ফিলিপস বাল্বের বিষণ্ণ হলুদ আলো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘আমার কী ইচ্ছা করে, জানেন?’ শামীম ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে আমি বললাম, ‘এফসিপিএস পাস করতে চান।’ হা হা করে অট্টহাসি দিয়ে শামীম ভাই ট্রেনের জানালা দিয়ে দৌলতকান্দি মহিউদ্দিন ভুঁইয়া উচ্চবিদ্যালয় দেখিয়ে বললেন, ‘যদি সুযোগ পেতাম, এই স্কুলে পড়ার জন্য ভর্তি হতাম।’ আমিও তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেসে উঠি। কারণ, তিনি আমার মনের অনেক ভেতরের একটা কথা বলে ফেলেছেন। শামীম ভাই আমার সহকর্মী; শিশুবিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য পড়াশোনা করছেন। ভাবী, চাকরি সূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পোস্টেড। এ কারণে শামীম ভাই মাঝে মাঝে ট্রেনে আমার সঙ্গী হন। নরসিংদীর রায়পুরার প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই সুন্দর। দৌলতকান্দি এমবি স্কুলটি নদীর পাড়ে গাছপালাঘেরা মাঠের ওই পাশে। নদীটাকে মরা নদী বলে। আসলে এটা মেঘনাকে সাপমারায় ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে যোগ করেছে। আমরা ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার সময় এই স্কুলের পরিবেশ দেখি আর হাহুতাশ করি, কেন এ রকম একটি সুন্দর স্কুলে পড়তে পারলাম না! ছাত্ররা না জানি কত সুখী!

সুযোগ পেলেই রায়পুরার বিভিন্ন এলাকায় বিকেলে আমি হাঁটতে বের হই। যখন পা আর চলে না, তখন রিকশা নিয়ে ডরমিটরিতে ফেরত আসি। মাঝে মাঝে তুলাতলী এলাকার হাসপাতাল কমপ্লেক্স থেকে হাঁটতে হাঁটতে শ্রীরামপুর রেলগেট পার হয়ে রায়পুরা বাজারে চলে আসি। একটু নাশতা করে পুব বরাবর আরেকটু হাঁটলেই মেঘনা নদীর একটা শাখায় পৌঁছে যাই। গুদারাঘাটে দাঁড়িয়ে মনে মনে পরিকল্পনা করি কোনো একদিন নদী পার হয়ে সৈয়দাবাদের ওহেদুজ্জামান ভাইসাহেব-শাহ আলম ভাইসাহেবদের বাড়ি বেড়িয়ে নবীনগরের বাইশ মৌজা-লালপুর গ্রামে পৌঁছে যাব। লালপুর থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি জালশুকা তিন-চার মাইল।

হাসপাতালের স্টাফ আলী হোসেন মিয়া, এমএলএসএস মুজিবর মাঝেমধ্যে রায়পুরা বাজার পর্যন্ত সঙ্গী হোন। আলী হোসেন মিয়া খুবই অমায়িক একজন মানুষ। ওনার বাড়ি এই উপজেলার অন্য আরেক প্রান্তে। আমাকে মাঝেমধ্যে রায়পুরা এলাকা সম্বন্ধে টিপস দেন। গত পরশুদিন বলেন, ‘স্যার, বাদামগাছ দেখছেন? আপনে তো মেঘনার চরের কাছাকাছি যান।’ আমি ওনাকে বলি, ‘বাদাম মাটির নিচের ফল, এটা জানি, কিন্তু বাদামগাছ চিনি না।’ তাই আমাকে বাদামগাছ দেখাতে রায়পুরা বাজার পর্যন্ত ট্যাগ হয়েছেন। ‘ওই যে স্যার, আপনার পায়ের নিচে’ হোসেন মিয়া বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভয়ে লাফ দিই। ভাবলাম সাপ-টাপ নাকি! হোসেন মিয়া লতানো গাছটিকে টান দিয়ে ছোট ছোট বাদামসমেত শিকড় দেখালেন।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইপিআই–এর টিকা কর্মসূচিতে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ইউনিয়নে কার্যক্রম ঠিকমতো হচ্ছে কি না, পরিদর্শনে যাই। আমি নৌকা, ট্রলার, ট্রেন, রিকশা যখন যেটা দরকার সেই বাহনে চেপে দূরবর্তী ইউনিয়নগুলো পরিদর্শনে যাই। চব্বিশটা ইউনিয়ন নিয়ে নরসিংদীর বিশাল রায়পুরা উপজেলায় ছয়টি রেলস্টেশন। মাঝেমধ্যে টিএইচএফপিও সাহেব অ্যাম্বুলেন্সে যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করে দেন। আমার আগ্রহ দেখে স্যার অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে হাসাহাসি করেন। আমি বিশাল গাছ আর বাঁশঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাড়িগুলো দেখে অবাক হই। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ পাহাড়।

দৌলতকান্দি স্টেশন পার হতেই একটি পিচের রাস্তা ডান দিকে ভৈরব বরাবর চলে গেছে। শামীম ভাইকে ওই রাস্তা দেখিয়ে বলি, ‘একদিন এই রাস্তা ধরে আমি ভৈরবের পাশে মেঘনার পারে চলে গিয়েছিলাম।’

