এখনো তোমার অপেক্ষায়

তোমার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় বন্ধু সবুজের মাধ্যমে। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। সেই সূত্রে আমার রাজশাহী শহরে প্রথম যাওয়া। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরেই গুচ্ছে সুযোগ পাই। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আদৌ সুযোগ পাব কি না, ভালো সাবজেক্ট আসবে কি না, এসব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার কোনো ইচ্ছা ছিল না, মা–বাবা আর আত্মীয়স্বজনে জোড়াজুড়িতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে যাই। সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে থাকব, এমন মনোবাসনায়। তাই কলেজের বন্ধু সবুজের মেসে সাময়িক সময়ের জন্য উঠি।

এক সপ্তাহ ক্লাস করার পরে আমার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবজেক্ট আসে। এ জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি বাতিল করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসব, বন্ধু সবুজ আমাকে একটা বই দিয়ে বলল, ‘বইটি রক্তিকে (সবুজের বান্ধুবী, একসঙ্গে টাঙ্গাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং করছে) পৌঁছে দিও।’ আমি বইটা সঙ্গে নিয়ে আছি। যখন টাঙ্গাইল এসে পৌঁছাই, তখন রক্তিকে ফোন দিই। এরপর রক্তির দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে বইটা পৌঁছে দিই। সেইবার রক্তির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আমার রক্তিকে প্রথম দেখাতেই বেশ লেগেছিল। বই পেয়ে রক্তি আমাকে ওদের বাড়িতে যাওয়া জন্য জোড়াজুড়ি করতে থাকে কিন্তু আমি তাকে কাজের তাড়া দিয়ে চলে আসি।

এর পর থেকে মাঝেমধ্যে সবুজকে মজা করে বলতাম অপরিচিতা গল্পের বিনুদার মতো, ‘তোমার বান্ধুবী দেখতে—মন্দ নহে, খাঁটি  সোনা বটে।’ সবুজ রক্তিকে বলে দেয়, আমি নাকি রক্তিকে পছন্দ করেছি, প্রেমেও পড়েছি। কিন্তু আমি রক্তিকে কখনো ম্যাসেস করিনি। শুধু সবুজের থেকে খোঁজ খবর নিয়েছি।

এর পর থেকে সবুজ রক্তির সম্পর্কে আমার কাছে মাঝেমধ্যে গুণকীর্তন করত। আমিও এমন গুণে গুণানিত একটা মেয়েকে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে সব সময় চাইতাম। সবুজ রক্তিকেও আমার সম্বন্ধে বলছে, আমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে পছন্দ না। সংসারি মেয়ে আমি চাই। যে আমাকে শুধুই ভালোবাসবে আর আমার পরিবারকে নিজের পরিবারের মতো ভীষণ ভালোবাসবে।

সবুজ আমাকে প্রায়ই বলত, দুজনে পরিচয় হয়ে নেও, কথা বলো। সবুজের এমন জোড়াজুড়িতে একদিন, আমি নিজে থেকে রক্তি ফেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাই। রক্তিও একসেপ্ট করে। কিন্তু দুজনের মধ্যে কথা তখনো শুরু হয়নি। মেসেঞ্জারে রক্তিকে মেসেজ না করে ওর পরিবার সম্পর্কে সবুজের কাছে মাঝেমধ্যে জানতে চাইতাম। রক্তি সবুজকে বলত, ‘তোমার বন্ধু আমার কাছে কেন কিছু জিজ্ঞাসা করে না, শুধু তোমাকেই বলে?’

