নির্জন পূর্ণিমা
নীলা অনেকক্ষণ ধরে আয়নার সামনে বসে আছে, নিস্তব্ধ, নির্জন। আয়নায় তার নিজের প্রতিচ্ছবি যেন এক নতুন রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে আজ। ঠোঁটে হালকা একটুখানি হাসি, কিন্তু তার ভেতরে বয়ে চলা বিষণ্নতার ছাপ আড়াল করতে পারছে না।
আজ সে প্রথমবারের মতো কপালে টিপ দিয়েছে। আজকের এই সাজটা বিশেষ, খুবই আলাদা। শাড়ি তো এর আগেও অনেকবার পরেছে, তবে আজকের শাড়িটা আলাদা। এ শাড়ি তার মায়ের—একটা শাড়ির কতটুকুই–বা দাম? তবু এই শাড়ি মায়ের একসময়কার স্বপ্নের সঙ্গে মিশে আছে। মা চেয়েছিল, বিয়ের দিন তার মেয়ে এই লাল বেনারসি শাড়িটা পরে আসবে। নীলার সেই দিনটা আসেনি, আর হয়তো আসবেও না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নীলা আজ আর পুরোনো অপমানের কথা ভাবছে না। মনের ভেতর শুধুই মায়ের মুখ। কত দিন মা নেই! মা বেঁচে থাকলে তাকে এই শাড়িতে দেখে মায়ের চোখে কেমনটা লাগত? মায়ের স্বপ্নের সেই পূর্ণতা আর পাওয়া হবে না কখনো।
নীলার কাছে ‘তুমি দেখতে খুব সুন্দর’—এই কথা শোনার অভ্যাস নেই। বরাবর শুনে এসেছে, ‘তুমি কালো হলেও দেখতে সুন্দর।’ এই কথাগুলোর তীব্র অপমান তার জীবনের সঙ্গে এতটাই মিশে গেছে যে এখন সেটা আর কষ্ট দেয় না। প্রথম প্রথম কষ্ট হতো, কিন্তু কষ্টের সেই তীব্রতাও যেন এখন নিজের ভেতরেই হারিয়ে গেছে। আজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, সেই পুরোনো অপমানগুলো নিয়ে সে ভাবছে না। আজ তার মনে পড়ছে মায়ের মুখ। মা বেঁচে থাকলে তাকে এই শাড়িতে দেখে কী যে খুশি হতো! মায়ের সেই আনন্দ–কল্পনায় তার মন ভরে উঠছে, কিন্তু বাস্তবতা তাকে একদম অন্য পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
আজ পূর্ণিমা। নীলার কাছে পূর্ণিমার রাত সব সময়ই বিশেষ ছিল। কৈশোরে নীলা স্বপ্ন দেখত, একদিন স্বামীর কোলে মাথা রেখে পূর্ণিমার চাঁদ দেখবে। সেই স্বপ্ন কতটা রূপকথার মতো লাগত তখন! বন্ধুরা হাসত আর নীলা মৃদু হাসি দিয়ে বলত, ‘একদিন আমিও এমন করব।’ কিন্তু সেই স্বপ্ন যেন কোনো দিন সত্যি হয়নি। আজ, পূর্ণিমার এই রাতে, সেই রূপকথার স্বপ্নের বদলে তার বাস্তবতা দাঁড়িয়ে আছে সামনে এক নিষ্ঠুর কঙ্কাল হয়ে।
আজ নীলা একা। সেই পূর্ণিমার চাঁদ সে দেখবে, কিন্তু কারও সঙ্গে নয়। তার জীবনে কোনো কোলাহল নেই, শুধু শূন্যতা। আকাশ আজ সুন্দর, চাঁদের আলো চারপাশে ঝরে পড়ছে, কিন্তু নীলার জীবনের শূন্যতা যেন সেই আলোকেও নিঃশেষ করে দিচ্ছে। এত সাজগোজ করার পেছনে আজ একটা কারণ আছে, এক বিশেষ প্রস্তুতি। আজকের রাতটা শেষবারের মতো সাজগোজ করার রাত।
