ব্যাটারি রিকশার আবির্ভাব: ঢাকার প্রিয় প্যাডেল রিকশার ভবিষ্যৎ কী
তিন শ বর্গকিলোমিটার আয়তন আর আড়াই কোটি মানুষের এই ঢাকায় গণপরিবহন বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মধ্যে অবধারিতভাবে একটা অন্যতম বাহন হলো রিকশা। আপনি যদি এই শহরের বাসিন্দা হন এবং ব্যক্তিগত গাড়ি অথবা বাইক ব্যবহারকারী না হন, তাহলে নির্ঘাত আপনারও নিত্য ব্যবহার্য এক বাহন হলো রিকশা। ঢাকার এই রিকশানির্ভরতা কিন্তু আজকালের নয়, এটা দশকের পর দশকজুড়েই ঢাকার পথের অন্যতম বাহন। রিকশার উদ্ভাবন জাপানে ১৮৭০–এর দশকে, সময়ের পরিক্রমায় ঢাকায় রিকশা আসে ১৯৩৮ সালে। তারপর থেকেই ঢাকার রাস্তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই রিকশা। যুগ যুগ ধরে এর চাহিদা বেড়েছে বৈ কমেনি। বলা হয়, একসময় এই শহরে ভ্রমণের ৫৪ শতাংশই হতো রিকশায়। রিকশা শুধু যে একটি বাহন, তা নয়, রিকশা হয়ে গিয়েছে ঢাকার ইতিহাসের অংশ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যেমন রিকশার ওপর শহীদের মৃতদেহের ছবি দেখতে পাবেন, তেমনি চব্বিশের অভ্যুত্থানেও শহীদ বা আহতদের রিকশায় যাতায়াতের দৃশ্য ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার।
শুধু ইতিহাস নয়, বাংলাদেশের বিনোদন জগতে রিকশা নিয়ে গান কিংবা নাটক-সিনেমায় রিকশায় করে নায়ক-নায়িকার ভ্রমণ দৃশ্য এক নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। এ শহরে প্রেমিক যুগলদের প্রিয় বাহন অদ্যাবধি রিকশা। ঢাকাকে একদা রিকশার শহর এ জন্যই বলা হতো। যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত রিটেইল ব্র্যান্ড Next Sourcing Ltd তাদের বাংলাদেশ অফিসের লোগোতেও রেখেছে রিকশার সাইন। কারণ, এই রিকশা কেবল ঢাকা নয়; বরং বাংলাদেশকেও প্রতিনিধিত্ব করে। এ কারণেই ২০১১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপের উদ্বোধনী আয়োজনে সব অধিনায়ককে রিকশায় করেই আনা হয়েছিল।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
রিকশা নামক এই ছোট কিন্তু প্রিয় বাহন নিয়ে ঢাকাবাসী সুখেই ছিল কিন্তু ঝামেলার শুরু হয় ২০০৭-০৮–এর দিকে এসে চীন উদ্ভাবন করে ব্যাটারিচালিত কিছুটা বড় এবং উচ্চগতিসম্পন্ন রিকশা, শুরুতে এটা তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি, মানুষ পছন্দও করত না; এমনকি কয়েক মাস আগেও ঢাকায় অটোরিকশা বা ব্যাটারিচালিত রিকশা আইনত নিষিদ্ধ ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিকেরা কীভাবে জোরপূর্বক ঢাকায় এই বাহন চালানোর অনুমতি আদায় করে নিয়েছে, তা আশা করি আমরা সবাই জানি।
শুরুর দিকে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা জনপ্রিয়তা পায় ঢাকার বাইরের জেলা শহর আর গ্রামগুলোতে। এখন তো তারা রীতিমতো ঢাকার রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আপনি হয়তো অবাক হয়ে দেখবেন, গুলশান-১ থেকে পুরান ঢাকার ১২-১৩ কিলোমিটার রাস্তাও তারা অনায়াসে পাড়ে দেয়। ব্যাটারিচালিত রিকশা সাইজে বড়, বসতে আরাম দ্রুত চলাচলে সক্ষম। তাই এটার জনপ্রিয়তা পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু বিপত্তি হলো পরিবহনটি হলো বড্ড বেপরোয়া। প্যাডেল রিকশা যেমন পায়ে চলত, তেমনি চালকের নিয়ন্ত্রণও ছিল সুন্দর; কিন্তু এই ব্যাটারিচালিত রিকশায় ব্যাটারির গতিতে রিকশা যেকোনো সড়কে যেকোনো গতিতে রীতিমতো আপনায় ‘উড়িয়ে’ নিয়ে যাবে, ফলে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটছে নিয়মিতই...!
আর এই ব্যাটারিচালিত রিকশার অধিকাংশই চার্জ করা হয় অবৈধ বৈদ্যুতিক লাইনে, তাই বিদ্যুতের চুরি আর ন্যাশনাল গ্রিডের ওপর চাপের ব্যাপার তো আছেই। দ্রুতগতি, দুজনের বদলে তিনজন বসার ব্যবস্থা এসব কারণে গণমানুষের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশার চাহিদা বাড়াটা স্বাভাবিক আর সেই সঙ্গে বাড়বে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। যেহেতু বাধ্য হয়ে এই ব্যাটারিচালিত রিকশার অনুমোদন দেওয়াই হয়েছে, তাই আশা করব সরকার এটার চালক ও মালিকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেবে এবং নীতিমালা করে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশার একটি নিরাপদ সংস্করণ উদ্ভাবন করেছে; কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা আদতে আলোর মুখ দেখবে কি না, সে হলো বড় প্রশ্ন...!
মাত্র কয়েক মাস আগেও যেখানে তিন-চারটি গতানুগতিক প্যাডেল রিকশার ভিড়ে মাত্র একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা দেখা যেত, এখন চিত্রটা পুরোটা উল্টো প্যাডেল রিকশা খুঁজে পাওয়া দায়...! জনগণও একসময় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা এড়িয়ে চললেও এখন আর এটা নিয়ে কারও মেধ্য আপত্তি বা উদ্বেগ দেখা যায় না।
ব্যাটারিচালিত রিকশার গতি আর সব সুবিধার সামনে কোথাও না কোথাও আমরা আমাদের সেই ঐতিহ্যবাহী প্রিয় পুরোনো প্যাডেল রিকশাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি না তো...?
লেখক: মো. ফাত্তাউর রহমান ইমন, প্রকৌশলী, ঢাকা