দুজন নির্মোহ মানুষ

১৬ জুন বাবা দিবস। পাঠকের পাঠানো লেখা থেকে বাছাইকৃত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে নাগরিক সংবাদে।

গায়ক জেমসের-
‘বাবা কত দিন দেখিনি তোমায়,
বলে না কেউ তোমার মতো,
খোকা কাছে আয়’
-গানটি দিন-রাত আমাকে তাড়িত করে। ৩০ জানুয়ারি আমার বাবা আবদুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুর আগের দিন রাতেও আড়াইটা পর্যন্ত আব্বার সঙ্গে বসে কত আলাপ করেছি। পরিচিত বিভিন্ন মানুষ এবং আত্মীয়স্বজন প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে তাদের খবরাখবর জানতে চেয়েছেন।

আব্বা ২০০০ সালে এলপিআর-এ যান মহাপরিচালক (গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, তথ্য মন্ত্রণালয়) হিসেবে। আমি বাসার বাইরে কিংবা হাসপাতালে গেলেই এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর পর ফোনে খবর নিতেন; ঠিকমতো পৌঁছেছি কি না, বাসায় বাবুরা অর্থাৎ আমার ছেলেমেয়েরা কোনো দুষ্টামি করছে কি না, আমি কখন আসব? উনার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল টেলিফোন। প্রতিদিন উনার টেলিফোন ডায়েরি থেকে এক এক করে বিভিন্নজনকে ফোন করে তাদের কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। মাঝেমধ্যে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে বলতেন, ‘ও অনেক কষ্টে আছে, চুপ করে এটা পৌঁছে দিয়ো।’

হাসপাতালে আমাদের গ্রামের দুস্থ কেউ ভর্তি হলে আমাকে তাঁদের ব্যাপারে ডাক্তারদের সঙ্গে খোঁজখবর করা, অর্থনৈতিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দিতেন। প্রায় ৪০ বছর ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, হৃদ্‌যন্ত্র-এর বাইপাস অপারেশন আব্বাকে যতটুকু কাবু করেছিল, পারকিনসন রোগ তাঁকে তার চেয়েও বেশি দুর্বল করে দেয়। তারপরও উনার খাবার বাছাই করে খাওয়া এবং মনের জোরে আমরা এবং আমার সিনিয়র কয়েকজন ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক তারিফ করতেন।

আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গেলে উনি সেদিন বাসায় না আসা পর্যন্ত চুপ করে বসে থাকতেন। আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, ‘জালশুকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবাই ভালো আছে তো?’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উনার বন্ধুদের অনেকে বিভিন্ন সরকারে মন্ত্রী, এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও ওনাদের মাধ্যমে নিজে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেননি।

আমার মনে আছে, এক শুক্রবার সকালে যখন আমরা নাশতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন একটি টেলিফোন আসে। আমি রিসিভ করার পর বিপরীত দিক থেকে এটা রহমান সাহেবের বাসার নম্বর কি না, জানতে চাওয়া হয়। আমরা দুই ভাই কোন ক্লাসে, কোন স্কুলে পড়ি জানতে চেয়ে অপর প্রান্তের আঙ্কেল বলেন, ‘তোমার বাবাকে দাও।’ পরে আব্বার উচ্ছ্বাস দেখে বুঝতে পারি, নিশ্চয়ই উনার ভার্সিটি জীবনের কোন বন্ধু ফোন করেছেন। ফোন রাখার সময় আব্বা কিছুটা শক্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি সরকারি চাকরি করি; তাই সরকারি প্রসিডিউর মেনেই দরখাস্ত করেছি।’ ঘটনা হচ্ছে, আজিমপুর কলোনিতে একটা সময় ডি/ই টাইপের বাসা ছিল।

অনেক দিন ধরে বড় বাসার জন্য আব্বা চেষ্টা করছিলেন এবং দরখাস্ত দেন। একটা সময় দরখাস্তের কপি গণপূর্তমন্ত্রীর কাছে পৌঁছালে তিনি দরখাস্ত থেকে আব্বার ফোন সংগ্রহ করেন এবং আমাদের বাসায় ফোন করেন। আব্বাকে বন্ধুসুলভ ভর্ৎসনা করে বলেন, ‘আমি থাকতে তোর এত দরখাস্ত এবং সময় নষ্টের কি দরকার?