প্রায়ই হরতাল হতো। হরতালের সময় মাঝেমধ্যে নরসিংদী বা টঙ্গীতে ট্রেন কোনো কারণে আটকা পড়লে বিকল্প পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতাম। আলী হোসেন মিয়ার সঙ্গে কথা বলায় রায়পুরা বাজার থেকে বাঁ দিকে মৌলভীবাজার-সাপমারা রোডের কথা জানতে পারি। এক হরতালের দিনে বিসমিল্লাহ বলে রিকশা নিয়ে এ রাস্তা বরাবর এগোতে থাকি। রিকশাওয়ালা বেশ কথক। এই এলাকা সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি রেডিও বাংলাদেশের ফুটবল ধারাভাষ্যকার খোদা বক্স মৃধার মতো একটানা এলাকা সম্বন্ধে ধারাবিবরণী দিয়ে যাচ্ছেন। ‘ওই যে টিনের বড় বাড়িটা দেখতাছেন, এইটা হইলো আগের এমপি সাহেবের বাড়ি। সামনে মহিষমারা গ্রাম, তার বাদে সাপমারা গ্রাম।’ এটা শুনে আমি হেসে বলি, ‘আপনাদের এখানে খালি মারামারির ব্যাপার-স্যাপার। গ্রামের নামেও দেখি মারামারি ঢুকে পড়েছে।’ মাঝপথে বেশ কটি খালের ওপর দিয়ে উঁচু পুল পার হতে রিকশা থেকে নামতে হলো। একটি প্রাচীন মসজিদ দেখিয়ে উনি বললেন, ‘বুঝলেন ভাই, এই মজ্জিদে আমি একদিন নামাজ পড়ছিলাম।’ উনার উচ্ছ্বাস দেখে আমিও মনে মনে হাসি। এই রাস্তার শেষ মাথায় এসে আমাকে সামনের দিকে বেঁকে যাওয়া রাস্তাটি দেখিয়ে বললেন, ‘হেইদিকে আরেট্টু দূর আগাইলে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের বাড়ি। জায়গাটা সাপমারার মতিউরনগর।’

হঠাৎ করে ফাঁকা রাস্তার দিকে সামনে তাকাতেই দেখি দৌলতকান্দি রেলস্টেশন। এখান থেকে ডান দিকে অসংখ্য বিশালকায় শিমুল ফুলের গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হলো, এত সুন্দর পথে তো আগে কখনোই আসিনি। সড়কের চারপাশে ধানখেত, আকাশের নীলচে কালো ক্যানভাসের মধ্যে শিমুল-মান্দারগাছের লাল ফুল এক অন্য রকম আবহ তৈরি করেছে। সাপমারা-গৌরীপুর রোড ধরে কোহিনুর জুটমিলকে পাশে রেখে মেঘনার গৌরীপুর মিলবাজার ঘাটে পৌঁছে যাই। ইঞ্জিনের নৌকায় মেঘনা পাড়ি দিয়ে ওই পারে আশুগঞ্জে পৌঁছি।

‘চলো আজকে তোমাকে চিতই পিঠা খাওয়াব’—ফারুক ভাইয়ের গরমের দিনে এই উদ্ভট দাওয়াতে চমকে গেলাম। মাহবুবও ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে গলা মেলাল। আমি ডেন্টিস্ট আর শিশুশল্যবিদের মাথার স্ক্রু-টিস্ক্রু পড়ে গেছে কি না, জানতে চাই। দুজনেই আমাকে বগলদাবা করে তুলাতলী মোড় থেকে বেবিট্যাক্সিতে উঠাল। ওরা দুজন যাবে ঢাকা-বারৈচা থেকে। যাওয়ার পথে লোচনপুরসহ আশেপাশের খেতে শুধু সবজির বাগান। ধান চাষ খুব কম হয়। সবজিতেই সমৃদ্ধি। বারৈচা আর মরজালে পাইকারি দরে বিভিন্ন সবজি ট্রাকের পর ট্রাক লোড হয়। দুপুরে ডিউটি শেষে হাসপাতালের ডরমিটরিতে ভাত খেতে খেতে খবর পেলাম আজকের ঈশা খাঁ মেইল রেকর্ড ব্রেক করে সময়মতো ভৈরবের দিকে চলে গেছে। এখন সড়কপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। বারৈচায় ট্যাক্সি থেকে নেমে ফারুক ভাই হাতের ডান দিকে এক পিঠাওয়ালি খালার কাছে অর্ডার দিলেন চিতই পিঠার, ‘মিঞা, রিকশাওয়ালা মুটে-মজুরদের দুটি চিতই খেলেই দুপুরের লাঞ্চ হয়ে যায়। এটা গরম গরম আর সেফ।’ ঢাকা রওনা হওয়ার আগে দুজনেই পেট ভরে চিতই পিঠা-চা খেয়ে নিই।

গতদিন আলী হোসেন মিয়া রায়পুরা বাজার থেকে তুলাতলী আসার পথে পিটিআই রায়পুরার আশপাশের প্রাচীন অনেক বাড়ি দেখিয়ে বলেন, ‘এহনো লোকজন এই বাড়িতে থাকে।’ বিরাট স্তম্ভের মতো বাড়িগুলোর পলেস্তারা খসে গেছে। কালের আবর্তে কৌণিক ইটগুলো অনেকটা গোলচে শেপের হয়ে গেছে। দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির চারপাশে বিরাটকায় প্রাচীন গাছ। সন্ধ্যায় ফিলিপসের হালকা হলদে বিষণ্ন আলোর বাল্বগুলো মন খারাপ করা চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়; জীবন ক্ষণস্থায়ী—এই বাড়িগুলোর প্রতিষ্ঠাতা একদিন ছিল, এখন আর নেই।

*লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]