সিনাকি হৈ ভাল লাগিল: প্রথম পর্ব

অলংকরণ: আরাফাত করিম

কোর্ট চত্বরে আজ বেজায় ভিড়। আলোচিত হত্যা মামলার রায়ের শুনানি হতে পারে আজ। তবে শুধুই কি তা–ই, কেন জানি আজকে ভিড়টা একটু বেশিই মনে হচ্ছে।

শ্রাবণীর আজ সকাল থেকেই মন ভালো নেই। ভেতরটা কেমন যেন অস্থির লাগছে। কি হবে শেষ পর্যন্ত। উকিলবাবু কি কেসটা জিততে পারবেন? অবশ্য আগের দিন উনি ভালোই সওয়াল-জবাব করেছেন। তারপরেও, যদি না পারেন, তাহলে কী হবে? এসব ভেবে ভেবে শ্রাবণীর মাথা খারাপ হওয়ার দশা। আদালত প্রাঙ্গণে উদ্দেশ্যহীন পায়চারি করছে আর আবোল-তাবোল ভাবছে। অথচ উকিলবাবুর দেখা নেই। এদিকে কোর্ট বসার সময় হয়ে এল।

শ্রাবণীর সাথে উকিলবাবুর আলাপটা বেশি দিনের নয়। উকিলবাবু মানে মর্তুজা আসলে শ্রাবণীর খুড়তুতো দাদা দিব্যেন্দুর বিশেষ বন্ধু। শ্রাবণীর বাবা প্রশান্ত চ্যাটার্জি একটা মিথ্যা মামলার দায়ে বর্তমানে কারাগারে। তিনি একজন ইনস্যুরেন্স এজেন্ট ছিলেন। বছর ১২ আগে দেবলীনা দত্ত নামের জনৈক এক নারীর ইনস্যুরেন্স করাতে গিয়ে উনি ফেঁসে যান। দেবলীনা দত্ত বাঙালি হলেও তাঁর স্বামীর কর্মসূত্রে তাঁরা আসামে থাকতেন। ওই দিকে প্রশান্ত বাবুও তাঁর চাকরির সুবাদে আসাম নিবাসী ছিলেন। তাঁর ওপর দেবলীনা দেবীর মিথ্যা খুনের দায় চাপানো হয়। যদিও সম্পূর্ণ পারিবারিক কলহের জেরে দেবলীনা দেবী খুন হন। কিন্তু সব দোষ গিয়ে পড়ে ঐ প্রশান্ত বাবুর ওপর। দেবলীনা দেবীর স্বামী কৌশিক দত্ত দাবী করে বসেন যে প্রশান্তর সঙ্গে দেবলীনা পরকীয়ায় লিপ্ত হন আর যা শেষকালে শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায়। যার ফলে দেবলীনা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। কৌশিক বাবু আরও বলেন, প্রশান্তই নাকি এই সত্যকে ধামচাপা দিতে দেবলীনাকে খুন করেন। আসলে এর পেছনে লুকিয়ে ছিল কৌশিকের অন্য এক চাল। সে চেয়েছিল দেবলীনার নামে করা ইনস্যুরেন্সের সব টাকা হাতাতে। শেষ পর্যন্ত কৌশিকের উকিল গলাবাজি করে ভরা আদালতে প্রমাণ করে দেন যে প্রশান্তই আসল কালপ্রিট। সেই থেকে প্রশান্ত আসামের কয়েদখানায় বন্দী। শ্রাবণী অবশ্য তখন অনেকটাই ছোট। এই শোক সইতে না পেরে তাঁর মা মারা যান। তবে এখন শ্রাবণী পড়ালেখার পাট চুকিয়ে তাঁর বাবার কেসটা আবার কোর্টে তুলেছে। এ জন্য তাঁকে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি।

‘কি খুব টেনশন হচ্ছে বুঝি?’ কণ্ঠস্বর শুনে পেছন ফিরতে শ্রাবণী দেখল উকিল বাবু দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে বাদামী ফ্রেমের চশমা আর গায়ে জড়ানো ওকালতির কালো কোট। দারুণ লাগছে তাঁকে। অবশ্য প্রথম দেখাতেই শ্রাবণীর মর্তুজাকে বেশ ভালোই লেগেছিল। সুদর্শন, দারুণ ব্যক্তিত্ব! এককথায় তাঁর কাছে এলে শ্রাবণীর কেমন যেন একটা হয়। সে যদিও সেটা বুঝতে দেয় না।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘না, ওই আরকি। একটু–আধটু। তা আপনি বুঝি সবে এলেন। আসতে এত দেরি করলেন যে বড়, পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

‘আরে না। রঘুকে বলেছিলাম, ভোরবেলা ডেকে দিতে। কিন্তু সে বেচারা নিজেই রাতভর নেশাপানি করে পাঁড় মাতাল হয়ে পড়ে আছে, আমায় কি ডাকবে। তাই জন্যে উঠতে লেট হয়ে গেল।’

