জলবায়ু নাগরিক অধিকার ও নারীকেন্দ্রিক অভিযোজন কৌশল

প্যারিসের লো বুর্জে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের অনুষ্ঠানস্থলে কপ২১ লোগোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক নারীছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি। বারবার বন্যা, নদীভাঙন, খরা ও উষ্ণতার বৃদ্ধির ফলে এই অঞ্চলের কৃষিনির্ভর মানুষ নিয়মিত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এই প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভব করছেন নারীরা, যাঁরা ঘর সামলানো ও জীবিকা নির্ভরতা—উভয় চাপে পড়েন। অথচ নীতিনির্ধারণী ও উন্নয়ন কাঠামোয় নারীর অবদান প্রায়ই অদৃশ্য থাকে।

সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের কুড়িগ্রামের দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, ৭৩ শতাংশ নারী আর্থিক সাক্ষরতা জানেন না, ৮৪ শতাংশ নারী প্রাথমিক শিক্ষাও শেষ করতে পারেননি। অনেক নারী প্রতিবছর ঋণ নিচ্ছেন আগের ঋণ শোধ করতে, অর্থাৎ একটি ‘ঋণের চক্রে’ আটকে যাচ্ছেন। অনেকের হাতে নিজের উপার্জন নিয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। তা ছাড়া নারীর ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্তও নির্ভর করে পারিবারিকভাবে—বিশেষ করে স্বামী বা পুরুষ অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোয় নারীকে নিয়ন্ত্রিত অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যদিও সময়ের পরিক্রমায় নারীর অবস্থান এবং অংশগ্রহণের দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো সেই পট দৃশ্যমান। বিশেষ করে কুড়িগ্রামের নারীরা প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি এবং দুর্যোগপ্রবণতার দ্বৈত চাপে পড়েন। ফলে তাঁরা শুধু আর্থসামাজিক বৈষম্যের শিকারই নন, বরং পরিবেশগত সংকট থেকেও বাড়তি ঝুঁকিতে থাকেন। বৈশ্বিক উন্নয়ন মডেলের লক্ষ্য থেকে টেকসই জীবিকা কাঠামো (Sustainable Livelihood Framework) ব্যবহার করে নারী অভিযোজনের পাঁচটি মূলধনকে (মানব, সামাজিক, আর্থিক, প্রাকৃতিক, ভৌত) বিশ্লেষণ করে দেখা যায়:

• মানব মূলধন: নারীরা জলবায়ু-সহনশীল চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, সেলাই, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তবে সামাজিক বিধি ও স্বল্প শিক্ষার কারণে অনেকেই এই প্রশিক্ষণ কাজে লাগাতে পারছেন না।

• সামাজিক মূলধন: খাদ্য ব্যাংক, সঞ্চয় সমিতি, নারী গোষ্ঠীগুলো দুর্যোগে পারস্পরিক সহায়তার প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। এমনকি কেউ কেউ যৌথভাবে কৃষিকাজ বা ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনাও করছেন।

• আর্থিক মূলধন: বেশির ভাগ নারী ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে গবাদিপশু পালন বা ছোট ব্যবসায় বিনিয়োগ করছেন। তবে একই সঙ্গে অনেকে ঋণের দায়ে আবারও ঋণ নিচ্ছেন, যা ‘ঋণের ফাঁদ’ তৈরি করছে।

• প্রাকৃতিক মূলধন: ভূমির অধিকারের সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাব ও জলাবদ্ধতা নারীর চাষাবাদ ও জীবনযাত্রাকে প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

• ভৌত মূলধন: নিরাপদ আশ্রয়, রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ—এসব ক্ষেত্রে নারীদের প্রবেশাধিকারের অভাব স্পষ্ট। দুর্যোগকালীন আশ্রয়ে নিরাপত্তাহীনতা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে লিঙ্গ-সংবেদনশীল সেবা না থাকা নারীর দুরবস্থা বাড়িয়ে তোলে।

এই বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে—কেবল ঋণ দিলে কি নারীরা সহনশীল হবেন? উত্তর হলো, না। বরং প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন, যেখানে ঋণের পাশাপাশি থাকবে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা, কমিউনিটিভিত্তিক সংগঠন, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং সর্বোপরি নৈতিক ও কাঠামোগত সমতা।

