বাংলাদেশের বন্ধু চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং

চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং
ছবি: সংগৃহীত

এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, রুদ্রসাগরে মাঝি পরাণ খুলে গান ধরল, চন্দ্রদা ধীরে ধীরে বললেন, এই হচ্ছে বাংলার সহজাত ভাটিয়ালি গান। আমি, তারিক সুজাত (কবি), দিব্য ও চন্দ্রদা ত্রিপুরা রাজ্যের নীড়মহল ভবন দেখতে গিয়েছিলাম।

২০০১ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের নিমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন ত্রিপুরার কবি অনীল সরকার। সঙ্গে এসেছিলেন কবি রাতুল দেব বর্মণ ও কবি চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং। কবি মুহাম্মদ সামাদ ভাই, সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের প্রভোস্ট। রীমা ভাবি অত্যন্ত যত্ন করে একটি মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন। সেখানেই মাটির মানুষ কবি অনীলদার সঙ্গে পরিচয়। তিনি কবি, ত্রিপুরা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী; কিন্তু সবার সঙ্গে প্রাণ খুলে গল্পে মাতিয়ে রাখলেন পরিবেশ।

কবি অনীলদার নিমন্ত্রণে আমি, তারিক সুজাত, ছোট্ট দিব্য আর কবি বেলাল চৌধুরী কয়েক মাস পর ত্রিপুরার উদ্দেশে রওনা করলাম। বেলাল ভাইয়ের আগ্রহেই আমাদের যাত্রার সূত্রপাত। তিনিই আমাদের যাত্রার রুট নির্ধারণ করলেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ত্রিপুরা ও কলকাতা শহর ছিল কবি বেলাল চৌধুরীর নখদর্পণে। তিনি বললেন, আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরা পৌঁছে যাব। তারিক, তুমি একটি গাড়ি নাও। সে গাড়িটা আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। সীমান্তের অপর প্রান্ত থেকে আগরতলার কবিরা আমাদের ত্রিপুরা শহরে নিয়ে যাবেন।

অনেক আগ্রহ আর চাপা উত্তেজনা নিয়ে আমরা রওনা দিলাম। দুপুরের মধ্যেই ত্রিপুরা সীমান্তে পৌঁছে গেলাম। বাংলাদেশের বর্ডারের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে আমাদের কাগজপত্রের দাপ্তরিক কাজগুলো সমাধা করলেন। এরপরই নো ম্যান্স ল্যান্ড। ছোটো একটি জায়গা, সেটুকু হেঁটে পার হতে হবে। আমরা স্যুটকেসগুলো হাতে নিয়ে হাঁটছি, ভেতরে অনেক উত্তেজনা কাজ করছে। কয়েক মিনিট হেঁটে এগিয়ে যেতেই দেখলাম, অপর প্রান্তে দুজন কবি ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং, অপরজন রাতুল দেব বর্মণ। তাঁরা আমাদের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। প্রবেশ করলাম ভারতীয় ইমিগ্রেশন কক্ষে।

তারিক ও বেলাল ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সঙ্গে। আমি আর দিব্য অপেক্ষা করতে থাকলাম ওয়েটিং জোনে। দেয়ালে টাঙানো নীড়মহলের ছবি। রাতের আলোয় এক অপূর্ব প্রাসাদ! সেই সঙ্গে চোখে পড়ল ত্রিপুরা রাজবাড়ীরও ছবি। মনে মনে ভাবলাম, এখানে যেতেই হবে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা গেস্ট হাউসের দিকে রওনা দিলাম।

গেস্ট হাউসে পৌঁছে নিজের কক্ষে গিয়ে জিনিসপত্র গোছগাছ করছি, এমন সময় তারিক এসে বলল, বেলাল ভাইয়ের রুমে এসো। সেখানে কিছু নাশতার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে চন্দ্রদা ও রাতুলদা অপেক্ষায় ছিলেন। নাশতা পরিবেশিত হলো, আমি দিব্যকে কিছুটা খাইয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। এ সময়ে কবি বেলাল ভাইসহ সবাই কবিতা নিয়ে নানা আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর একটি ফোন কল আসায় সেটা রিসিভ করতে রাতুলদা নিচে নামলেন।