রঘু এখানকার ডাকবাংলোর দেখাশোনা করে। আসামের এই ডাকবাংলোর বেশ নামডাক আছে বইকি। লোকে এখানে এলে এই বাংলোতেই ওঠে। মর্তুজাও এই ডাক বাংলোতেই উঠেছে।

মর্তুজা খালিদ। সবে ওকালতি পড়া শেষ করেছে। দু-একটা কেস সলভ করেছে বটে, তবে হাতটা এখনো সেভাবে পাকাতে পারেনি। এর মধ্যে কোথা থেকে যেন এই কেসটা হাতে এসে গেল। সপ্তাহ খানেক আগে হঠাৎ দিব্যেন্দু ফোন দিয়ে শ্রাবণীর বাবার কথা বলল। শুরুতে আমতা-আমতা করলেও পরে মর্তুজা আর না করতে পারেনি। আসলে দিব্যেন্দু আর মর্তুজা কলকাতার ল কলেজে একসঙ্গেই পড়তো। সেই থেকে চেনা–শোনা, পরে বেশ ভালো একটা বন্ধুত্ব হয় তাদের। দিব্যেন্দুই কেসটা নিতে পারত কিন্তু কি একটা কাজে তাঁকে এসময়েই উড়িষ্যা যেতে হলো। মর্তুজা কেসটা হাতে পাওয়ার পর আর দেরি করেনি। সোজা চলে এল আসাম।

‘কি ভায়া, রাতে ভালো ঘুম হয়েছে তো?’ পেছন ফিরতেই মর্তুজার চোখে পড়ল মৃণ্ময় সেন।

মৃণ্ময় সেন, অপজিশন লইয়ার। উনিও কলকাতার মানুষ। ১২ বছর আগে এই কেসে উনিই বাদীপক্ষে ছিলেন। আসলে উনি হলেন ভিক্টিম দেবলীনা দত্তর স্বামী কৌশিকের বিশেষ চেনা। লোকটা মোটেও সুবিধের নয়। মর্তুজা তাঁর সম্পর্কে জানে। মিথ্যা মামলায় গলাবাজি করে কেস বাগিয়ে নেবার কুখ্যাতি রয়েছে তাঁর।

মৃণ্ময় বাবুর মুখে কেমন যেন তাচ্ছিল্যের হাসি। কালো মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁকে চোখ দুটো রক্তলাল।

‘না, মানে আপনি এখানে নতুন কিনা তাই একটু খোঁজ-খবর নেওয়া আরকি।’ মৃণ্ময় বাবুর অহেতুক কৌতূহলে মর্তুজা কিছুটা বিব্রত।

‘এই হলো আরকি একরকম।’ মর্তুজা কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। ধাতস্থ হতে সময় লাগছে তাঁর।

‘বুঝলেন মশাই, কিচ্ছু নেই। খালিই বেগার সময় নষ্ট। আগের বার যা হয়েছিল, এবারও তা–ই হবে। জজ সাহেব খাতা খুলবেন আর লাগাবেন। কেস ডিসমিস। এর চেয়ে বরং যান বাড়ি গিয়ে ঘুমান। আসামে অনেক ঘোরার জায়গা আছে। এদিক–সেদিক ঘুরেটুরে দেখুন। আপনি তো মশাই এই লাইনে একেবারে নতুন আছেন। আগে তো তেমন কেসফেস লড়েননি। বলছিলাম, পরাজয় মেনে নেবার জন্যে প্রস্তুত তো?’

মৃণ্ময় বাবুর কথায় তাচ্ছিল্যের সুর মর্তুজা আগেই টের পেয়েছে। এবার সেটা আরও গাঢ় হল। সে অবশ্য এসবের ধার ধারল না। ‘দেখাই যাক না শেষ পর্যন্ত কি হয়। সব কিছু তো ওপরওয়ালার হাতেই।’

‘না, বলছিলাম একটা প্রবাদ আছে জানেন তো, হাতি ঘোড়া গেল তল আর মশা বলে কত জল।’ মৃণ্ময় বাবু কথাটা বলেই কুৎসিতভাবে হেসে উঠলেন।

মর্তুজা মৃণ্ময় সেনের ধাঁচটা ধরে ফেলেছে। বলল, ‘সংস্কৃতে একটা কথা আছে, পঙ্গুম লংঘায়তে গিরিম। মানে, ওপরওয়ালা চাইলে খোঁড়াও গিরি ডিঙাতে পারে। আপনি মনে হয় ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, তাই না।’

শ্রাবণী দেখল, কথার খেলা ভালোই জমে গেছে। ‘চলুন মর্তুজা, এখানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমরা বরং এগোই। কোর্ট বসল বলে।’

‘হ্যা, চলুন।’ শ্রাবণীর কথায় ইঙ্গিত আঁচ করতে পেরে মর্তুজাও আর দেরি করল না। সামনের দিকে পা বাড়াল। আচ্ছা, শ্রাবণী কি তাঁকে নাম ধরে ডাকল। ভেতরে কেমন একটা অনুভূতি হল তাঁর। চলবে...

লেখক: আসিফ আল মাহমুদ, স্নাতকোত্তর, শিক্ষার্থী

*নাগরিক সংবাদ-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]