উড়োচিঠি চিরকুটে

চিঠিঅলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

চিঠির কদর সুপ্রাচীনকাল থেকেই। আধুনিক বিশ্বে নতুন প্রজন্ম চিঠির মানে না বুঝলেও শতবর্ষ আগেই বিশ্বের নানা প্রান্তে নানাভাবে উদ্ভাসিত হয়েছিল চিঠির কদর। আব্রাহাম লিংকনের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? ঘরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোথাও কোথাও এখনো শোভা পায় আব্রাহাম লিংকনের লেখা তাঁর সন্তানের শিক্ষকের প্রতি চিঠি। ‘Letter from Birmingham jail’ নামে পরিচিত মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের খোলাচিঠি কিংবা ইংরেজ লেখক ভার্জিনিয়া উলফের সুইসাইড নোট হিসেবেও লিখে যাওয়া চিঠি এখনো সমাদৃত সচেতন মানুষের মননে। বাঙালি কবি–সাহিত্যিকেরাও চিঠিকে রেখেছেন উচ্চাসনে। কবিতায়, গল্পে, গানে চিঠির মাহাত্ম্য ফুটে উঠেছে অনেক গুণ। বিশ্ব চিঠি দিবস ছিল গতকাল রোববার। চিঠি দিবসকে তুলে রাখুন ‘চিঠিদের’ জন্য।

চিঠি লিখুন মায়ের কাছে

মা পরম যত্নে গড়ে তুলেন সন্তানকে। খেয়ে-না খেয়ে, রোগে-শোকে ভুগেও সন্তানকে যত্নে-স্নেহে লালন করেন। মায়ের ত্যাগের প্রতিদান দিতে কোনো সন্তানই পারে না, কিন্তু ত্যাগের ফলস্বরূপ মায়ের প্রতি ভালোবাসা জিইয়ে রাখে সন্তানেরা। সেই ভালোবাসা সন্তান খুব কমই প্রকাশ করে। কখনো প্রকাশ করার সুযোগ হয় না, কখনোবা প্রকাশ করতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ে। কখনো প্রকাশের ইচ্ছা জাগে না। চিঠি দিবসটি মায়েদেরও। ঝটপট সুদৃশ্য রংবাহারি খামে মায়ের হাতে পৌঁছে যাক ভালোবাসার চিঠি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মায়ের কাছে লেখা চিঠির মতো বিশাল নয়, যাতে অন্তত স্পষ্ট অক্ষরে লেখা থাকুক—‘ভালোবাসি মা’।

মায়া করে হলেও একটি চিঠি দিয়ো

‘তোমার যত্নে গড়া আঙুলের ডগায় যে তুলিতে বেদনা আঁকো, সেই তুলিতেই লিখো ভুল অক্ষরের চিঠি’—এই যে সকাল–সন্ধ্যা বিরক্তিকর শহুরে ঝঞ্জাটে এপাশ থেকে ওপাশে কখনো রূঢ় শব্দের প্রেম, কখনো নীরবে নিশপিশ করা ঠোঁটের ফিসফিস প্রেমের আদান–প্রদান করি, আমাদের অন্তরের যতটুকু রং, সবই তো গেল ফিকে হয়ে। আজকের দিনে এ নিবেদন, মায়া করে কঠিন প্রেমের বদলে কুঁচকে যাওয়া কাগজে ভুল অক্ষরে হলেও পাঠাও একটুকরা প্রেম। আর তোমার কপালের খসে পড়া একখানি টিপ এঁটে দিয়ো পত্রের এক কোণে। সাদা কাগজে তোমার কুন্তলের সুবাস মেখে পাঠিয়ে দিয়ো মায়ার খামে। নদীর নামে ডাকা প্রেমিকাদের নির্মল বয়ে চলার ফাঁকে কিছুক্ষণ নিশ্বাস পড়ুক প্রেমিকের ঠিকানায় পাঠানো কাগজের কালো অক্ষরের ভিড়ে, মায়া ঝরুক চিঠিতে।

না–বলা কথা টুকে দিন পত্রে

কথা হলো পাখি, মনপাখির খাঁচা। দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা একেক রকম পাখি; মানুষের মন নামের খাঁচায় বন্দী থাকে হরহামেশাই। একটি নির্জন দুপুরে পাখির ডাক শুনতে শুনতে বলব, কিংবা একটি চাঁদনি–রাতে আসন পেতে মেঘের জলে চাঁদনি–স্নান দেখতে দেখতে মনখাঁচার কথা নামের পাখিগুলোকে ছেড়ে দেব বলে আর নির্জন দুপুর পাওয়া হয় না, জোছনা দেখতে বসা হয় না বাড়ির ছাদে। এমনই খাঁচাবন্দী কথাগুলো মুক্তি পাক এ চিঠি দিবসে। কথা নামের পাখিগুলো প্রাণ পাক কালো অক্ষরে অক্ষরে। লিখে ফেলুন একটি চিঠি কিংবা একটি হলুদ খামের চিরকুট। উড়িয়ে দিন।

উড়োচিঠি চিরকুটে

গানে–কবিতায় উড়োচিঠির বন্দনা আর কত? গানে গানে আকাশের ঠিকানায় চিঠি নয় আর। আপনার মনের কথা অন্যকে শুনিয়ে যেমন মন হালকা হয়, তেমনই কাগজবন্দী কালো অক্ষরকে মুক্ত করে চিঠি বেনামি ঠিকানায় পোস্ট করে দিন এই চিঠি দিবসে, এতেও হালকা হবে মন। আকাশের প্রতি প্রেম, সাগর–সলিল কিংবা পাথারের তরে প্রেম উঠে যাক সাদা কাগজে কলমের ডগায়।

নার্গিস-মৃণালিনীদের পত্রপ্রেম জুটুক

এ যুগের মৃণালিনী দেবীদের মনকাড়ার চেষ্টায় রবি ঠাকুরের সুরেই একখানি পত্র পৌঁছে যাক ডাকে। ‘তোমার সন্ধ্যা বেলাকার মনের ভাবে আমার কি কোনো অধিকার নেই?’ বলে রবি ঠাকুর প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন মৃণালিনী দেবীকে, সেখানে কাজী নজরুল গেয়েছেন প্রেমের গান—‘তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নববর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ-মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনর বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল, তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার...’ এই যুগেও জীবন্ত সব মৃণালিনী দেবী আর নার্গিসরা ছুটে যাক ডাকঘরে, বুক পকেটে চেপে রাখুক হলুদ খামের চিঠি, কিংবা রেগেমেগে খুলে বসুক চিঠির পাতা।

*লেখক: মোহাম্মদ রায়হান, নিকুঞ্জ ২, খিলক্ষেত, ঢাকা

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]