না–বলা কথা

প্রতীকী ছবি

আবহাওয়াটা একটু শীতল। ঘন ঘন বৃষ্টি পড়ছে। প্রথম দেখা হয়েছিল কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে। সকাল ১০টা ৩০ মিনিট হবে। সে সময় রাস্তায় কোনো বাস বা গাড়ি ছিল না। হ্যাঁ! বাস আসত, কিন্তু এক ঘণ্টা পরপর। বৃষ্টি পড়ছিল অনেক। সে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকিয়ে ছিল মেঘলা আকাশের দিকে। আমিও তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার হাতে ফুলের পরিবর্তে গরম চায়ের কেটলি আর কয়েকটি কাপ ছিল। গরিব ঘরের বড় ছেলে ছিলাম। বাঁকা শহরের অলিগলিতে চা বিক্রি করতাম। চা বিক্রি করে ছোট ভাই আর ছোট বোনকে স্কুলে পড়াতাম। প্রতিদিন কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম।

প্রতিদিন সে সাড়ে ১০টা নাগাদ কুর্মিটোলা স্ট্যান্ডে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকত। সেদিনও দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন একদম অন্য রকম লাগছিল। পরনে লাল শাড়ি, হাতে লাল চুড়ি, পায়ে আলতা, চোখে কাজল। একদম টুকটুকে বউ লাগছিল। তাকে দেখে মনে হয়েছিল, সে আতঙ্কিত হয়ে আছে। ভেবেছিলাম তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব। এক-দুই পা সামনে যাওয়ার পর ভাবলাম, কখনো তার সামনে যাইনি! এখন গেলে কেমন দেখায়। তবু এ কথা ভাবতে ভাবতে আরও দুই পা বাড়ালাম। হঠাৎ তার মিষ্টি কণ্ঠে একটা ডাক শুনতে পেলাম। আমি তো ভীষণ খুশি। প্রথমবার পছন্দের মানুষের মুখ থেকে নিজের নাম শুনলাম। আসলে আমার কোনো নাম ছিল না। যে যার ইচ্ছা, সেই নামেই ডাকে। আমার নিজস্ব কোনো ধর্ম ছিল না। জাত নিয়ে এত কিছু ভাবতাম না। এককথায় আমি মানুষ ছিলাম।

তারপর সামনে দাঁড়ালাম। আমার বুকটা ধড়ফড় করছিল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ ধরে। সে অনেক কথাই বলল, কিন্তু কিছুই কানে নিইনি। হঠাৎ সে আমাকে বলল, তোমার কাছে কি মুঠোফোন হবে? আমি কথার জবাব দিলাম না। কারণ, তখন মুঠোফোন কেনার মতো সামর্থ্য ছিল না। মাথা নিচু করে তাঁকে জবাব দিলাম, দুঃখিত! মুঠোফোনটা আজকে নিয়ে আসিনি। সে বলল, আচ্ছা, সমস্যা নেই। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাসা কোথায়? কে কে আছে বাসায়? আমি তাকে বললাম, সামনে পাড়ার গলিটাতেই আমার বাসা। বাবা, মা নেই, কিন্তু একটা ছোট ভাই আর ছোট বোন আছে।

সে বলল, তোমার আত্মীয়স্বজন নেই?
আত্মীয়স্বজন বলতে দূরসম্পর্কের একটা চাচা আছেন। তাঁকে করিম চাচা বলে ডাকি। অনেক ভালো একজন মানুষ। আমার ছোট ভাই ও ছোট বোনকে খুব ভালোবাসেন, আদর করেন, নিজের সন্তানের চোখে দেখেন।

তারপর সে কিছুক্ষণ বসে কি যেন একটা ভাবতে থাকল। আমিও চুপচাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম এখন হয়তো চলে যাওয়ার সময়, তাই কিছু হয়তো বলছে না। তাকে একা রেখে চলেও আসার জন্য মন বলছে না। কিন্তু কাল ভাই আর বোনের স্কুলের বেতন দেওয়ার শেষ দিন। কাল যদি বেতন না দিতে পারি, তাহলে ভাই আর বোনকে স্কুল থেকে বের করে দেবে। তখন তাদের আর লেখাপড়া করাতে পারব না। শিক্ষিত মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারব না। বাবা, মা চলে যাওয়ার আগে আমাকে তাদের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগুলো ভাবতে থাকলাম। হঠাৎ করে সে বলে উঠল—  
তুমি কি আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবে?
জি, অবশ্যই করব।