ফিরে এসে তিনি জানালেন, বেলাল ভাই! খুবই দুঃখজনক একটি সংবাদ! কিছুক্ষণ আগে উগ্রপন্থীদের আক্রমণে একজন কংগ্রেস নেতা তাঁর বাসভবনে নিহত হয়েছেন। খুব জরুরি ভিত্তিতে শহরে এখন কারফিউ ঘোষণা হচ্ছে। কবি অনীলদা বললেন, আপনারা একদম গেস্ট হাউস থেকে বের হবেন না।

খুবই বিমর্ষ মনে দিব্যকে নিয়ে নিজ কক্ষে চলে এলাম। ভাবলাম, এ যাত্রায় বুঝি গেস্ট হাউসের রুমের ভেতরেই বসে থাকতে হবে। সেই স্বপ্নের নীড়মহল আর ত্রিপুরা রাজবাড়ী বুঝি আর দেখা হবে না। বেশ কিছুটা সময় পার হওয়ার পর, তারিক সুজাত কক্ষে এলেন হাসিমুখে। তাঁরা ইতিমধ্যে একটি জম্পেশ পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। কবি অনীলদা আমাদের জন্য এয়ার টিকিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আমরা আগামীকাল সকালে কলকাতায় চলে যাব। দুই দিন কলকাতায় অবস্থান করে আবার ত্রিপুরায় ফিরে আসব, এর মধ্যে ত্রিপুরার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

আমি বিষয়টি শুনে খুবই অবাক হয়ে বললাম, আমরা গেস্ট হাউস থেকে বের হয়ে বিমানবন্দর পর্যন্ত কী করে যাব এই কারফিউয়ের মধ্য দিয়ে! তারিক বলল, তুমি এসব কিছু ভেব না, অনীলদা ব্যবস্থা করবেন। রাতুলদা আবার এসে জানিয়ে গেলেন, শহরের পরিস্থিতি থমথমে। ভারতের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা শহরজুড়ে জিপ গাড়ি নিয়ে টহল শুরু করেছে। অবাক হলাম ব্লাকক্যাটের কথা শুনে। ভাবলাম, এরা আবার কেমন সেনাবাহিনী! চন্দ্রদা জানালেন, এরা কালো পোশাকধারী সেনাবাহিনীরই একটি বিশেষ অংশ।

সেভেন সিস্টারের রাজ্যগুলোতে প্রয়োজনে তারা টহল ও নিরাপত্তার কাজ করে থাকে। কিছুটা চাপা দুশ্চিন্তা নিয়ে সেদিন রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙল। চন্দ্রদা হাসিমুখে এসে উপস্থিত, আমাদের বিমানবন্দরে নেওয়ার জন্য। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, চন্দ্রদা পথে কোনো বিপদ হবে না তো? সহাস্যে চন্দ্রদা জানালেন, নিচে নেমেই দেখুন না, আপনাদের জন্য অনীলদা কী ব্যবস্থা করেছেন! ছোট্ট দিব্যকে নিয়ে নিচে নেমে দেখি, বেশ বড় একটি জিপ অপেক্ষমাণ।

আমাদের গাড়ি পুলিশি পাহারায় যাবে। সামনে বসলেন চন্দ্রদা, জিপের পেছনে দুজন সেনাবাহিনীর লোক এবং মাঝখানে আমি, তারিক, বেলাল ভাই ও দিব্য আমার কোলে। যাত্রা শুরু। আমার মাথায় তখনো কিন্তু একই চিন্তা খেলে যাচ্ছে, কীভাবে এই আগরতলা রাজ্যেটি ভ্রমণ করে দেখব! কবিরা তো ফিরে এসে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বেন তাঁদের নিজস্ব আড্ডায়।

কিন্তু আমার তো দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে হবে। ধীরে ধীরে চন্দ্রদাকে জিগ্যেস করলাম, চন্দ্রদা, ফিরে আসার পর ত্রিপুরার অবস্থা স্বাভাবিক হবে তো? চন্দ্রদা মিষ্টি হেসে বললেন, বউদি, চিন্তা করবেন না, আশা করছি সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তখন আমি আপনাদের নীড়মহল দেখাতে নিয়ে যাব। আর রাজবাড়ী তো দেখবেনই, সেটা শহরের মধ্যেই।