নারীকেন্দ্রিক বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সম্প্রতি ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় প্রান্তিক নারীদের জলবায়ু সহনশীলতা তৈরি করতে ‘নারী সংবেদনশীল জলবায়ু সহনশীল প্রকল্প’ (Gender Transformative Climate Resilient Project) বাস্তবায়নে করেছে। সম্প্রতি ক্রিশ্চিয়ান এইড পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, কুড়িগ্রামের নারীরা জলবায়ু অভিযোজনের অগ্রনায়ক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁরা বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় গবাদিপশু পালন, ঝুঁকিহ্রাসমূলক চাষ, খাদ্য ব্যাংক, হাতের কাজ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছেন। এই অভিযোজনে বিভিন্ন এনজিও ও ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের মাধ্যমে সহায়তা করছে। শুধু অর্থনৈতিক সহায়তাকে মূল কেন্দ্রে না রেখে সমাজের নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। কেবল টাকা দিয়ে নারীর জলবায়ু অভিযোজন ও ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। কারণ, জমির মালিকানা, পানি, নিরাপদ অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা, নারীবান্ধব বাজার—এসব মৌলিক সহায়তার অভাবে তাঁদের অভিযোজন সফল হয়ে ওঠে না। সফল অভিযোজনের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত, বহুমাত্রিক সহায়তা কাঠামো।

সম্প্রতি প্রথম আলো ও ক্রিশ্চিয়ান এইড আয়োজিত একটি গোলটেবিল আলোচনায় বলা হয়, নারীর ক্ষমতায়ন কেবল ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে সম্ভব নয়। বরং দরকার একটি বহুমাত্রিক ও নারীবান্ধব অভিযোজন কাঠামো, যেখানে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, নিরাপদ আবাসন, আইনগত সহায়তা ও সামাজিক স্বীকৃতি নিশ্চিত থাকবে। অভিযোজনের ক্ষেত্রে নারীর অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা জাতীয় নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এই আলোচনায় মিডিয়া, উন্নয়ন সংস্থা, স্থানীয় সরকার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো, যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলা, নারীর জমির অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং নারী নেতৃত্বের সুযোগ তৈরি করাকেই অভিযোজনের টেকসই পথে অগ্রসর হওয়ার মূল কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

নারীর অভিযোজনক্ষমতা কেবল তাঁদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ফল নয়, এটি নির্ভর করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতিক্রিয়াতেও। এ কারণে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (NAP), Nationally Determined Contributions (NDC) ও জলবায়ু-লিঙ্গ কর্মপরিকল্পনা (ccGAP) বাস্তবায়নে নারীর অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা প্রতিফলিত হওয়া জরুরি। স্থানীয় সরকার, এনজিও ও নারী সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে বাস্তবিক অর্থে কমিউনিটি–কেন্দ্রিক পরিকল্পনা নিতে হবে, যেখানে নারীর কণ্ঠস্বর ও সিদ্ধান্ত থাকবে অগ্রগামী। তাঁদেরকে নীতিনির্ধারক হিসেবেও বিবেচনা করতে হবে।

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত ‘একজন পূর্ণাঙ্গ নাগরিক’ হিসেবে। জলবায়ু–সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন ‘জলবায়ু নাগরিক অধিকার’-এর বাস্তবায়ন, যেখানে নারীর অধিকার থাকবে কেন্দ্রীয় জায়গায়। নারীর জলবায়ু অধিকারকে অগ্রাধিকার না দিলে ভবিষ্যতের জলবায়ু সংকট শুধু নারীর ওপর নয়, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—সব জায়গায় বহুমাত্রিক সংকটের জন্ম দেবে। তাই জলবায়ু–সংকটকে নারীর দৃষ্টিতে দেখা যেমন প্রয়োজন, তেমনি নতুনভাবে অন্তর্ভুক্তিকরণ নিয়ে রাষ্ট্র নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।

* লেখক: শুভ রায়, উন্নয়নকর্মী-মনিটরিং, ইভ্যালুয়েশন, অ্যাকাউন্টেবিলিটি ও লার্নিং, ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ (email: [email protected])

চাঁদ মিয়া, প্রভাষক; নৃবিজ্ঞান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (email: [email protected])