাউকে আমি এটা বলতে দেখেছি। নিশ্চিতভাবে এটা একটা প্রবঞ্চন। এটা একটা মানুষের অনুভূতিতে কী পরিমাণ আঘাত করে, ক্ষরণ তৈরি করে, ঘৃণা তৈরি করে, তার চেয়ে অনেক কম অযোগ্য মানুষ আমিও মাঝেমধ্যে তা টের পাই। যখন কোনো প্রিয় মানুষ রাতবিরাতে বলে ওঠে, তাকে খোঁচাচ্ছি (স্বভাবে আমার তেমন কাউকে আঘাত করে খোঁচানোর প্রবণতা নেই, দুষ্টুমির ছলে হয়তো ফাজলামো করি, কিন্তু খোঁচাখুঁচির মতো আঘাত করার কোনো মানসিক বৈকল্য আমার হয় না), সেটা যে কী দুঃসহ অবস্থা, তা আমাকে প্রতিনিয়ত ছুঁয়ে যায়, কুরে খায়।

সাদি মহম্মদ জীবনে এত সফল ও দৃঢ়চেতা মানুষ। কয়েক বছর আগের কথা, রবীন্দ্রনাথের স্মরণে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে আসার আগে তিনি সরকারি সংগীত কলেজ থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এলেন। চাকরির বয়স আরও থাকার পরও তাঁর দৃঢ়তার কারণে তা তিনি করতে পেরেছেন। তাঁর মতো এমন মানুষকে সামাজিক বৈষম্য আর নিগ্রহ, একই সঙ্গে নিঃসঙ্গতায় এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কেবল পদক বা পুরস্কার না পাওয়ার অভিমানে? অনেকেই ব্যাপারটা যেভাবে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার আর স্বীকৃতির দিকে নিয়ে গেছে, তাতে যে কারও মনে হতে পারে, পুরস্কারের জন্য লালায়িত ছিলেন। আসলে তিনি পুরস্কারের জন্য গান করেননি। গান ভালোবাসতেন বলে গান করতেন। গান ভালোবাসতেন বলেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়া ছেড়ে দিয়ে শান্তিনিকেতনে সংগীত ভবনে গিয়েছিলেন, গান শিখেছেন, সারা জীবন হৃদয় উজাড় করে গান গেয়েছেন। কোনো কিছুতে উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠায় পৌঁছাতে হলে একজন মানুষকে গভীর সাধনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সাদি মহম্মদ ছিলেন এ রকমই একজন সাধক। প্রতিদিন দীর্ঘ সময় তিনি রেওয়াজ করতেন। তাঁর ছোট ভাই শিবলী মহম্মদ জানান, আত্মহত্যার কিছুক্ষণ আগেও গান গাইছিলেন সাদি মহম্মদ। এর মানে, সংগীত জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল তাঁর। যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণ সংগীত আছে। সংগীতের প্রতি অনুরাগ শুধু নয়, সীমাহীন নিষ্ঠা ছিল তাঁর। গায়কি, শুদ্ধতা এবং গলার ওপর নিয়ন্ত্রণ বিশিষ্ট করেছিল তাঁকে।

তাহলে কেন সাদি মহম্মদ এ সিদ্ধান্ত নিলেন? হয়তো জীবননান্দের সেই কবিতার মতো কোনো বিপন্ন-বিস্ময় তাঁকে ঘিরে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নই আসে, সাদি মহম্মদের যদি এ রকম অবস্থা হয়, তাহলে আমার মতো মানুষগুলো, যাদের কোথাও কোনো কূলকিনারা নেই, তাদের ভরসা কোথায়? সাদি মহম্মদ যেন আমাদের পদাঘাত করে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যু আমাকে এখন প্রতিনিয়ত আরও বেশি জর্জরিত করে।

৫.
‘কমিউনিটি কেয়ার’ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। এর মূলকথাই হলো, একজন রোগীকে পারিপার্শ্বিক সমাজের ঘিরে থাকা। তিনি যে সমাজবিচ্ছিন্ন জীব নন, সেই আশ্বাসটা জাগিয়ে তোলা। অনেকের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। হয়তো পথেঘাটে কয়েকবার দেখা হয়। সাক্ষাৎ হয়। ওই পর্যন্তই। ওই ব্যক্তির বর্তমান জীবনযাপন সম্পর্কে তাঁরা অন্ধকারেই থাকেন। যাঁরা জানেন, তাঁরা বরং ওই মানুষটাকে আরও কীভাবে উপহাস করা যায়, দিনের পর দিন ঠাট্টা করেছেন তাঁকে নিয়ে, জানতে চাননি বিষাদমাখা হাসির আড়ালে ওই মানুষটি ভালো আছেন কি না, সেখানে স্থির থাকেন। একজন মনোরোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভূমিকা থাকে ওষুধের। এর পরের পর্যায়ে কিন্তু কমিউনিটি কেয়ার খুব জরুরি। সেটা আমরা কতটুকু পারছি?

পুঁজির আগ্রাসনে মানবসভ্যতা যে বিপন্ন হবে, তা আশির দশকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। লিখেছিলেন, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। বহু বছর আগে ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতা উদ্ধৃত করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার কবিতায় এত হতাশা কেন?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘হতাশা নয়, অভিমান।’ নানা প্রবঞ্চন, সম্পর্কের ভেতর অবিশ্বাস–অবহেলা মানুষের মধ্যে অভিমানের জন্ম দেয়। এ অভিমান নিয়েই সাদি মহম্মদরা স্বেচ্ছায় পৃথিবীকে বিদায় জানান। হয়তো তাঁর পথ ধরে আমি বা আমরা ভবিষ্যতে...। খুব সাবধান হতে হবে আমাদের।

লেখক: হাবীব ইমন: প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন