‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’—কোন গানে কার সুর
রাজা কৃষ্ণ মেনন পরিচালিত ‘পিপ্পা’ ভারতের ৪৫ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহতার জীবনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত বায়োপিক। ছবিতে যশস্বী সংগীতকার এ আর রাহমান কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটি পরিবেশন করেছেন। তবে বিতর্ক ওঠেছে গানটির মূল সুর তিনি বিকৃত করেছেন বা সঠিকভাবে তুলেননি। যে কারণে কলকাতা ও ঢাকা থেকে সমান্তরালে মিস্টার রাহমানের নিন্দামন্দ করা হচ্ছে। এমনকি তাঁর মিউজিক সেন্স নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। অবশ্য এ আর রাহমানের মিউজিক নিরীক্ষায় দোষের কিছু দেখেননি বলেই জানাচ্ছেন।
কীভাবে এই গানটি রেকর্ড করা হয়? কী কী পদ্ধতি ছিল সেখানে? খোঁজ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে আনন্দবাজার অনলাইন। জানা যাচ্ছে ‘পিপ্পা’ ছবির এই গানে একাধিক বাঙালি শিল্পী কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাশ, শালিনী মুখোপাধ্যায়, দিলাশা চৌধুরী, শ্রয়ী পাল প্রমুখ। তবে মূল উদ্যোগ ছিল রাহুলের।
নানা সময়ে বিভিন্ন গানের বাণী ও সংগীতায়োজন নিয়ে বহু তর্কই চলে আসছে। তাতে মূল গানের মহিমা ও তাৎপর্য তো কমেইনি বরং আলোচিত গানটি নিয়ে সবার আগ্রহ বেশ বেড়েছে। ‘পিপ্পা’ ছবির ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটির ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটবে বলে বোধ করি। এ গানকে কেন্দ্র করে পুরো ভারতবর্ষেই নজরুলচর্চা আরও বেগবান হবে।
১৯১১ সালে লেখা এবং ১৯৩৪ সালে রেকর্ডকৃত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ভারতের ‘জন গণ মন’ নিয়েও বিতর্ক ওঠেছে। গানটির সুরকার নাকি আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’ গানের অমর স্রষ্টা রাম সিং ঠাকুরি; রবীন্দ্রনাথ নন। বিবিসি বাংলা অবশ্য পুরনো রেকর্ডের ইতিহাস ঘেঁটে দেখিয়েছে, গানটির সুরকার নিশ্চিতভাবেই রবিঠাকুর, অন্য কেউ নন।
রবীন্দ্র–বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, লেখক রাম কুমার মুখোপাধ্যায় বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘জন গণ মন’-এর সুর যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া, তা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। গানটি ১৩১৮ বঙ্গাব্দে রচিত। ১৯১১ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে গাওয়া হয় সেটি। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত গানের সুর যে গ্রন্থাবলিতে লিপিবদ্ধ আছে, সেই স্বরবিতানের ১৬ নম্বর খণ্ডের ১৮০ নম্বর পাতায় রয়েছে। প্রথমে গানের কথা আর পরের পাতায় গানের স্বরলিপি রয়েছে।
তাহলে ভবিষ্যতেও কি এমনটা হতে পারে? কারার ঐ লৌহ–কবাটের আসল সুর কোনটা? নজরুলের আদি সুর, নাকি রাহমানের বর্তমানটা? এটা গেল গান নিয়ে কথকতার এক পার্ট। সব গানই যে লেখকের শতভাগ মৌলিকতার মুনশিয়ানা, এমনটা নাও হতে পারে।
গবেষক গোলাম মুরশিদ তাঁর লেখা ‘বাংলা গানের ইতিহাস’ বইতে লিখেছেন, কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা প্রথম যে-কবিতাটি গানের কাঠামোয় লেখা এবং গান হিসেবে পরে গাওয়া হয়েছে, সেটি হলো ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট।’ প্রথম গানটাই বিদ্রোহের গান! এ গানটা রচনা করার দু-তিন সপ্তাহ আগেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি, যে-কবিতার নাম অনুসারে তাঁর নিজের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘বিদ্রোহী কবি।’
গোলাম মুরশিদ আরও লিখেন, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিস নে আজি দোল’ নজরুলের লেখা প্রথম গজল; বাংলা সাহিত্যেরও প্রথম সত্যিকার গজল। এর আগে অতুলপ্রসাদ একটি অথবা দুটি গজল লিখেছিলেন, বলে কেউ কেউ বলেছেন। কিন্তু সুর থেকে তাঁদের গজল বলে চেনা যায় না। অপর পক্ষে, নজরুলের প্রথম গজলই বাংলা গজলের ইতিহাসে একটি খুব সফল এবং জনপ্রিয় গজল। গানটি তিনি রচনা করেন একটি উর্দু গজলের সুরে।
তাহলে আমরা দেখতেই পেলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশাত্মবোধক গান লিখেন বাউল আঙ্গিকের সুরে। আর নজরুল গজল লিখেন উর্দু গজলের সুরে। এবং এটাই হলো গান, সুর বা মিউজিকের বৈশ্বিক প্রবহমানতা। এমন বাস্তবতায় এ আর রাহমান যদি কবি নজরুল ইসলামের অমর বাণীতে সুরের নিরীক্ষা করেন, তাতে আসলে সংগীতের জাত যায় না। আমরা গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারি। ব্যক্তিগত আক্রমণ পুরোদস্তুর অনভিপ্রেত।
আমরা জানি এই সময় নজরুল বা রবিঠাকুরের প্রমিত বাণী ও সুরে সংগীত পরিবেশন করাটাই রাষ্ট্রীয়ভাবেই স্বীকৃত। তারপরও আধুনিক কালের কোনো মিউজিশিয়ান যদি নজরুল-রবি-ডিএল রায়-বঙ্কিমের বাণীতে নিরীক্ষাধর্মী সুরারোপ করতে চান, তাঁকে থামিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। সংগীতের বিশ্বজনীন চাওয়াটাতে সায় না দিতে পারাটা চরম রক্ষণশীলতা। আমরা সুরের ক্ষেত্রে ঔদার্যিক মন নিয়ে কিছুটা ছাড় বোধহয় দিতে পারি।
পাশাপাশি আমরা এইটুকু দাবি করতে পারি। এ আর রাহমানের মতো বিশ্বস্বীকৃত মিউজিশিয়ান কবি নজরুলের আদি সুরের দিকে আরেকটু খেয়াল রাখলেই ভালো করতেন। তাতে হয়ত চলমান বিতর্কটা এড়ানো সম্ভব হতো। সেই সঙ্গে এই গানটির মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক তাৎপর্যের আবেদনটাও সমুন্নত থাকত।
তারপরও বলব সংগীতের বিশ্বায়ন সফল হোক। আমরা মুক্তির সাধ নিয়ে আকাশে উড়ব ঠিক আছে। তবে সেটা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় উড়তে গিয়ে গ্রিক পুরাণের ইকারাসের ডানার মতো গলে না যায়। সংগীতের নৈতিক আইনটা যেন মনে রাখি।
গ্রিক দার্শনিক প্লেটোও যেমনটা বলেছেন, Music is a moral law. It gives soul to the universe, wings to the mind, flight to the imagination, and charm and gaiety to life and to everything.
লেখক: সাংবাদিক