সে বলল, আমার বাবা, মা আমাকে আমার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দিতে চাচ্ছে, আমি যে ছেলেকে ভালোবাসতাম তাকে আমার ভাই অনেক মেরেছে, আর আজকে বিকেল পাঁচটায় আমার বিয়ে। এখন বেলা প্রায় একটা বাজে। বৃষ্টি থেমে গেছে।
তার সঙ্গে সঙ্গে আমার তাকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন ভেবেছিলাম তাকে বলব-‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’

কিন্তু তাকে কথাটা বলার মতো সাহস পেলাম না। কারণ, ভালোবাসা একবারই হয়।
তারপর সে বলল, তুমি চুপ করে আছ যে, আমাকে কি সাহায্য করবে না?
আমি হাসিমুখে বললাম, জি! অবশ্যই করব। তারপর আমি মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম। সত্যি বলতে, তাকে অনেক ভালোবাসতাম, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা বাজে তার জন্য অপেক্ষা করতাম। অনেক ভালোবেসেছিলাম তাকে।

হঠাৎ সে বলে উঠল, তোমার চোখে জল কেন?
আমি চোখের জল মুছে মুচকি হেসে বললাম, এটা গরিবের পবিত্র হাসি, তা আপনি বুঝবেন না! তারপর আমি বললাম, কী সাহায্য লাগবে, সেটাই তো জানা হলো না। আর আমি সাহায্য করলে আমার কী উপকার হবে?

তখন সে বলল, তোমাকে হাজারখানেক টাকা দেব! শুধু সাহায্যটা করে দাও।
আমি গরিব হতে পারি, কিন্তু কারও উপকারের বিনিময়ে টাকা নিই না। তখনই আমার মনে পড়ল, আমার ভাইবোনের বেতন এখনো বাকি। আজকের মধ্যে টাকা জোগাড় না করতে পারলে ভাইবোনকে পড়াতে পারব না। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

সে আবারও বলে উঠল, তুমি সাহায্য করতে পারবে না?  
হ্যাঁ! আমি রাজি, কিন্তু আমাকে শুধু এক হাজার টাকা দিলেই চলবে, এর বেশি আমি এক টাকাও নিতে পারব না। সে বলল, আচ্ছা বেশ, তাহলে শোনো কী কী করতে হবে—
প্রায় আধঘণ্টা গেল তার কথা শুনতে। এখন ঠিক দুপুর। আর দেরি করে লাভ নেই, এখনই রওনা দেওয়া উচিত আমাদের। কিছুক্ষণের জন্য মনটা শান্ত হলো। কারণ, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা সময় কাটাতে পারব। তখনই আবার বৃষ্টি শুরু হলো। তার বৃষ্টিতে ভিজতে অনেক ভালো লাগে। প্রথমে ভেবেছিলাম তাকে বারণ করব বৃষ্টিতে না ভিজতে, কিন্তু তার রাগ ভাঙানো হাসিটা দেখে কিছু বলার জন্য মনটা সায় দিল না। আমরা আর দেরি করলাম না। হাটতে থাকলাম। কারণ, তখন রাস্তায় যানবাহন ছিল না। আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে দুই বা তিন ঘণ্টা লাগবে। রাস্তায় যানবাহন তেমন নেই। মনের আনন্দটা বলে বোঝাতে পারব না। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে, তাই না? হঠাৎ সে আমার পাশ থেকে সামনে চলে এল, আমার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল। আমি তার দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে ছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম তাকে, কিছু বলছেন না যে? সে কোনো উত্তর দিল না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তাকে চিন্তিত দেখে আর কিছু বললাম না। জায়গাটা ছিল শেওড়া  আর বিশ্বরোড এর মাঝবরাবর। খুব ইচ্ছা করছিল তার হাতটা ধরে একসঙ্গে চলার। কিন্তু আমার এত সাহস নেই। তখনই বিদ্যুৎ চমকে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে সে আমার হাত ধরল! আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, সে অনেক ভয় পেয়েছিল। তবু তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। আমিও কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। সে আমার হাত ধরে রাখল বেশ কিছুক্ষণ। পছন্দের মানুষের হাত ধরে পথ চলাটা সৌভাগ্যের বিষয়!