আমি আসলে কীভাবে কথা শুরু করব, বুঝতে পারছিলাম না। এভাবেই বেশ কয়েকটা দিবস অতিবাহিত হলো। একদিন মনে সাহস রেখে ওকে মেসেঞ্জারে মেসেজ করলাম, বললাম ‘কেমন আছো রক্তি?’ ও মেসেজের রিপ্লাই দিলে ধীরে ধীরে আমরা পরস্পরকে চিনতে থাকলাম, জানতে থাকলাম। বেশ কয়েক দিন কথা বলার পর, হঠাৎ ও একদিন কথার মধ্যে বলল, ‘আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি, ঘুরেফিরিয়ে কথা বলতে পারি না। আচ্ছা তুমি কি আমাকে পছন্দ কর?’ হঠাৎ আকস্মিক ধাক্কা খেলাম, বিব্রতভাবেই রিপ্লাম দিলাম, ‘হ্যাঁ’। ও বলল, ‘তুমি তো আমাকে ভালো করে দেখাইনি, তাহলে কীভাবে প্রেমে পড়লে, ভালোবাসলে?’ আমি তখন বললাম, ‘প্রথম দেখায় তোমাকে হয়তো সামান্যই দেখছি, তবে বেশ ভালো লেগেছিল।’

বেশ কয়েক দিন কেটে গেল, কেউ কাউকে মেসেজ করিনি। একদিন হঠাৎ ও আমাকে মেসেজ করে বলল, ‘সাব্বির আমার কিছু পুরাতন ইংরেজি সাহিত্যের বই লাগবে। তুমি কি নীলক্ষেত যাও?’ তখন আমার ভার্সিটিতে ফাস্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। আমি বললাম, ‘হুম যাই। আর বই ও কিনতে পারব। আমার পরীক্ষা শেষ হলেই নীলক্ষেত গিয়ে বইগুলো কিনে আনব।’ ও বলল, ‘বেশি কষ্ট হলে থাক।’ আমি বললাম, ‘কষ্ট হবে না।’

যথারীতি পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক দিন পর ভাইভা শেষ হলো। এর পরদিন নীলক্ষেত গেলাম, পুরাতন বই না পেয়ে নতুন ইংরেজি সাহিত্যের বই কিনে নিলাম। পরদিন আমি ঢাকা থেকে বাড়িতে যাব, হঠাৎ মেসেঞ্জারে চেক করে আশ্চর্যান্বিত হলাম। আগামীকাল রক্তি নাকি ওদের গ্রামের বাড়িতে যাবে। আমি আগামীকালের ট্রেনের টিকিট  কেটে রেখেছি। তাহলে উপায়, ‘ও বলল, বইগুলো আপাতত তোমার কাছেই রেখে দিও।’ কী করব, নিরুপায় হয়ে ও যা বলল, তা–ই করলাম।

তৎপর, বন্ধু সবুজকে ফোন দিয়ে টাঙ্গাইল আসতে বলি। ঠিক করলাম, সবুজ টাঙ্গাইলে এলে সবুজকে সঙ্গে নিয়ে রক্তির সঙ্গে দেখা করে বইগুলো দেব। বন্ধু সবুজ ২৮ ডিসেম্বরে ২০২৩ সালে রাজশাহী থেকে বিকেলের ট্রেনে টাঙ্গাইলে আসবে ঠিক করল। আমি সবুজ, রক্তি আর রক্তির বান্ধুবী আতিয়াকে নিয়ে একটা আলাদা গ্রুপ খুলি।

সিদ্ধান্ত হয়, টাঙ্গাইলের ছয়আনী পুকুরপাড়ে ২৯ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সাক্ষাৎ করব। যথারীতি সবুজ ২৮ ডিসেম্বরে টাঙ্গাইলে এসে ওর কোনো এক দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের মেসে রাত ছিল। পরদিন আমি দুপুরে রক্তির জন্য কিনে আনা বইগুলো নিয়ে সবুজের সঙ্গে টাঙ্গাইলের পুরাতম বাসস্ট্যান্ডে দেখা করি। এরপর দুজনে তিনটার দিকে রিকশা নিয়ে আগেই ছয়আনী পুকুরপাড়ে এসে গল্প করতে থাকি আর অপেক্ষা করি, কখন সেই কাঙ্ক্ষিত রমণী আসবে, কখন তাকে দেখব। তৎপর আনুমানিক চারটার দিকে সেই আকাঙ্ক্ষিত রমণী আমাদের কাছে এসে হাজির। সঙ্গে আসে আতিয়া, রোকেয়া দুই বান্ধুবী।

