বিশ্ব ডাক দিবস: গ্রাহক প্রত্যাশা ও আমাদের বাস্তবতা
আজ ৯ অক্টোবর। বিশ্ব ডাক দিবস। Local Service, Global Reach—বাংলায় স্থানীয় পরিষেবা: বৈশ্বিক পরিসর প্রতিপাদ্যে সারা বিশ্বে আজ দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ডাকব্যবস্থাকে একত্র করে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সহজ করে তোলার উদ্দেশ্যে ১৮৭৪ সালের ৯ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে ‘ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন (UPU)’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রায় শত বছর পর ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ৯ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব ডাক দিবস’ ঘোষণা করা হয়। তখন থেকেই দিনটিকে বিশ্ব ডাক দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হচ্ছে। বিশ্ব ডাক দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো ডাকসেবার গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা, ডাক বিভাগের কর্মীদের অবদান স্বীকৃতি দেওয়া এবং আধুনিক ডাক ও কুরিয়ার সেবার উন্নয়নকে উৎসাহিত করা।
বিশ্বের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের প্রাচীনতম ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হলো ডাকব্যবস্থা। চিঠির মাধ্যমে ভালোবাসা, খবর ও সংস্কৃতির আদান–প্রদান যুগ যুগ ধরে মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে ডাকের এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন’–এর ১৪৭তম সদস্য পদ পাওয়া বাংলাদেশও আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করছে।
প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও আধুনিক প্রযুক্তি অভিযোজনের মাধ্যমে সাশ্রয়ী, মানসম্পন্ন ও আন্তর্জাতিক মানের ডাকসেবা নিশ্চিতের অঙ্গীকার নিয়ে চলা বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থা একটি ঐতিহ্যবাহী ও জনবান্ধব সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর থেকেই ‘বাংলাদেশ ডাক বিভাগ’ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে যোগাযোগ ও সেবার বন্ধন গড়ে তুলেছে। এখন ‘নাগরিক সেবা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া’র লক্ষ্য নিয়ে ডাক বিভাগ কাজ করছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য পরিবহনে ডাক বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ জনগণের কাছে সহজে আর্থিক ও সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে ডাক বিভাগ বাংলাদেশ সরকারের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু ডিজিটাল যুগে গ্রাহকের প্রত্যাশা বেড়েছে। দ্রুত ট্র্যাকিং, অনলাইন বুকিং, নিরাপদ আর্থিক লেনদেন এবং নির্ভরযোগ্য লাস্ট-মাইল ডেলিভারি এখন গ্রাহকের মৌলিক চাওয়া। ইউপিইউর ২০২২ সালের ‘পোস্টাল জার্নি টুওয়ার্ডস এ সাসটেইনেবল ফিউচার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ডমেস্টিক পার্সেল ভলিউম দ্রুত বাড়ছে ফলে আইসিটিবেজড লজিস্টিকস ও সার্ভিস ডেলিভারি সিস্টেম ছাড়া সেবা প্রদান ধরে রাখতে সমস্যা হবে। এশিয়ার বহু রাষ্ট্র যেমন ভারত, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কার IT 2.0 / APT 2.0, ক্লাউড মাইগ্রেশন ও অ্যাপভিত্তিক ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন, COD, OTP ভিত্তিক ডেলিভারি, রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং, ডিজিটাল পেমেন্ট ইন্টিগ্রেশনের মতো উদ্যোগসমূহ গ্রাহকের আস্থা বাড়াচ্ছে এবং প্রাইভেট কুরিয়ারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সহজ করছে।
ডাক বিভাগ একসময় মানুষের ভালোবাসা, খবর ও যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি কুরিয়ার ও ডিজিটাল যোগাযোগব্যবস্থা জনপ্রিয় হওয়ায় ডাক বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা কিছুটা কমে গেছে। তাই এখন প্রয়োজন সেবার মান, গতি ও নির্ভরযোগ্যতা ফিরিয়ে এনে সেই আস্থা পুনর্গঠন করা। ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন ‘স্টেট অব দ্য পোস্টাল সেক্টর-২০২৩’ প্রতিবেদনে বলেছে, এশিয়া ও বিশ্বজুড়ে পোস্টাল অপারেটরগুলো (দেশ) যদি আইসিটির ব্যবহার না করে তাহলে তাদের জন্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। আইসিটি ব্যবহারের এই ধারা ও ভবিষ্যৎ প্রবণতা নিয়ে বিশ্লেষণ করে তারা বলেছে, বিশ্বের পোস্টাল খাতে ডিজিটাল রূপান্তরই এখন টিকে থাকার মূল কৌশল। ঠিক এই জায়গাতেই প্রযুক্তিগত রিফরমেশন ও রিসোর্সের অভাবের কারণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ রীতিমতো লড়াই করছে।