এখন বাজে প্রায় সাড়ে তিনটা। আমরা এখন খিলক্ষেত বাসস্ট্যান্ডে। তাকে বললাম, আপনার কি খিদে পেয়েছে? কিছু খাবেন?
না, আমি খাব না। এক কাপ চা দিলেই চলবে।

কথা না বাড়িয়ে আমার গরম কেটলি থেকে তার দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিলাম। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে চায়ের স্বাদ অনুভব করছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

সে বলল, বাহ! চা তো বেশ দারুণ হয়েছে। কার থেকে শিখেছ চা বানানো?
ধন্যবাদ! আমি মায়ের কাছ থেকে চা বানানো শিখেছি। আমার চা তেমন কিছু না। কিন্তু আমার মায়ের হাতের চা যেন অমৃত। অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। আর দেরি করা চলবে না। আমাদের গন্তব্যের স্থান ছিল বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন। হাঁটা শুরু করলাম, বৃষ্টি পড়ছে অনেক। সেই সঙ্গে মনের মধ্যে নানান ধরনের গান মেতে উঠছে। এখন প্রায় সাড়ে চারটা বাজে। আমরা প্রায় আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। রাস্তা পার হলাম, সে আমার হাত ধরে রইল। স্টেশনের ভেতরে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ সে আমার হাতটা ছেড়ে দৌড়ে সামনে চলে গেল আর ভিড়ে মিশে গেল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমিও একটু সামনে গেলাম। গিয়ে দেখি সে একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছে। মুহূর্তেই ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলাম, বুক ধড়ফড় করছিল, চোখ জলে টলমল করছিল। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ছেলেটা অনেক ভালো, ছেলেটার মধ্যে কোনো কমতি নেই, সব দিক দিয়েই তাকে খুশি রাখবে। এই কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সে আমার সামনে চলে এল।

সে আমাকে বলল, ধন্যবাদ! তোমার এই উপকার কোনো দিন ভুলতে পারব না, এই নাও তোমার টাকা।

আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, নাহ, টাকাটা রেখে দিন। আপনার কাজে লাগবে। আর এটা আমার দায়িত্ব ছিল। আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি। ভাবলাম! কাউকে ভালোবেসে উপকার করলে, সেটাকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না!
হঠাৎ সে আমাকে বলে উঠল, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?
আমার এত সামর্থ্য নেই কাউকে ভালোবাসার মতো।

সে আমাকে আবারও জিজ্ঞাসা করল, তুমি কাকে ভালোবাসো? আমাকে?
আমার চোখে জল, তবু গলা শক্ত করে বললাম, আমি একজনকে ভীষণ ভালোবাসি! কিন্তু তার নাম জানি না। তার জন্য প্রতিদিন কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতাম। হয়তো আজ থেকে আর যাওয়া হবে না।

সে বলল, অনেক ভালোবাসো তাকে, তা-ই না? কিন্তু তাকে একবার হলেও বলতে পারতে?
তাকে বললাম, আমি সাধারণ চা বিক্রেতা। আমার কথার গুরুত্ব কেইবা বুঝবে।
হঠাৎ সে বলল, ধন্যবাদ!
জিজ্ঞাসা করলাম, কেন ধন্যবাদ জানালেন?
সে আবার বলল, ধন্যবাদ! এত দিন আমার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য! রাতের অন্ধকারে রাস্তায় আমার পিছু নিয়ে আমাকে নিরাপদে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ! প্রতিদিন কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ধন্যবাদ! কড়া রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে অপেক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ।

আমি চুপচাপ সবকিছু শুনছিলাম। সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ দিল না। মুহূর্তেই ট্রেনে উঠে পড়ল। ট্রেন ছাড়ার সময় তাকে আর দেখতে পেলাম না…

লেখক: রেজওয়ান রশিদ ইকরা, শিক্ষার্থী, ন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট