আমার মা
১২ মে পালিত হয় মা দিবস। পাঠকের পাঠানো লেখা থেকে বাছাই করা লেখা প্রকাশিত হচ্ছে নাগরিক সংবাদে।
কদিন আগে আমি আমার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছিলাম, শুধু আনিসুল হক কেন মাকে নিয়ে গল্প–উপন্যাস লিখবেন। আসুন, আমরাও আমাদের মাকে নিয়ে গল্প লিখি। মায়ের কথা মন দিয়ে শুনি। মায়ের ছেলেবেলার গল্প, মায়ের বড় হয়ে ওঠার গল্প, এমনকি মা হওয়ার গল্পটাও শুনি। মায়েদের সুখ–দুঃখ, আনন্দ–বেদনা, পাওয়া না–পাওয়া কত রকম সে গল্প। যেন শুনতে গেলে রাত–দিন একাকার হয়ে যায়!
সময় বের করি চলুন। মাকে নিয়ে কোথাও বসি। একটু চা বা পান খেতে খেতে মায়ের ফেলে আসা বন্ধুদের কথা শুনি। মায়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়াটাও কিন্তু চরম সৌভাগ্যের। এখন যেমন চাইলেই আব্বার সঙ্গে কথা বলতে পারি না। সময় আমাদের কাছ থেকে প্রিয়জনদের ছিনিয়ে নেয়। আমরা হারানোর পর বুঝতে পারি কী অমূল্য রতন হারালাম! আসুন, সময় থাকতে মায়েদের গল্প মন দিয়ে শুনি...
আমার অনেক বন্ধুকেই দেখি মায়ের সঙ্গে ওদের সম্পর্কটা বেশ মাখামাখি মানে অত্যন্ত খোলামেলা ও সহজ। আমার সঙ্গে আমার মায়ের সম্পর্কটাও বেশ সহজ, তবে ও রকম খোলামেলা না। আমার মা খুব স্বল্পভাষী এবং বেশ রাশভারী মানুষ। মাকে ও রকম ঘটা করে কোনো দিন বলা হয়নি, মা তোমাকে ভালোবাসি। এ রকম নাটকীয় কায়দার ভালোবাসার কথা শুনলে মা হাসবেন। কারণ, মা সব সময় জানেন, আমরা বাবার বেশি ন্যাওটা। মা তো প্রায়ই বলতেন, আমার বাবাই নাকি আমার মাথাটা নষ্ট করেছেন। আমাকে এত আদর–আহ্লাদ আর প্রশ্রয় দিয়ে। সত্যি বলতে কি মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা মা তোমাকে ভালোবাসি টাইপের না, মা তার বুদ্ধিদীপ্ত অনুভূতি দিয়ে বুঝেই নেন আমি তাকে কতটা অনুভব করি। আসলে মায়ের সঙ্গে সন্তানের ভালোবাসার কি কোনো তুলনা হয়! এ তো চিরন্তন এক মায়ার বাঁধন।
পুরো জীবনটাই তো মাকে ঘিরে। সেই ছেলেবেলা থেকে এ আজ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত মায়ের গন্ধ শরীরজুড়ে, মনজুড়ে। কোথায় নেই মা! মায়ের সঙ্গে আমার অনেক রকম গল্প হয়। কখনো ব্যক্তিগত, কখনো পারিবারিক। তবে মাঝেমধ্যে মায়ের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। মায়েরা বয়স হয়ে গেলে অনেকটা বাচ্চাদের মতো হয়ে যান। বুঝতে চান না সবকিছু। ভাবেন তাঁদের বোধ হয় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। কাজেই যে কথা এবং কাজে মা দুঃখ পান, কষ্ট পান, তা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
তবে আমি বেশ অবাধ্য-অশান্ত মেয়ে ছিলাম। ভীষণ জ্বালিয়েছি মাকে একটা বয়স পর্যন্ত। মা আমাকে কখনো বকাঝকা করেননি। হয়তো ভেতরে-ভেতরে কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু কখনো এমন কিছু বলেননি, যাতে আমি আরও বেশি বিগড়ে যাই। অসম্ভব ধৈর্য নিয়ে আমার সমস্ত অন্যায় মোকাবিলা করেছেন। এখন ভাবলে লজ্জিত হই, কী করেছি এসব!