আমি জানতে চাইলাম, নীড়মহল কি অনেক দূরে? তিনি জানালেন, কিছু দূরে, তবে তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। আমরা গাড়ি নিয়ে যাব। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করলাম, আপনি যে ঢাকার কবিতা উৎসবে অসাধারণ সুন্দর একটা উত্তরীয় পরেছিলেন, সেটা কি উপজাতীয়দের তৈরি? চন্দ্রদা বললেন, আমাদের এখানে বেশ কিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আছে, তারাই এ ধরনের উত্তরীয় তৈরি করে থাকে। আপনার পছন্দ হয়েছে বউদি? আমি বললাম, হ্যাঁ, চন্দ্রদা। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি এ ধরনের জিনিস সংগ্রহ করি। চন্দ্রদা বললেন, কোনো অসুবিধা নেই বউদি। কলকাতা থেকে ঘুরে আসুন, আমি আপনাকে নিয়ে যাব সেসব দোকানে।

কথা বলতে বলতে বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। সেখানেও কবি অনীলদা আমাদের জন্য সুব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। খুব সহজে সিকিউরিটি চেক শেষ হলো। আমরা বিমানে ওঠার আগে চন্দ্রদার থেকে বিদায় নিলাম। তাঁর কিছু কথায় মনে হলো তিনি যেন নিজের খুব আপনজনকে বিদায় দিচ্ছেন! আবেগঘন কণ্ঠে তিনি বললেন, দুই দিনের বেশি কিন্তু দেরি করবেন না বউদি, তারিকদা আমি আবার বিমানবন্দরে আসব আপনাদের নিতে। কলকাতা থেকে কিন্তু ঢাকায় ফিরে যাবেন না। এই ত্রিপুরাবাসী আপনাদের জন্য অপেক্ষা করবে। ফিরে এসে অনুষ্ঠান শেষ করে তবেই ঢাকায় ফিরে যাবেন। তাঁর এ আন্তরিক কথাগুলোয় মনে হলো তিনি যেন নিজের ঘরের লোককে বিদায় দিচ্ছেন।

কিছুটা বিষণ্নœমনেই উড়োজাহাজে উঠে বসলাম। টেকঅফের পর আমি ভাবছি রাতুলদার কথা, চন্দ্রদার কথা। তারিক জানাল, এ সহজ-সরল মানুষ চন্দ্রকান্তদা ‘ককবরক ভাষা’র একজন কবি। এটি মূলত ত্রিপুরার আদিবাসী মানুষের ভাষা। বিজ্ঞ পণ্ডিত একজন কবি, তিনি দিল্লি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন লেখক। কিন্তু এত সদাসয়, সাধারণ জীবন যাপন করেন। তাঁর জ্ঞানই তাঁকে এই নিরহংকার জীবনের আলো দিয়েছে। নির্লোভ এক মানুষ চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং।

দুই দিন পর আবার ত্রিপুরায় ফিরে এলাম। দেখি বিমানবন্দরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন চন্দ্রদা, আমাদের রিসিভ করার জন্য। আমার মনটা খুশিতে ভরে গেল। আমি তারিককে বললাম, দেখো, ওই যে চন্দ্রদা এসেছেন! তারিক বলল, হ্যাঁ, চন্দ্রদা তো আসবেনই। অনীলদা তাঁকে আমাদের সঙ্গে সব সময় থাকতে অনুরোধ করেছেন। গেস্ট হাউসে ফেরার পথে চন্দ্রদা বললেন, বউদি আগামীকাল বেলালদা অনীলদার বাসায় যাবেন। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ওখানে আলাপ-আলোচনা হবে। কিন্তু আপনি যদি চান আগামীকাল সকালে তারিকদা আপনি আর দিব্য সোনাকে নিয়ে রুদ্রসাগর আর নীড়মহল দেখতে যেতে পারি।

আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি তো তার অপেক্ষাতেই আছি, চন্দ্রদা। পরদিন খুব ভোরে চন্দ্রদা জিপ নিয়ে গেস্ট হাউসে হাজির। অনীলদা আমাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সেদিনও দুটি সৈন্যকে সঙ্গে দিয়েছেন। কেন না শহরের পরিস্থিতি তখনো কিছুটা থমথমে ছিল।

