আব্বুর সঙ্গে তালের আছাড়
১৬ জুন বাবা দিবসে পাঠকের পাঠানো লেখা থেকে বাছাইকৃত লেখা প্রকাশিত হয় নাগরিক সংবাদে।
বাবা মানে হাজার বিকেল আমার ছেলেবেলা। বাবাকে ঘিরে আছে নানা মজার স্মৃতি। মানুষটার শক্ত আর বড় বড় আঙুলের ফাঁকে আমার ছোট্ট হাতের আঙুলগুলো বেশ অদ্ভুত লাগত আমার। ভীষণ রকম কৌতূহলবোধ করতাম। আব্বু গোসল করতে গেলে আব্বুর সঙ্গে গোসল করতাম আর একটু পরপর হাতে সাবান লাগিয়ে আব্বুর হাতের সঙ্গে মাপ করতাম আমার হাত। আমার ভীষণ আনন্দ লাগত এমনটা করতে। আব্বুও খুব হাসত এমন কাণ্ড দেখে।
এখন বাবা দিবস পালন করা হয়। বাবারা সারা জীবন আমাদের বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে থাকে। বাবাকে ঘিরে আমাদের তৈরি হয় নানা মজার গল্প। প্রত্যেক মেয়ের কাছে তার বাবা হয় সুপার হিরো। বাবা মানেই অন্য রকম ভালোবাসা। বাবা মানেই আমার সব আবদার পুরোনো। না চাইতেই সব সমস্যার সমাধান করে দেয়। আব্বু নিজের জন্য একটা ওষুধ কিনতে গেলে কিপটেমি করলেও আমার বেলায় সেসব থেকে দানশীল হয়ে ওঠেন। যেটা আমি পারি না, সেইটা আব্বু একনিমেষেই আমার জন্য সহজ করে তোলে। আম্মু শাসন করলে আব্বুকে নালিশ না করা পর্যন্ত আমার কান্না যেন থামেই না। সবার কাছে ‘বাপ আদুরে মেয়ে’, ‘বাপের আহ্লাদী মেয়ে’, ‘পাপ্পাকি পরি’ তকমা পাওয়ার গল্প না বললাম। আব্বু ‘মা’ বলে ডাকে দেখে বড় ভাইয়াদের কাছে গিয়ে বলতাম, ‘আমাকে দাদি বলবা, দেখ নাই আব্বু আমাকে মা বলে ডাকে! আমি তোমাদের কত্ত বড় দেখেছ…কত্ত বড় ছেলে আমার।’ আর বাড়ির সবার কাছে পাকা বুড়ি খেতাব পাওয়া। আব্বুর মা বলে কোলে তুলে নেওয়া। আসলেই অন্য রকম একটা অদ্ভুত অনুভূতি।
বিকেল হলেই আব্বুর সঙ্গে বাইরে যাওয়ার বাহানা খুঁজতাম। ঠিক তেমনই এক বিকেলের কথা। আমার আব্বু আমার মেজ মামার বাসায় যাচ্ছিল। এক কাঁদি তাল নিয়ে যাচ্ছিল দেখে আমাকে সঙ্গে নিতে চাননি, বরং আমার ভাইকে নিতে চেয়েছিলেন। আমিও নাছোড়বান্দা, আমি যাব বলে জেদ ধরে রইলাম। একমাত্র মেয়ে হওয়ায় আব্বু আমার হাতে সব সময় বাধা থাকত। দাদাভাইকে না নিয়ে আমার নিয়ে গেল। আমি বোধ হয় তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। লাল একটা ফ্রক পরে আব্বুর বাইকের পেছনে চড়ে বসলাম। আর আম্মু হাতে ধরিয়ে দিল এক কাঁদি তাল। আমি তখন কোনো একটা সিনেমায় দেখেছিলাম, নায়িকা বাইকের পেছনে উল্টো করে বসে থাকে। আমিও জেদ ধরলাম, আমি উল্টো করে বসব। সবাই এত বারণ করল, আমি কথা শুনছিলাম না। বাধ্য হয়ে সেভাবেই বসিয়ে দিল আমাকে। আর আমি নিজেকে নায়িকা ভাবা শুরু করছিলাম। আহা, চুল উড়লে মনে হতো আমি অমন নায়িকার মতো। একেকজনের মতো চুল বাঁধতাম আর ভাবতাম, আমাকে তার মতো লাগছে। ভাবলেই এখন হাসি পায়। উপজেলা গেট পার হওয়ার সময় মেইন রোডে উঠতে রাস্তা একটু উঁচু ছিল। আব্বু যখন মেইন রোডে গাড়ি ওঠাল আর আমি অমনিই ধপাস করে আলুর বস্তার মতো পড়ে গেলাম তালসহ। এর নাম আমার ভাই দিল ‘তমা আব্বুর সঙ্গে তালের আছাড় খেলো’। অনেক ব্যথা পাওয়া শর্তেও আমি সেটা হজম করে নিলাম। কারণ, নিজে থেকে সেধে বাঁশ নিয়েছিলাম যে। যদি নিজে থেকে না হতো, তাহলে একটু সুচ পরিমাণ ব্যথা না পেলেও আ…. করে চিৎকার করে কাঁদা শুরু করতাম, যার জন্য আমাকে এত এত চকলেট দেওয়া লাগত আব্বুর…হিহিহিহি…
বাবা দিবস উদ্যাপনের ক্ষেত্রে দেশভেদে দেখা যায় বৈচিত্র্য। দিবসটি বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। এদিন ছেলেমেয়েরা তাদের বাবাকে কোনো না কোনো উপহার দিতে খুব পছন্দ করে। আর বাবারাও ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে গিফট পেয়ে বেশ অভিভূত হয়ে যান। এ গিফট দেওয়ার ক্ষেত্রেও দেশভেদে দেখা যায় ভিন্নতা। কোনো কোনো দেশে ছেলেমেয়েরা বাবাকে কার্ড বা ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানায়। অনেকে আবার বাবা দিবস উপলক্ষে কেক কাটার আয়োজনও করে।
অনেক সন্তানই আছে, যারা মা–বাবার দেখাশোনার প্রতি খুব একটা মনোযোগী নয়। মা দিবস বা বাবা দিবস তাদের চোখের সামনের পর্দাটি খুলে ফেলে মা–বাবার প্রতি তার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে তাই বলা যায়, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে মা দিবস বা বাবা দিবসের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
মোটকথা, আমাদের পরিবার তথা সমাজে বাবার যে গুরুত্ব, তা আলাদাভাবে তুলে ধরাই বাবা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। বাবাদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা থেকেই এ দিবস পালন হয়ে থাকে।
*লেখক: তামান্না ইসলাম, আল ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]