বাবা কখনো তাঁর স্বপ্নের কথা আমাদের বলেন না

১৬ জুন বাবা দিবসে পাঠকের পাঠানো লেখা থেকে বাছাই করা লেখা প্রকাশিত হয় নাগরিক সংবাদে।

বাবার সঙ্গে লেখক

জীবনের বেশির ভাগ অভিযোগে, আবদারে যে মানুষটির নাম উচ্চারিত হয়, তিনি ‘বাবা’। কমবেশি প্রত্যেকেই রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে, অপারগতায় বাবার দিকে আঙুল তাক করে থাকি। বাবা এটা দেননি, বাবা এটা করেননি, এই সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না ইত্যাদি। বাবার প্রতি এই যে প্রবল অধিকার বোধ, তার অতলেই কি লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা?

যখন কলেজে পড়ি, বাবাকে তখনো কঠিন অঙ্কের মতো মনে হতো। কিসে খুশি হন, দুঃখ পান, রাগ হন—বুঝতে পারতাম না। আজকের এই ২৪ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে বাবাকে খুব যে বুঝতে পারি, বুঝে ফেলেছি, তা নয়। তবে আগের মতো অতটা কঠিন মনে হয় না।

বড়দের কাছে শুনেছি, ঠাকুরদাদা মারা যাওয়ার পর স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই বাবা পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত—তিন ভাষাতেই বাবার ভালো দখল আছে। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তারপরও নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে খুব বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখেননি কেন? উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না, সব দায়িত্ব-কর্তব্য সামলে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পাননি। কাকা, জ্যাঠা, পিসি, পিসতুতো ভাই—পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে মানুষটার অপরিসীম অবদান।

বাবা পেশায় শিক্ষক। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধানের ভার তাঁর ওপর ন্যস্ত। দারুণ কর্মব্যস্ত এই মানুষকে কখনো আমার আকাশের মতো উদার মনে হয়। আবার কখনো মিতব্যয়ী, হিসাবি। তখন আমি পড়ালেখার সুবাদে যশোরে থাকি। বাবাকেও স্কুলের কাজে মাঝেমধ্যে যশোর যেতে হয়। ওই সময়ে যশোর গেলেই আমাকে ফোন করে শিক্ষা অফিসের সামনে দাঁড়াতে বলতেন। তেমন কোনো কথা নয়।

ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা করে পকেটে হাতখরচের টাকা দিয়ে দিতেন। এক দিনের কথা মনে পড়ছে, আকাশে প্রচুর মেঘ। আমার কাছে ছাতা নেই। বাবার সেদিন বোর্ডে কাজ ছিল। শিক্ষা অফিস থেকে বোর্ড অফিস প্রায় ৪৫ মিনিটের রাস্তা। বাবা জোর করে ছাতাটা আমাকে দিয়ে দেন। মায়ের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম, সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে বাবা বাড়ি গিয়েছিলেন। বাবা ছাড়া এমনটা কি আর কেউ করতে পারেন। নিজের জন্য কখনো বাবাকে ভাবতে দেখিনি। কেবল আমি, মা আর বোন নয়; আত্মীয়স্বজন সবার জন্য বাবা একইভাবে ভাবেন।

আমরা সবাই বাবাকে সমীহ করি। বাবা খুব রাগী, এমন একটা কথাও চালু আছে বাড়িতে। কিন্তু আমার এই রাগী বাবাই কেউ অসুস্থ হলে একেবারে সহজ হয়ে যান। করোনাভাইরাসের মাঝামাঝি সময়ে কাকা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও জ্বর কমে না। শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকায় মরি-বাঁচি অবস্থা হলো। বাবা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। আশ্চর্য হলাম। এই বাবাকে তো চিনি না। তুমুল সাহসী মানুষটা এত ভেঙে পড়লেন। ভাই-বোনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করে।

আমি ছোটবেলা থেকেই বাবাকে দেখে বড় হয়েছি। যেকোনো বিষয়ে তাঁর পারঙ্গমতা, দক্ষতা আমাকে মুগ্ধ করে। আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য যে একেবারে নেই, তা নয়। আছে, কিন্তু তা এতই সামান্য যে কখনো স্পষ্ট হয়ে ওঠে না।

বাবাকে কতটা ভালোবাসি? ভেবে বের করতে পারি না। আসলে যাঁদের প্রতি খুব ভালোবাসা থাকে, তাঁদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক উপলব্ধি করা যায় না। কখনো ঘটা করে ভালোবাসি বলারও প্রয়োজন পড়ে না। অভিমান শব্দটাও মানুষগুলোর ক্ষেত্রে বেশি কাজ করে। আমাদের ভাই-বোনের বাবার প্রতি অভিমান একটাই। তিনি তাঁর কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, কোনো সমস্যায় থাকলে সমস্যার কথা আমাদের বলেন না। এমনকি আমাদের নিয়ে তাঁর কোনো স্বপ্ন আছে কি না, তা-ও বলেননি কখনো। কেন বলেননি, বলেন না? যদি পূরণ করতে না পারি, মরমে মরে যাব, সে জন্য। নাকি কোনো কিছু আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান না। সে যা-ই হোক, আলাপে-ঝালাপে তাঁর একটি স্বপ্ন আমি অনুমান করে নিয়েছি। জানি না পূরণ করতে পারব কি না। পারি বা না পারি, আজীবন সেই বিন্দুতে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করব। যেন আমার জন্য কখনো তাঁর দিকে আঙুল না ওঠে। আমার জন্য হাসি না ফুটলেও চোখের জল যেন কখনো না ঝরে।

আর কথার বিস্তার না করি। কিছুদিন আগে একটা কবিতা লিখেছিলাম। সেটিও এই লেখায় সংযুক্ত করে দিচ্ছি।
বাবা, তোমাকে দেওয়ার উপর্যুক্ত কিছুই নেই আমার
মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছে হয়
একটা কবিতা লিখে তোমাকে শোনাই
কিন্তু জানো বাবা, তোমাকে ভাবতেই
আমার শব্দভান্ডার লুপ্ত হয়ে যায়, লিখতে পারি না
কেন এমন হয়, এই প্রশ্ন আমার অনেক দিনের।

আচ্ছা বাবা, তুমি এত বোকা কেন?
ইনসুলিনের জন্য রাখা টাকাটাও আমাকে পাঠাও
নিজে না চড়ে প্লেনে চড়াতে চাও
থালা থেকে বড় মাছটা তুলে দাও আমার থালায়
কোন জাদুমন্ত্রের বলে তুমি এমনটা করো বাবা?

কখনো কি আমি তোমার মতন হতে পারব
পারব, মাকে বোনকে তোমাকে পরিবারের
সকলকে
নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে?

জানো বাবা, এই পৃথিবীর কাছে আমার
আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই
কারণ আমার তো তুমি আছো;
আমার ঈশ্বর।

*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]