বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় ডিজিটাল লাইব্রেরি ও আর্কাইভই হতে পারে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের নির্ভরযোগ্য উৎস
ডিজিটাল যুগে তথ্যের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ভুল তথ্যের বিস্তার। সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজসহ নানা মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার খবর, বিশ্লেষণ, মতামত ও সন্দেহজনক তথ্য মানুষের সামনে আসছে। এর মধ্যে অনেকগুলোই বিভ্রান্তিকর, আংশিক সত্য কিংবা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এমন একটি পরিবেশে পেশাদার সাংবাদিকতার ওপর মানুষের আস্থা ধরে রাখতে সংবাদপত্রের সবচেয়ে বড় কাজ হলো, সত্যতা যাচাই করে নির্ভরযোগ্য সংবাদ পরিবেশন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান সময়ে একটি সংবাদপত্র কীভাবে নিজেকে ভুল তথ্য থেকে রক্ষা করবে? উত্তর একটাই, ফ্যাক্ট চেকিং এবং শক্তিশালী ডিজিটাল লাইব্রেরি ও আর্কাইভ। ভবিষ্যৎ–সচেতন বড় সংবাদপত্রগুলো তাদের ডিজিটাল আর্কাইভকে শুধুই অতীত সংরক্ষণের ভান্ডার বানিয়ে রাখেনি; বরং এটিকে আজ তারা সত্য অনুসন্ধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
বর্তমান বিশ্বে ভুল তথ্য (মিসইনফরমেশন) ও অপতথ্য (ডিসইনফরমেশন): কেন বড় সমস্যা?
ডিজিটাল বিশ্বে তথ্য ছড়ানোর গতি এত দ্রুত যে সত্য-মিথ্যা আলাদা করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। মিসইনফরমেশনের (ভুল তথ্য) অনেকটাই অজান্তে ছড়ায়, কিন্তু ডিসইনফরমেশন (ইচ্ছাকৃত ভুল তথ্য) সাধারণত বিশেষ উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়। যেমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ব্যক্তিকে হেয় করা, ব্যবসায়িক লাভ/ক্ষতি, সামাজিক বিভ্রান্তি ছড়ানো ইত্যাদি।
একটি ভুয়া খবর প্রচারের কারণে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হতে পারে, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সুনাম নষ্ট হতে পারে, রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে পারে; তেমনি সামাজিক বিভক্তিও সৃষ্টি হতে পারে। তবে এই ক্ষেত্রে সংবাদপত্র যদি ভুল তথ্য পরিবেশন করে, তখন সেই ক্ষতিটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। কারণ, মানুষ সংবাদপত্রকে বিশ্বাস করে। এ কারণেই ‘তথ্যের সঠিকতা’ সাংবাদিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিকতা।
কেন সংবাদপত্রের ডিজিটাল লাইব্রেরি ও আর্কাইভ ফ্যাক্ট চেকিংয়ের কেন্দ্রস্থল?
একটি সংবাদপত্রের আর্কাইভ শুধু পুরোনো খবর সংরক্ষণ করে না; বরং এটি ঘটনার ধারাবাহিকতা, পটভূমি, উক্তি, পরিসংখ্যান, সরকারি তথ্য, বিশেষ প্রতিবেদন, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, ছবি, ভিডিও, ক্যাপশন, ইনফোগ্রাফ, সম্পাদকীয়—সবকিছু সুচিন্তিতভাবে শ্রেণিবদ্ধভাবে সংরক্ষণ করে। এগুলো একত্রে একটি বিশাল অথেনটিক ডেটাবেজ তৈরি করে, যা মিসইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন মোকাবিলা করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।
একটি শক্তিশালী ডিজিটাল লাইব্রেরি ও আর্কাইভই পারে ভুল উদ্ধৃতি চিহ্নিত করতে, ভুল ছবি শনাক্ত করতে, বিভ্রান্তিকর তথ্য শোধন করতে, কোনো ঘটনার অতীত রেকর্ড দেখাতে, বিতর্কিত বিষয় যাচাই করতে, পুরোনো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নতুন প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করতে। এই কারণেই উন্নত বিশ্বে প্রায় সব বড় সংবাদমাধ্যমে আর্কাইভসই হয়ে ওঠেছে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের জন্য একটি স্বীকৃত ধারণা ও উপায়।
ডিজিটাল বিশ্বে তথ্য ছড়ানোর গতি এত দ্রুত যে সত্য-মিথ্যা আলাদা করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। মিসইনফরমেশনের (ভুল তথ্য) অনেকটাই অজান্তে ছড়ায়, কিন্তু ডিসইনফরমেশন (ইচ্ছাকৃত ভুল তথ্য) সাধারণত বিশেষ উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়।
ফ্যাক্ট চেকিং কী ও কেন আর্কাইভস ছাড়া এটি অসম্পূর্ণ?