ত্রিপুরা শহর থেকে রুদ্রসাগরের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। আমরা রওনা হলাম। চন্দ্রদা মাঝেমধ্যেই তারিকের সঙ্গে ঢাকার কবিদের লেখালিখি এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করছেন। একই সঙ্গে ত্রিপুরার কবিদের অবস্থান, কবিতা লেখার বিষয় ইত্যাদিও তাঁদের আলাপে উঠে আসছে।

আমরা ত্রিপুরা শহর পেরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম গাছপালা ঘেরা বনভূমির দিকে। সেই বনভূমির ভেতরে আছে ছোটো একটি চিড়িয়াখানা। চন্দ্রদা বললেন, বউদি, আমরা এখন দ্রুত বনভূমিটা পার হয়ে প্রথমে রুদ্রসাগরে চলে যাব। ফেরার পথে এখানে আবার দাঁড়াব। এই চিড়িয়াখানায় বেশ কিছু প্রাণী আছে, সেগুলো দিব্য দেখে খুব আনন্দ পাবে।

আমি বললাম, চন্দ্রদা, আপনি যেভাবে পরিকল্পনা করবেন, সেভাবেই আমরা এগোব। রুদ্রসাগর এক বিশাল জলাধার। এ জলাধারের মধ্যখানে একটি প্রাসাদ নির্মিত হয়েছে। রাজপরিবারের মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন। নীড়মহল সাদা মার্বেল পাথরের রঙের একটি প্রাসাদ। রাতে নীড়মহলকে অপূর্ব সুন্দর দেখায়। চন্দ্রদা বর্ণনা শুরু করলেন, জোছনা রাতে এখানে অনেক দর্শনার্থী আসে, জোছনার আলোতে প্রাসাদটিকে অপরূপ দেখায়। নৌকা দিয়ে আমরা নীড়মহলে যাব।
সাঁতার জানি না, আমি কিছুটা ভয় পেলাম।

দিব্যও তখনো সাঁতার শিখে ওঠেনি। বললাম, চন্দ্রদা, নৌকাটি নিরাপদ হবে তো? তিনি হেসে জানালেন, আমি সাঁতার জানি। আর কোনোভাবেই ভয় করবেন না। নৌকাটি নিরাপদ। তা ছাড়া এ জলাশয়ে তেমন কোনো স্রোত নেই। নৌকায় ওঠার পর রুদ্রসাগরের সৌন্দর্যে সব ভয় হারিয়ে গেল। সেই সঙ্গে দূরে নীড়মহল দেখা যাচ্ছে।

ধীরে ধীরে নৌকা এগিয়ে যেতেই চোখের সামনে নীড়মহল স্পষ্ট হয়ে উঠল। চন্দ্রদা বললেন, বউদি, এ নীড়মহলেই আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ দুবার এসে থেকেছেন। রবীন্দ্রনাথ মোট আটবার আগরতলায় এসেছেন। এখন এখানে একটি ছোটো জাদুঘর স্থাপন করা আছে। তবে তেমনভাবে সংস্কার বা যত্ন করা হচ্ছে না, সে জন্য এখানে কিছুটা রঙের মলিনতা দেখা যায়। কিন্তু তার পরও প্রাসাদটি অত্যন্ত সুন্দর। মাঝি ভাই নৌকাটিকে ঘাটের কাছে নিয়ে গেলেন। আমাদের সযত্নে হাত ধরে ঘাটে নামালেন চন্দ্রদা।

তিনি আমাদের প্রাসাদের ভেতরের সব কটি কক্ষ ঘুরে দেখান। এত সুন্দর করে বর্ণনা দিলেন, যেন মনে হলো ইতিহাসের ধারক। কোন ঘরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন, কার কার সঙ্গে এখানে এসে দেখা করেছিলেন, কার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব হয়েছিল, ত্রিপুরার রাজপরিবারের কোন কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন—নানা কিছু চন্দ্রদা আমাদের বর্ণনা করলেন। আমাদের সঙ্গে ছিল খুব সাধারণ ছোট্ট একটি ক্যামেরা। আমরা ছবি তুলছিলাম। চন্দ্রদা আমাদের তিনজনের ছবি তুলে দিয়েছিলেন, তিনিও আমাদের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন। ফেরার জন্য আমরা আবার নৌকায় উঠলাম। মাঝি ভাই তখন গান ধরলেন। চন্দ্রদা জানালেন, মাঝি তাঁর সহজ সরল গলায় এ অঞ্চলের ভাটিয়ালি গান ধরেছে।