মানুষ আসলে আমাদের কাছে কী চায়? কম খরচে সেবা চায় নাকি ন্যায্য খরচে নির্ভরযোগ্য সেবা চায়? সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মানুষ আমাদের কাছে আশা করে দ্রুত ও সময়নিষ্ঠ সেবা। মানুষ চায় তার চিঠি, পার্সেল, অর্থ বা ডকুমেন্ট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাক। দেরি বা হারিয়ে যাওয়া তাদের আস্থা নষ্ট করে। নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, সাশ্রয়ী খরচে সেবা, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও গ্রাহকসেবা এবং দায়িত্ববোধ ও সততা মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যাশা।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সাশ্রয়ী সেবা নিশ্চিত করতে আইসিটির ভূমিকাকে অগ্রাধিকার বিবেচনা করে ডিজিটাল অটোমেশনের মাধ্যমে পত্র, পার্সেল ও আর্থিক লেনদেনের প্রক্রিয়া কম্পিউটারভিত্তিক করলে সময় ও জনবল খরচ কমে, ফলে সেবা আরও সাশ্রয়ী হয়। ইলেকট্রনিক পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং, পোস্টাল ক্যাশ কার্ড ও অনলাইন বিল পেমেন্ট চালু থাকলে গ্রাহককে আর অফিসে যেতে হয় না, ফলে সময় ও যাতায়াত ব্যয় দুই-ই সাশ্রয় হয়। ডিজিটাল রুট পরিকল্পনায় আইসিটি ব্যবহার করে ডাকপিয়নের পথ নির্ধারণ করা গেলে জ্বালানি ও সময় বাঁচে, খরচও কমে। সেবা প্রদানের ধীরগতি ও পুরোনো অবকাঠামো হতে বের হয়ে আইসিটি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা ঘুচিয়ে ডাক বিভাগকে এখন আইসিটিতে শক্তিশালী হতে হবে। গ্রামীণ এলাকাগুলোতে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো দুর্বলতার উত্তরণ ঘটাতে হবে। আইসিটিকে উপেক্ষার মনোভাবের উন্নয়ন ঘটিয়ে কর্মীদের আইসিটি দক্ষতা বাড়িয়ে ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার অভ্যস্ততা তৈরি করে গ্রাহকসেবার মনোভাব বাড়াতে হবে যেন গ্রাহকের আস্থার সংকট তৈরি না হয়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বেসরকারি কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন দ্রুত, ট্র্যাকযোগ্য ও ঘরে পৌঁছে দেওয়ার সেবা দিচ্ছে, তেমনি আইসিটিবেজড সেবা দিতে হবে। আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিটি পার্সেল বা চিঠি রিয়েল-টাইমে ট্র্যাক করার ব্যবস্থা গ্রাহকের মনে নিরাপত্তা ও আস্থা তৈরি করে। এগুলোর সবকিছু অর্জনের জন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইসিটিবেজড ডাক বিভাগ এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ইতিমধ্যে ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিস (EMTS), অনলাইন ট্র্যাকিং চালু করেছে। তবে সেবার গতিশীলতা, কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও আইটি অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে পুরো দেশব্যাপী এই সুবিধা পৌঁছে যায়। সাশ্রয় ও আস্থা এই দুইয়ের মিলন ঘটাতে আইসিটির বিকল্প নেই। শক্তিশালী আইসিটি সক্ষমতা ডাক বিভাগকে শুধু আধুনিকই করবে না, এটি ‘কম খরচে বেশি সেবা’ দেওয়ার পথও খুলে দেবে। যখন সেবা দ্রুত ও স্বচ্ছ হবে, মানুষ তখন আবার ডাক বিভাগের ওপর ভরসা করবে। সুতরাং বলা যায়, প্রযুক্তি-নির্ভর ডাকব্যবস্থা মানেই সাশ্রয়ী, আধুনিক ও আস্থাশীল সেবা। এর সাথে সাথে ডাক বিভাগের প্রচার ও ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং দরকার। ডাক বিভাগের অনেক সাফল্য মানুষ জানে না। নতুন সেবা, ডিজিটাল উদ্যোগ, ই-কমার্স পার্টনারশিপ ইত্যাদি মিডিয়া ও সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে প্রচার করলে ডাক বিভাগের প্রতি জনগণের আগ্রহ বাড়বে।
ডাক বিভাগ দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও যোগাযোগের জীবন্ত প্রতীক। তবে জনগণের আস্থা ফিরে পেতে এখন প্রয়োজন দ্রুত সেবা, ডিজিটাল রূপান্তর ও ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা, কর্মদক্ষতা ও জবাবদিহি। যদি এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা হয়, তবে ডাক বিভাগ আবারও হয়ে উঠবে জনগণের নির্ভরযোগ্য, আধুনিক ও গর্বের প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব ডাক দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ডাক বিভাগ শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি মানুষের আবেগের অংশ। প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক যুগে ডাক বিভাগ যদি তথ্যপ্রযুক্তি, দক্ষতা ও সেবার মান একত্রে উন্নত করে, তবে সেটি আবারও হতে পারে জনগণের সবচেয়ে সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও প্রিয় যোগাযোগব্যবস্থা। ডাক কেবল চিঠি পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমই নয়, এটি মানুষে মানুষে সম্পর্কের সেতুবন্ধ। প্রযুক্তির এই যুগেও ডাক বিভাগের মানবিক সেবা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে। তাই বিশ্ব ডাক দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক ডাক বিভাগকে আরও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক, কার্যকর ও জনগণের আস্থার প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা।
*লেখক: মো. মনিরুজ্জামান, প্রোগ্রামার, ডাক অধিদপ্তর, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