ফ্যাক্ট চেকিং হলো কোনো তথ্য, খবর, দাবি বা বক্তব্য, ছবি সত্য কি মিথ্যা, সঠিক কি ভুল, তা বিশ্বস্ত সূত্র ব্যবহার করে যাচাই করার প্রক্রিয়া। সহজভাবে বললে, যেকোনো তথ্য সত্য কি না, তা প্রমাণ খুঁজে দেখে নিশ্চিত হওয়াকে বলে ফ্যাক্ট চেকিং। অর্থাৎ ফ্যাক্ট চেকিংয়ের প্রধান উপাদান হলো, বিশ্বাসযোগ্য পুরোনো তথ্য।
তথ্যের উৎস যাচাই, বিশ্বস্ত প্রতিবেদন, রেকর্ড বা ডেটাবেজ মিলিয়ে দেখা, ভুল, বাড়িয়ে বলা বা বিভ্রান্তিকর অংশ শনাক্ত করা, নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া—দাবি সত্য, মিথ্যা নাকি আংশিক সত্য ইত্যাদি বিষয়গুলোর জন্যই ফ্যাক্ট চেকিং কাজ করে।
আর্কাইভ ছাড়া ফ্যাক্ট চেকিং অসম্পূর্ণ হওয়ার কারণ-
১. তথ্যের উৎস যাচাই
পুরোনো সংবাদ দেখে বোঝা যায় তথ্যের উৎস কোথায়। পূর্বে একই বিষয়ে কী বলা হয়েছিল, তথ্যের সঙ্গে পূর্ববর্তী রেকর্ডের মিল আছে কি না।
২. কনটেক্সট বোঝা
ভুল তথ্যের বড় একটি অংশ আসে কনটেক্সট বদলে দেওয়ার মাধ্যমে। আর্কাইভে পুরোনো পটভূমি দেখে সহজেই বুঝতে পারা যায় কোনটা সত্য, কোনটা আধা সত্য, কোনটা মিথ্যা।
৩. ছবি-ভিডিও যাচাই
ডিজিটাল আর্কাইভে সংরক্ষিত ছবি ও ভিডিওর মেটাডেটা থাকে, যাতে ছবিটি কবে তোলা, ফটোগ্রাফারের নাম, কোন সংবাদে ব্যবহার হয়েছে ইত্যাদি তথ্য সন্নিবেশিত থাকে।
৪. উদ্ধৃতি যাচাই
রাজনৈতিক বক্তব্য, আদালতের রায়, নীতিমালা—সবই আর্কাইভে সংরক্ষিত থাকে। সুতরাং ভুল উদ্ধৃতি সহজেই শনাক্ত করা যায়।
সত্য অনুসন্ধানের যুগে ফ্যাক্ট চেকিং শুধু সাংবাদিকতার একটি পরিপূরক অংশ নয়; বরং গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতার কেন্দ্রবিন্দু। মিসইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশনের আধুনিক যুগে সংবাদপত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো একটি সুসংগঠিত, বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল লাইব্রেরি ও আর্কাইভ। এটি শুধু অতীত সংরক্ষণ করে না; এটি ভবিষ্যতের সঠিক সংবাদ পরিবেশনের নিশ্চয়তাও দেয়।
একটি শক্তিশালী আর্কাইভকে কেন্দ্র করে সংবাদপত্র ভুল সংবাদ প্রতিরোধ, সোশ্যাল মিডিয়ার গুজব মোকাবিলা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উন্নয়ন, পাঠকের আস্থা বজায় রাখাসহ সব ক্ষেত্রে সফল হতে পারে। সুতরাং বলা যায়, আর্কাইভ ও ফ্যাক্ট চেকিং একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সত্য সংবাদ প্রতিযোগিতায় আর্কাইভই সাংবাদিকতার সবচেয়ে নীরব, অথচ সবচেয়ে শক্তিশালী সহায়ক।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]