নৌকাভ্রমণ শেষে আবার জিপে উঠলাম। এবারের গন্তব্য সেই বনভূমির সঙ্গে চিড়িয়াখানা। চন্দ্রদা দিব্যর জন্যই চিড়িয়াখানায় ঘুরতে যেতে চাইলেন। বললেন, এখানে বেশ কিছু প্রাণী আছে। বউদি, দিব্য খুব মজা পাবে। দিব্যকে নিয়ে তিনি হরিণ, হাতি, চিতাবাঘ, ময়ূরসহ অনেক প্রাণীর খাঁচার সামনে গেলেন। হরিণগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দিব্য খুবই আনন্দের সঙ্গে একটি হরিণের পেছনে কিছুক্ষণ ছুটল। চন্দ্রদা শিশুর মতোই দিব্যর সঙ্গে সঙ্গ দিলেন। তারপর আবার আমরা ফিরে চললাম গেস্ট হাউসের পথে। ফেরার পথে চন্দ্রদা তারিকের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন ত্রিপুরার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে।

আবার আমাকে বলেন, বউদি, আগামীকাল কি মহারাজার বাড়ি দেখতে যাবেন? বিকেলে তো অনুষ্ঠান, সকালটা তো খালি আছে আপনাদের হাতে। আমি বললাম, অবশ্যই দেখতে চাই। তিনি জানালেন, আগামীকাল রাতুলদা আপনাকে রাজবাড়ীতে নিয়ে যাবে আর আমি দুপুরের দিকে এসে আপনাকে সেই দোকানগুলোতে নিয়ে যাব, যেখানে আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর হাতে তৈরি জিনিসগুলো দেখতে চেয়েছেন। আমি অবাক হলাম! কীভাবে চন্দ্রদা মনে রেখেছেন!

পরদিন সকালে রাতুলদা এলেন। আমি দিব্য আর রাতুলদা গেলাম মহারাজার বাড়ি দেখতে। সে যে কী অপূর্ব সুন্দর মহারাজার বাড়ি! সামনে একটি বিশাল দিঘি। ছোট্ট দিব্যর জন্য রাতুলদা চিনাবাদাম কিনে আনলেন। আমি বললাম রাতুলদা, মহারাজার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না? তিনি বললেন, মিমি, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আজ জাদুঘর বন্ধ। তবু তোমার এত দেখার ইচ্ছা, ভাবলাম এখানে এসে কিছুক্ষণ বসলে তোমার হয়তো ভালো লাগবে। রাতুলদা, রাতুল দেব বর্মণ প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের পূর্বসূরি। তিনি সতীনাথ ও রাজবাড়ীর বিভিন্ন গল্প আমাকে বললেন। এভাবে বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল, এরপর রাতুলদা বললেন, চলো, তোমাকে নিয়ে এখানের কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখাই।

আমি বললাম, এখানে বেতের তৈরি জিনিসের দোকান কি আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি তো ইন্টেরিয়রের কাজ করো, আমি তোমাকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাব, সেসব প্রোডাক্ট ইন্টেরিয়রের সঙ্গে সম্পর্কিত। রাতুলদা আমাকে নিয়ে গেলেন ত্রিপুরাবাসীর অপূর্ব বেতশিল্পের দোকানে। সেখানে বেতের যেসব জিনিস দেখেছিলাম, আজ বহু বছর পরও আমার চোখের সামনে তা সুস্পষ্ট।

সব সুন্দর ক্রয় করা সম্ভব নয়। আমি আপন মনে বেতের তৈরি জিনিসগুলো দেখে নিলাম। রাতুলদা বললেন, এগুলো ঢাকায় নেওয়া সম্ভব নয়। এবারে চলো তোমার জন্য যা নেওয়া সম্ভব, সেখানে নিয়ে যাই। আমরা একটি শাড়ির দোকানে গেলাম। আমি বললাম, রাতুলদা, আমি শাড়ি কিনতে আগ্রহী, তবে ত্রিপুরার ঐতিহ্যবাহী শাড়ি কি এখানে আছে? রাতুলদা বললেন, আমি তোমার রুচি বুঝে গেছি, এ দোকানেই আমাদের সেই ঐতিহ্যবাহী হ্যান্ডলুমের মসলিন শাড়ি রয়েছে। আমি কোরা সাদা অপূর্ব সুন্দর একটি মসলিন শাড়ি সেই দোকান থেকে কিনলাম।