সেইবার ওকে দ্বিতীয়বার দেখি, এসেই সবার সঙ্গে আমি পরিচিত হই। কিছুক্ষণ পুকুর পাড়ে হাঁটাহাঁটি করার পর, রোকেয়াকে অনেক ফটো তুলে দিই, কিন্তু এ মেয়েকে তা–ও খুশি করতে পারিনি। মনে মনে রাগ হচ্ছিল, এর জন্য তো এখানে আসিনি! যা–ই হোক, তারপর সবাই মিলে পুকুরপাড়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দিই। এ ফাঁকে বইগুলো আমি রক্তির হাতে তুলে দিই। রক্তি বইগুলো পেয়ে মুচকি হেঁসে ধন্যবাদ জানাল।

এরপর যথারীতি সবাই আবার আড্ডায় মনোযোগী হয়। রক্তি ওর বান্ধুবীর সঙ্গে দিব্যি কথায় মেতে ছিল, আমি শুধু নীরব দর্শক হয়ে তাকেই শুনছিলাম। পাশেই বন্ধু সবুজ বসা ছিল। সবুজও বেশ আড্ডায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছিল। আমি শুধু অতিথির মতো বসে বসে সবার কথা শুনছিলাম। রক্তির মুখে মাক্স পড়া ছিল, যেটুকু দেখতে পাচ্ছিলাম তাতেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে মগ্ন থাকতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সবার সামনে, ওমন করে তাকিয়ে থাকলে যদি ও কিছু মনে করে তাই বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারিনি।

রক্তি আমাদের আড্ডার মধ্যে নিজ দায়িত্বে কফি নিয়ে এলে, কফিগুলো প্লেটের ওপর রেখে ছবি তোলার পরে, খাওয়ার সুযোগ পেলাম। রক্তি মুখের মাক্সটি সরিয়ে নিয়ে কফি খাওয়া শুরু করলে, আমি তখন ওকে অপলক দৃষ্টিতে দেখব বলে উদ্‌গ্রীব। ও অন্য দিকে তাকিয়ে কফি খাচ্ছিল। আমি দেখলাম, ওর কেমন যেন অস্বস্তিভাব চলে এসেছে, লজ্জার সামান্য আভায় মুখটা ভারী। সে দিন আর মনের কথাটা বলা হয়নি। আড্ডায় আড্ডায় ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘুনিয়ে এল।

সবুজকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতে আসতে রাত হয়। বাড়িতে এসে দুজনে ফ্রেস হয়ে খেতে বসি। খাওয়ার পর রেস্ট নেওয়ার পর দেখলাম মেসেঞ্জার গ্রুপে সবাই আমাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছে। আমি শুধু রোকেয়াকে একা অনেক ছবি তুলে দিয়েছি। এ জন্য রক্তি, ‘আমাকে পারসোনাল ফটোগ্রাফার’ খেতাব প্রদান করে। আমি ও আমার বন্ধু এ খেতাবের তীব্র প্রতিবাদ করি। আমার বন্ধু তো বলেই ওঠে, ‘ঈর্ষা নারীদের ভূষণ।’ এভাবেই তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে গ্রুপে কথা শেষ হওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়ি।

পরদিন সবুজকে নিয়ে গ্রামের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শর্ষের খেতের সৌন্দর্য, অর্ধমৃত ধলেশ্বরী  নদী, স্কুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাই। বাল্যকালের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিই। রাতে বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার পর সবুজ সিদ্ধান্ত নেয়, সে কাল রাজশাহী চলে যাবে। আমি আর ভাইয়া সবুজের সঙ্গে রাজশাহী যাব। ভাইয়া রাজশাহী থেকে নওগাঁ যাবে একটা দরকারে আর আমি বন্ধুর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে।
সবকিছু ঠিক হওয়া পর, সবুজ আর আমি ঘুমাতে যাই। শুয়ে শুয়ে সবুজকে বললাম, ‘আমার হয়ে রক্তি প্রপোজ করো। দেখো, আমাকে ও ভালোবাসে কি না।’ সবুজ রক্তিকে সুন্দর করে বলল ঠিকই, কিন্তু রক্তি আর রাজি হলো না। অভিমানে রক্তিকে ফেসবুক থেকে আনফেন্ড করে দিই, ম্যাসেঞ্জারের সেই গ্রুপ থেকে লিভও নিই। কিন্তু আমি ভুলতে তো পারলামই না, উল্ট্রো ‘কেন আনফ্রেন্ড করলাম’ এটা নিয়ে রাতে চিন্তায় ঘুম হারাম করে ফেললাম।

