লঞ্চের শুধু কি ধাক্কাধাক্কিতে প্রাণ যায়, রয়েছে নানা অনিয়ম–অব্যবস্থাপনা

ছবি: প্রথম আলো

দক্ষিণাঞ্চলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ একটা সময়ে লঞ্চের মাধ্যমেই যাতায়াত করতেন। বর্তমানে পদ্মা সেতু হওয়ার দরুন বৃহৎ একটা অংশ সড়কপথে যাতায়াত করেন। বিশেষ করে বরিশাল এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোর মানুষ। সড়কপথ হওয়ার পরে কত মানুষ যে লঞ্চের হয়রানি থেকে মুক্ত হয়েছেন, সেটা একটা জরিপ করলে ফুটে উঠবে। লঞ্চ কর্তৃপক্ষের একচেটিয়া ব্যবসা আজকের নতুন না। যুগের পর যুগ এভাবে একচেটিয়া ব্যবসা করে কতভাবে যে যাত্রীদের এখানে হয়রানির করা হয়, সেগুলো অব্যক্ত।

এই যেমন ঈদ এলে এবং শীতে ভাড়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, কেবিনের দাম দু-তিন গুণ হয়ে যাওয়া, লঞ্চ স্টাফদের দখল করে চড়া দামে সিট বিক্রি করা, খাবারের দাম কয়েক গুণ বাইরের তুলনায়, নানা সময় স্টাফ কর্তৃক হয়রানি করা, যাত্রীদের গায়ে হাত তোলা থেকে শুরু করে এহেন কোনো অপরাধ নেই যেগুলো লঞ্চে যাত্রীদের সঙ্গে করা হয় না।

বলা যায়, দীর্ঘ একটা সময় যাত্রীরা তাঁদের হাতে জিম্মি থাকে। কারও কিছু বলার সুযোগ নেই। তাঁদের কাছে যাত্রীদের ন্যূনতম কোনো মর্যাদা আছে কি না সন্দেহ। এমনকি নানা সময় একঘেয়েমি আচরণের কারণে যাত্রীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে এঠে। নিজেদের অহেতুক এবং হটকারী সিদ্ধান্তে অনেক সময়ই অনেক যাত্রীর প্রাণ গিয়েছে এবং যাত্রীদের জীবন অনেক বিপজ্জনক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে।

নিয়মবহির্ভূত কেবিন দিয়ে অনেক লঞ্চে নানান অনৈতিক কাজও করিয়ে থাকে। বিভিন্ন সময় কেবিনে এসে অনেক যাত্রীর আকস্মিক মৃত্যু হয়। অনেকেই ভাবে এখানে মেরে ফেলা সহজ। কেননা পরিচয় নিয়ে ঝামেলা নেই। কোনোমতে সদরঘাট অতিক্রম করলে বাঁচা যাবে।

সাম্প্রতিক সময়ে লঞ্চে লঞ্চে ধাক্কায় যে পাঁচজনের প্রাণ গেল, এটা কতটা বেদনাদায়ক। এই যে লঞ্চে লঞ্চে ধাক্কাধাক্কি এটা কি নতুন কোনো সংবাদ? সদরঘাট গেলেই দেখা যায়, একে অপরকে কতটা সজোরে ধাক্কা দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। কী বিকট শব্দ হয়। অথচ এসব ধাক্কায় লঞ্চের নিচে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। যেটা হয়তো সঙ্গে সঙ্গে টের পাওয়া যাবে না। ঘটে যেতে পারে শত শত মানুষের জীবনের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

এই যে লঞ্চ থেকে মালামাল নামানোর সময় কুলিদের আধিপত্যের থামানো সম্ভব হয়েছে আজ পর্যন্ত? শুধুই শিরোনাম হয়। অথচ দেখা যায়, কারও সঙ্গে পাঁচ-সাত কেজির একটা বস্তুা থাকলেও ওদের দিতে হয় ২০০–৩০০ টাকা কিংবা আরও বেশি। ওদের আচরণ এতটাই ভয়ংকর যে টাকা না দিলে লঞ্চ কিংবা টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার সুযোগই নেই। বরং বিভিন্ন মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব বিষয় আদৌ বন্ধ হবে যত দিন না কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা বন্ধ না হবে?

সব মিলিয়ে লঞ্চের যাতায়াত দিন দিন আধিপত্যের দিকে যাচ্ছে। লঞ্চের স্টাফ থেকে শুরু করে টার্মিনালের বিভিন্ন সিন্ডিকেটের নানান ঝামেলা লঞ্চযাত্রার প্রতি মানুষকে বিমুখ করছে এবং করবে আগামী দিনগুলোতে। সঙ্গে নিরাপত্তার অভাব তো যেমন পদে পদে। হুটহাট কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে নদীর পানি দেওয়া ছাড়া বিকল্প কিছুই নেই অধিকাংশ লঞ্চে। অধিকাংশ লঞ্চ এখনো কুয়াশার মধ্যে ঠিকমতো চালাতে পারে না আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে। যার ফলে হামেশাই ঘটে নানা দুর্ঘটনা।

শত শত যাত্রী অথচ একেকটা লঞ্চে নিরাপত্তার মতো কিছুই নেই। যেগুলো আছে নামসর্বস্ব। বিপদে কাজে আসার মতো কিছু নেই অধিকাংশ লঞ্চে।

এ বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। লঞ্চমালিকদের প্রতি বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া জরুরি এবং অতীব জরুরি লঞ্চের স্টাফদের শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া, যাত্রীদের হয়রানি বন্ধ করা, টার্মিনালের কুলিদের আধিপত্য বিস্তার বন্ধ করাসহ সার্বিক বিষয়। সঙ্গে অযোগ্য, ফিটনেসবিহীন লঞ্চগুলোর দ্রুত রোড পারমিট বাদ দেওয়া। কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই পদক্ষেপ নিলে কোনো কাজে আসবে না, আগে থেকে পরিকল্পনামাফিক কাজ না করলে।

লঞ্চ জার্নির মতো এতটা আনন্দদায়ক এবং ক্লান্তিহীন জার্নি কি আছে! এখানে এখন প্রয়োজন হয়রানি বন্ধ করা, সুযোগ–সুবিধা বাড়ানো, যাতায়াতে সময়ের ব্যাপ্তি কমানো, ভাড়া যাত্রীদের সাধ্যের মধ্যে রাখাসহ আনুষঙ্গিক সব বিষয় যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে দেখা। সঙ্গে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা কমাতে হবে। একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ নিয়ে যাত্রীদের প্রাপ্ত সেবার বিষয়গুলো ভুলে গেলে চলবে না এবং এর জন্য যথাযথ মন্ত্রণালয় সঠিক এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিলে খুব দ্রুততার সঙ্গে সমাধান করা সম্ভব হবে।

  • লেখক: মো. সায়েদ আফ্রিদী, সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]