রাতুলদা আমাদের গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিলেন। দুপুরে জম্পেশ খাওয়াদাওয়ার পর আমি ভাবলাম একটু বিশ্রাম করি। বিকেলে তো আবার অনুষ্ঠান আছে। এমন সময় ঠিক বেলা তিনটায় চলে এলেন চন্দ্রদা। তিনি এবার আমাদের নিয়ে গেলেন শহরের একটি জায়গায়, যেখানে সারিবদ্ধভাবে বেশ অনেকগুলো দোকান। কিন্তু অধিকাংশ দোকান পরপর বন্ধ। আমি বললাম, চন্দ্রদা দোকানগুলো তো বন্ধ। তিনি জানালেন, শহরের পরিস্থিতি তেমনভাবে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। তবে আমি একটি দোকানদারকে বলে রেখেছি। তিনি দোকান খুলে অপেক্ষা করছেন।

আমি খুবই অবাক হলাম, চন্দ্রদা আমার জন্য একটি দোকান খোলার ব্যবস্থা করেছেন এই পরিস্থিতিতেও! দোতলা একটি ভবনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটি দোকানে প্রবেশ করলাম। দোকানে ঢুকেই বুঝলাম, এটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর হাতে তৈরি তাঁতের সব পণ্য দিয়ে সাজানো। চন্দ্রদা তাঁদের নিজেস্ব ভাষায় দোকানিকে কিছু বললেন। মেয়েটি অত্যন্ত ক্ষিপ্র হস্তে শোকেস থেকে কিছু পণ্য বের করল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, কী অপূর্ব উজ্জ্বল রঙের লাল-সবুজ সুতা দিয়ে বোনা সব জিনিস। আমি ভাবলাম, এগুলো বুঝি উত্তরীয়।

কিন্তু চন্দ্রদা আমাকে ব্যাখ্যা করলেন, আসলে এগুলো সব উত্তরীয় নয়। ত্রিপুরার পুরুষেরা উত্তরীর হিসেবে পরিধান করে আবার ত্রিপুরার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা একে থামেল বলে পোশাকের অংশ হিসেবে বক্ষবন্ধনী হিসেবেও পরিধান করেন। এ-জাতীয় পোশাক সম্পর্কে আমি আগেই খানিকটা পরিচিত ছিলাম। বললাম, চন্দ্রদা, আমি আসলে এগুলোকে পোশাক হিসেবে ব্যবহার করব না। তিনি বললেন, তাহলে এটি আপনাদের দেশে ওড়নার মতো করে পরবেন? বউদি, এটি কিন্তু খুব সহজেই ধুয়ে ফেলা যায়, খুব পাকা রং।

আমি বললাম, না, চন্দ্রদা, আমি পোশাক হিসেবে পরব না। আমি এগুলো সংগ্রহ করি, যেহেতু গৃহের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা নিয়ে কাজ করি। আমি এগুলো টেবিল রানার হিসেবে ব্যবহার করব। তিনি বললেন, টেবিল রানার! আমি বুঝিয়ে বললাম, ওই যে টেবিলের ওপর সুজনির কাজ করা কাপড়, যার ওপরে জিনিসপত্র সাজায়। চন্দ্রদা অত্যন্ত খুশি হয়ে মেয়েটিকে তাদের নিজস্ব ভাষায় বললেন, আরও কিছু পণ্য দেখাতে। মেয়েটি একের পর এক পণ্য দেখিয়ে যাচ্ছে। আমার একটু লজ্জাই হলো, আমি তো এত নেব না। চন্দ্রদাকে বললাম, ওকে আর কষ্ট করতে বারণ করুন। আমি মাত্র দুটি বা তিনটি নেব।

এবার আমি একটি বড় ভুল করে বলে ফেললাম। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললাম, চন্দ্রদা, আপনার এই উত্তরীয়টার মতো সুন্দর রঙের কিন্তু পেলাম না। এবার চন্দ্রদা সত্যি সত্যি লজ্জা পেলেন। বললেন, ওটা কি বউদি আপনার খুব পছন্দ হয়েছে?