তোর আজিমপুর না গ্রিন রোডের বাসা লাগবে, আমাকে বল।’ আব্বা বলেন, ‘সিরিয়াল অনুযায়ী যখন আমার ডাক আসবে, তখনই ইউ ম্যা গিভ ইট।’ বন্ধুদের কাছে বন্ধু, কিন্তু সেই বন্ধু যদি মন্ত্রী হন, সে ক্ষেত্রে ইংরেজিতে কথা বলতেন। পরবর্তী সরকারের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী যিনি আব্বার ক্লাসমেট ছিলেন; তাঁর কাছে আমার পেস্টিংয়ের ব্যাপারে এবং আজিমপুর কলোনিতে বাসা আমার নামে ডাইভার্ট করার ব্যাপারে আমাদের কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী আব্বাকে বলে রাজি করাতে পারেননি। আজিমপুর কলোনির ভেতর একটি কমিউনিটি সেন্টারে আব্বার আরেক বন্ধুর ছেলের বিয়ের দাওয়াতে দেখলাম, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর আইন ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ও পরবর্তী সময়ে রেলমন্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুসুলভ খুনসুটি (তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী)।

সরকারি ট্রেনিংয়ে তিন মাস অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন সেই ৮২ সালে। তখন বেশ কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ান কর্মকর্তা তাঁকে সেই দেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। আব্বা এককথায় নাকচ করেন।

নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস এলেই আব্বা অস্থির হয়ে বলতেন, ‘তোমার এসিআর–এর কাগজপত্র ঠিক করেছ? ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দাও, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা দাও, ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কবে শুরু হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আশ্বস্ত করে বলতাম, আগে এফসিপিএস-এমডি দিই, আস্তেধীরে ওগুলো হবে।

একটা সময় আজিমপুর কলোনিতে আমার মেজ খালা ও আমরা থাকতাম। প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হতো। অনেক সন্ধ্যায় খালু আমাদের পড়াশোনার হালহকিকত নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। আমাদের দুই ভাই ও খালাতো ভাই-বোনদের একসঙ্গে বসিয়ে অঙ্ক, জ্যামিতি ধরতেন, বলতেন গাধাগুলো কিছু পারে না।

আব্বাকে ইন্সিস্ট করে বলতেন, ‘এই আবদুর রহমান, এদের কিছু ইংরেজি গ্রামার ধরো তো।’ আমরা আড়ালে-আবডালে ওনাদের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে বলতাম। উনারা সন্ধ্যার পর যত্ন করে আমাদের পড়া দিতেন, পড়া আদায়ের চেষ্টা করতেন। এই ‘গাধা’দের একজন এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক। আমরা এখনো মাঝে মাঝে খালাতো ভাই-বোনেরা এক হলে সেই দিনগুলোর কথা মনে করি, আর আফসোস করি স্বার্থহীন, মায়াবী মানুষগুলো কোথায় হারিয়ে গেল?

আমাদের দুই ভাইয়ের দুষ্টুমির জন্য মাঝে মাঝে পিঠে তবলার বোল পড়ত। গ্রীষ্মের ছুটি, ম্যাট্রিক পরীক্ষার ছুটি, রোজার ছুটি, বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি ইত্যাদি লং টার্ম ছুটিগুলোতে বাধ্যতামূলক দাদাবাড়ি-নানাবাড়িতে সময় কাটাতে যেতাম। গ্রামের বাড়িতে ছিল না কারেন্ট, রাতে মশার কামড়ের খুব জ্বালাতন। ওই একটাই ছিল গ্রামে থাকার নেগেটিভ পয়েন্ট। বাকি সবকিছুই পজিটিভ, পজিটিভ!