শত চেষ্টায়ও ঘুমাতে পারিনি। ওকে করুন সুরে আবার ভালো লাগার কথা বলি টেক্সটে। আজান দেওয়ার কিছুক্ষণ পর উঠে ফ্রেশ হয়ে সবাই খাওয়াদাওয়া করে টাঙ্গাইল রেলস্টেশনে পৌঁছলাম আটটার মধ্যেই। কিন্তু ট্রেন প্রায় এক ঘণ্টা লেট। তিনজন ট্টেনে ৯টা ১৫ মিনিটের দিকে উঠলাম। ভাইয়ার থেকে আমি আর সবুজ সব সময় দূরে দূরে থাকি, চিন্তা করছি, কীভাবে রক্তিকে রাজি করানো যায়। রাজশাহী পৌঁছানোর পর ভাইয়া নওগাঁ চলে গেলে আমি আর সবুজ রাজশাহী রইলাম। রক্তিকে আমি হোয়াটসঅ্যাপে নক দিই। সন্ধ্যায় রক্তি রিপ্লাই দেয়। এর পর থেকে টানা চার পাঁচ দিন রক্তিকে হোয়াটসঅ্যাপে রাজি করানোর জন্য অনেক চেষ্টা করি। কোনো কাজ হয়নি। ওর একটাই উত্তর ‘আমি রিলেশনে যাব না।’ আমিও নাছোড়বান্দা, কোনোভাবেই হটছি না। বহুবার বললাম। হিতে বিপরীত।

৪ জানুয়ারি আমি রাজশাহী থেকে টাঙ্গাইল আসার সময় রক্তির জন্য একটা বই নিয়ে আসি। কিন্তু বইটা নিতে আসতে বললেও আমাকে রিজেক্ট করে দেয়। বাড়িতে এসেও তাকে রাজি করানোর অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু শেষে রক্তি হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ব্লক করে। এখন তার সঙ্গে কথা বলার জন্য মন আকুল হয়ে আছে, মনের ভেতরে কষ্ট হচ্ছে। বন্ধু সবুজ আর বান্ধবী আতিয়াকে দিয়ে রক্তিকে আমার অবস্থা বলার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। তবু এখনো আশায় আছি, হয়তো আমাকে বুঝবে, কোনো একদিন আমার ভালোবাসার মূল্য ঠিকই দেবে।

তাই কবির মতো কবিতা লিখে তাকে বলতে চাই,,
হাজারো সপ্ন এঁকেছি তোমায় নিয়ে,
হৃদয়ের গহিন বনে। সেই স্বপ্নের মায়াজালে আটকে পড়েছি। পারছি না তাই ভুলতে।
কল্পনায় রংতুলি দিয়ে আঁকি তোমাকে। দেখি আমার ছোট্ট গল্পটাতে, তুমি আছো আমারই হয়ে। জানি আমি, কল্পনার সেই গল্পটা সত্যি হবে। তুমি শুধু আমারই হবে।
তুমি ভীষণ জেদি, তাই তোমার  অবহেলার স্রোতে ভাসছি। কষ্ট হলেও আশায় আছি, অপেক্ষায় আছি, তোমার মনে জায়গা পেতে।

জানি তুমি বুঝবে, আমায় খুঁজবে, তাই যাব না দূরে। দূরে বা কাছে যেথা থাকি, সর্বে বেসে যাব ভালো। দূরে থাকলেও শুধু তোমাকেই চাইব। আমার অন্তরে তোমার জন্য রাখা ভূমি যত্নে রাখব।

*লেখক: মো. সাব্বির হোসেন, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। মেইল অ্যাড্রেস [email protected]