এবার আমার লজ্জা পেতে হলো। বললাম, ওটার মতো রং যদি পাওয়া যেত, তাহলে ভালো হতো। তিনি বললেন, আমি ওটা নিয়ে আসব আজ সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে। আপনার বউদিকে বলব, আপনার জন্য ওটা দিয়ে দিতে। আমি বললাম, না, চন্দ্রদা, ওটা আপনি কবিতা উৎসবে পরেন। ওটা আনার দরকার নেই। এখান থেকে তো কিনলাম।

অনুষ্ঠানে ভিন্ন ধরনের মজার একটি ঘটনা ঘটল। ইতিমধ্যে দিব্য বুঝে গেছে, এখানে সব কবিই তার খুব কাছের মানুষ এবং তার সর্বত্র অবাধ বিচরণের সাবলীল অধিকার আছে। কবি অনীলদার বাসায় নিমন্ত্রণ ছিল, সেখানে অনীলদার স্নেহাশিস পেয়েছে দিব্য। কিন্তু ছোট্ট দিব্য তো এটা বুঝেনি যে অনীলদা একজন কবি হলেও তিনি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীও।

ফিতা কেটে অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের সময় দিব্য আমার পাশ থেকে উঠে ছুটে গেল অনীলদার কাছে। খুবই বিব্রত হলাম; কিন্তু অনীলদা দিব্যকে হাতে নিয়েই ফিতা কেটে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করলেন। খুব সুন্দর ছিল সেদিনের অনুষ্ঠান, কবিতা আবার কিছু প্রবন্ধের আলোচনা এভাবেই এগিয়ে চলল অনুষ্ঠান। একসময় শেষ হলো সব আয়োজন। আমরা প্রস্তুত হলাম ফিরে আসার।

তারিক আমাকে বলল, তুমি দিব্যকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসো। আমরা কিছুক্ষণ পরই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেব। আমি গাড়িতে বসেছি, কিন্তু চন্দ্রদা আবারও এলেন। বললেন, বউদি একা বসে থাকবেন? আমি বসি আপনাদের সঙ্গে। তারিকদা আর বেলালদা এলে আপনাদের বিদায় দিয়ে আমি চলে যাব।

এমন সময় ছোট্ট দিব্য বলে উঠল আমিও একটি কবিতা লিখব। আমি আর চন্দ্রদা বিস্ময়ের সঙ্গে দিব্যর দিকে তাকালাম। দিব্য বলে উঠল, কবিতার নাম:
যুদ্ধের সমাজ
যুদ্ধে যুদ্ধে শেষ হয়
দেশের পর দেশ
যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীন হয়
দেশের পর দেশ
যুদ্ধে যুদ্ধে ভাঙে
ঘরের পর ঘর
যুদ্ধে যুদ্ধে মরে
মানুষের পর মানুষ।
(ফেব্রুয়ারি, ২০০১)
চন্দ্রদা বললেন, বউদি, এ তো সত্যিকারের কবি।

ইতিমধ্যে বেলাল ভাই ও তারিক গাড়ির কাছে চলে এল, কবি অনীলদা এলেন আমাদের বিদায়ের পালায়। অনীলদা আমাদের সবাইকে আলিঙ্গন করে বিদায় জানালেন। আমার চোখে পানি চলে এল। রাতুলদা এসে বললেন, আমি ঢাকায় যাওয়ার সময় কিছু প্রয়োজন হলে বলবেন।

আমি নিয়ে যাব। এমন সময় চন্দ্রদা আমার হাতে একটি প্যাকেট দিলেন। আমি দেখলাম প্যাকেটে সেই উত্তরীয়টা। চন্দ্রদা বললেন, বউদি এটি আপনার কাছে থাকুক।

চন্দ্রদা আজ চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর স্মৃতি বাংলাদেশের বন্ধুদের মাঝে চিরদিন অম্লান থাকবে।

লেখক: নাজনীন হক মিমি, গুলশান, ঢাকা