সকালে আম্মা-দাদি চা-কুকিজ বিস্কুট হাতে ধরিয়ে দাদার কাছে পৌঁছে দিতে বলতেন। দাদা ইজি চেয়ারে বসে দুই দিন আগের আব্বার পাঠানো পত্রিকা পড়তেন, আর আশপাশের বাড়ি ও গ্রামের ছাত্রদের স্কুলে যাওয়া দেখতেন আর পড়ার ব্যাপারে খোঁজ নিতেন। দাদা আবদুর রউফ সাহেব মারা যান ২০ জানুয়ারি ১৯৮৯ সালে। ষাট দশকের শেষার্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ডিরেক্টর হিসেবে অবসর নিয়ে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে চলে আসেন আজিমপুর কলোনি ও ঢাকার মায়া ত্যাগ করে।

দাদা আবদুর রউফ সাহেব ধানমন্ডিতে দেওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্লট গ্রহণ না করে শুধু এলাকার মানুষের টানে, শিক্ষা প্রসারের জন্য বিদ্যুৎহীন জালশুকার পৈতৃক বাড়িতে চলে আসেন। গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, পোস্ট অফিস প্রতিষ্ঠা করেন, আশপাশে বিভিন্ন গ্রামের স্কুলগুলোতে সহায়তা ও ধরে ধরে গরিব ঘরের শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ছেলেদের সরকারি চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

দাদা অবসরকালে শীতে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার আর বর্ষায় বড় বড় বোয়াল, আইড় মাছ ধরে শখ মেটাতেন।

আমরা বাড়িতে গেলে আম্মা প্রতিদিন দুই ভাইয়ের এক ভাইকে দাদার সঙ্গে থাকতে বলতেন। দাদা কথা কম বলতেন; বলতেন, ‘বড় হলে সায়েন্টিস্ট হবি, শামসুদ্দিন সাহেব কি এখনো তোদের স্কুলের হেডমাস্টার?’ আমরা অবাক হয়ে যেতাম, কোথায় গন্ডগ্রাম জালশুকা আর কোথায় ঢাকার আজিমপুরের তৎকালীন বিখ্যাত স্কুল ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক-এই যোগসূত্রটা কী? একদিন ঢাকায় যখন আমাদের আজিমপুর কলোনির বাসায় দাদা এলেন, তখন আব্বাকে বললেন, ‘চলো রহমান, আমার আগের বাসা দেখে আসি।’ আমরা তিন পুরুষ আজিমপুর কলোনির ৩৯ নম্বর বিল্ডিংয়ের বি নম্বর বাসায় নক করি। এই বাসায় সরকারি চাকরিকালে দাদা ছিলেন, এখান থেকেই সরকারি সফরে পৃথিবীর ২৭টি দেশ সফর করেন, আব্বা এখান থেকেই ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে যেতেন।

আব্বা ‘ইনসাফ’ কথাটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতেন ‘ভেতর পরিষ্কার।’ উনি মনের মধ্যে যে বিশ্বাসটা রাখতেন, সেটা মুখেও প্রকাশ করতেন। কোনো রকম রাখঢাক নেই। বিষয়টি নিয়ে আম্মা খুব টেনশন করতেন। আব্বা ছিলেন ব্যক্তিত্ববান ও মিতব্যয়ী। লেখাপড়ার ওপর খুব গুরুত্ব দিতেন। আমি এমডি কোর্সে ভর্তির পর বেশ কয়েকবার পরীক্ষায় খারাপ করি এবং একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বদলির কারণে পড়াশোনা শেষ করার ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। আব্বা আমাকে পাশে বসিয়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে সাহস জোগাতেন, বলতেন-এই উচ্চতর ডিগ্রিটাই হচ্ছে তোমার শক্তি; এটা দিয়ে অসহায় ও দুস্থ মানুষকে জান দিয়ে সেবা করবে। বলতেন, ‘লোভ করবে না, যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থেকো। দাদা বলতেন, ‘সৎ থাকবে, মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে।’

সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই মনের মধ্যে কী যেন নেই, কী যেন নেই ভাব। ডিসেম্বর পার হয়ে জানুয়ারিতে যখন আমার সহকর্মীরা এসিআর ফরম নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করলেন, তখন হাহাকার ওঠে মনে, কে আমাকে মনে করিয়ে দেবেন তোমার এসিআর ফরম পূরণ করো, দরকারি কাগজগুলো কে সুন্দর করে সাজিয়ে–গুছিয়ে দেবেন, কে বলবেন, আসো বাবা, কথা বলি।

  • লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ।  

নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]