আসলে সত্যিকারের ভালো মায়েরা বুঝি এমনই হন, ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে সন্তানদের সব ভুলভ্রান্তি ও অন্যায় ক্ষমা করে দেন। মায়েদের ভালোবাসার রং বুঝি এ রকমই হয়।
ছেলেবেলায় আমি আমার মাকে শুধু সংসারে কাজই করতে দেখেছি, কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি। মা যখন রোদে পুড়ে উঠোনে কাজ করতেন, এই যেমন ধান শুকানো, কাপড় নাড়া, ডালের বড়ি শুকানো তখন দেখতাম মায়ের মুখ থেকে যেন লাল টকটকে রক্ত বের হচ্ছে। মা শাড়ির আঁচল দিয়ে সেই ফরসা টকটকে ঘেমে যাওয়া মুখ মুছতেন আর বলতেন, ‘যাহ এখান থেকে রোদে পুড়ে যাবি।’
মাকে দেখতাম সকালে পরিষ্কার উঠোনে সেদ্ধ ধান শুকাতে দিতেন। বারান্দায় আমরা ভাইবোনেরা পাটি পেতে পড়ালেখা করতাম। মা আমাদের কিছু শুকনো খাবার যেমন নাড়ু–মুড়ি অথবা তেলেভাজা পিঠা দিয়ে যেতেন আর হাতে একটা লম্বা লাঠি মানে বাঁশের চিকন কঞ্চি ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘পড়ো আর কাক বা চড়ুই ধান খেতে এলে এই লাঠি দিয়ে তাড়িয়ো।’ এটা বলে মা রান্নাঘরে চলে যেতেন। কী সুন্দর রাঁধতেন আমার মা। ইলিশ মাছের ডিমে লবণ মাখিয়ে রাখতেন। পরের দিন মৌলভি কচুর ডগা দিয়ে লবণ মাখানো ইলিশের ডিম রান্না করতেন। আহ জিবে জল আসছে সেই অমৃত খাবারের কথা মনে হতেই।
আহ কী অপূর্ব সেই ছেলেবেলা আমার, কী অনিন্দ্য সেই মায়ের ছবি, আজও যেন হৃদয়পটে জীবন্ত ছবি হয়ে আছে।
এখন আর মা রাঁধেন না, মানে রাঁধতে পারেন না, নানা রকম রোগব্যাধিতে মা অনেকটাই নাজুক।
আমি যখন প্রথম ঢাকায় পড়ালেখা করতে আসি, তখন আমি বেশ ছোট। মা আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় কখনো কাঁদতেন না। আব্বাকে চোখ মুছতে দেখেছি। কিন্তু মা বলতেন, তুমি তো লেখাপড়া করে মানুষ হতে যাচ্ছ, এটা তো আনন্দের বিষয়, তাহলে কেঁদে কী হবে।
মা একবার আমার সঙ্গে ঢাকায় এলেন ডাক্তার দেখাতে। মাকে একটা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করলাম। রাতে মায়ের কাছে আমি আর আমার এক বান্ধবী থাকতাম। সেই রুমে আবার রান্নার ছোটখাটো একটা ব্যবস্থা ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম মা আমার আর আমার বান্ধবীর জন্য ছোট একটা পাতিলে ভাত রান্না করে রেখেছেন। মাকে রাগ করলে মা বলতেন, ‘আমি তো নামাজ পড়তে উঠেছিলাম, ভাবলাম তোমরা উঠে কী খাবে, তাই রান্না করেছি।’
এই হলেন আমার মা! মমতাজড়ানো ভীষণ আটপৌরে এক মা। মাকে কখনো লিপস্টিক মাখতে দেখিনি, কাজল দিতে দেখিনি, হাতাকাটা ব্লাউজ তো দূরের কথা মাকে কুচি করে শাড়িও পরতে দেখিনি অথচ কী অনিন্দ্যসুন্দর আর শুভ্র সাধারণ আমার মা। আমি এমন মায়েই সুখী এমন মায়েই আহ্লাদী।
মা অনবরত সংসারের কাজ করে গেছেন। আর যদি আমাদের একটু জ্বর হতো, মা সারা রাত জেগে থাকতেন, মাথায় জলপট্টি দিতেন, সাগু, আতপ চালের জাউ আরও কত কী যে রান্না করে দিতেন। সেই দিনগুলো খুব মিস করি।
অথচ মা এখন কী নিদারুণ একা। মায়ের অসুখ হলে আমরা দূর থেকে ফোনে কথা বলি, টাকা পাঠিয়ে বলি কাউকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেয়ো। একবারও কি ভাবি মা হয়তো আমাদের সান্নিধ্য চান, আমাদের স্পর্শ অনুভব করেন। সময় আর বাস্তবতা আমাদের মা-বাবার সান্নিধ্য থেকে দূরে ঠেলে দেয়।
আমাদের সেই সুন্দর মা আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। মা আমাদের জন্য চাইলেই দুম করে কোনো প্রিয় খাবার বানাতে পারেন না, মা এখন নুয়ে পড়েছেন নানান অসুখে। অনেকটাই অপারগ শারীরিক ও মানসিকভাবে।
মাকে দেখলে বিশ্বাসই হতে চায় না একটা সময় মা কী দুর্দান্তভাবে দিনভর কাজ করতেন, সবার সেবাযত্ন করতেন।
সময়ের ব্যবধানে মায়েরা একটা সময় বড্ড একা এবং অসহায় হয়ে পড়েন। কথা বলার, গল্প বলার সঙ্গী খুঁজে পান না। মায়েদের জন্য ভীষণ কষ্ট হয়।
হুমায়ুন আজাদের সেই কবিতার কথা মনে হয়…
‘আমাদের মা দিন দিন ছোট হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে’
কিন্তু না চলুন আমরা দিব্যি করে বলি, আমরা আমাদের মাকে ভয় পেতে না দিই, ছোট হতে না দিই।
আমরা আমাদের মায়েদের জন্য দুধভাতের মতো তিন বেলা ঘন হয়ে থাকি। আমাদের মায়েরা আমাদের জীবনে বনফুলের পাপড়ি হয়ে ঝরে ঝরে পড়ুক। সোনাঝরা ধানখেত হয়ে বিছিয়ে থাক আমাদের চারপাশজুড়ে।
আমাদের কর্মের গুণে মায়েদের বুক ভরে উঠুক, চোখ ভিজে যাক আনন্দের অশ্রুতে।
আসুন, সময় থাকতে আমরা আমাদের মায়েদের আগলে রাখি পরম মায়া আর মমতায়।
লেখক: রোজিনা রাখী, ফিচার লেখক
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]