আর কিছুক্ষণ পর ছাদে যাবে সে। সাজগোজ শেষ হতে দেরি হচ্ছে, যেন প্রতিটি মুহূর্তকে নিজের করে নিচ্ছে। আলতা দেওয়া বাকি, হাত-পায়ের আঙুলগুলো একদম নিস্তেজ লাগছে। তবু নীলা আলতা লাগাতে লাগল ধীরগতিতে, যেন কোনো তাড়াহুড়া নেই তার জীবনে, আর তেমনই যেন এই শেষ কাজটা। নীলা ধীরে ধীরে আলতা দিচ্ছে পায়ে, যেন সবশেষ আয়োজন শেষ করছে। ছাদে উঠবে সে, সেখানে অপেক্ষা করছে অন্য এক পৃথিবী। যখন ছাদে গিয়ে দাঁড়াল, আকাশের দিকে তাকাল, তখন পূর্ণিমার চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সারা আকাশে। রেলিংয়ের ওপর আলতার দাগ পড়েছে, যেন নীলার জীবনের রং মিশে যাচ্ছে সেখানে।
নীলা চোখ দিয়ে কান্না ঝরাতে চেয়েছিল, কিন্তু পারল না। কিন্তু আশ্চর্য! চোখ দিয়ে কোনো জলই গড়াল না। তার মন যেন শূন্য, চোখও শুষ্ক। মনে মনে সে ভাবল, যদি কেউ এসে বলত, ‘নীলা, না, প্লিজ!’ কেউ যদি তাকে থামাত! কিন্তু সেই পূর্ণিমার চাঁদ ছাড়া কেউ কখনো তার জন্য এগিয়ে আসেনি। জীবনের এতগুলো বছর ধরে কেউ তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
পূর্ণিমার আলোয় দাঁড়িয়ে নীলা যেন নিজের অস্তিত্বটাকে ধীরে ধীরে মুছে ফেলছে। আলোর ভেতরে হারিয়ে যাওয়া এক ছায়া। আজ তার একমাত্র সঙ্গী চাঁদ—পূর্ণিমার চাঁদ। বাকি সবকিছু যেন ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে, ঠিক যেমন করে আকাশের আলো নিঃশব্দে রাতকে ছুঁয়ে যায়।
নীলা ধীরে ধীরে ছাদের রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল, চারদিকে ছড়িয়ে থাকা পূর্ণিমার স্নিগ্ধ আলো যেন তাকে মায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। আকাশ নীরব, রাত গভীর। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন শেষবারের মতো পৃথিবীর প্রতি এক নিঃশব্দ বিদায় জানাল। বুকের গভীর থেকে উঠে আসা শূন্যতা তাকে তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরেছে, যেন পৃথিবীর সব অনুভূতি একে একে বিলীন হয়ে গেছে। আজ আর কোনো অপেক্ষা নেই, কোনো কষ্টও নেই—আছে কেবল এক তীব্র শান্তি, নিঃশেষের দিকে ধাবমান।
রেলিং ধরে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল নীলা। বাতাসের আলতো ছোঁয়া তার চুলগুলোকে একটু একটু করে উড়িয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেন পূর্ণিমার আলো তাকে এক অদ্ভুত, রহস্যময় উষ্ণতায় জড়িয়ে ধরেছে। সে চাইল, যেন এই আলো তাকে গিলে খায়, তাকে নিয়ে যায় এমন কোনো জায়গায়, যেখানে কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো বিচার নেই। সে যেন চাইল এই জীবনের সব ভার পূর্ণিমার চাঁদের কাছে দিয়ে দিতে, সেই নীরব আকাশের কাছে সব অপূর্ণতা জমা রাখতে।
নীলা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল, চাঁদের আলো তার চোখের জল ছুঁয়ে যেন একান্ত কোনো গোপন কথা ফিসফিস করে বলে গেল। জীবনের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি পরতে যে অনুচ্চারিত ব্যথা জমা ছিল, সেই ব্যথাগুলো যেন একে একে আলোর রশ্মিতে মিশে যাচ্ছে। নীলার মনে হলো, চাঁদটা যেন তার পুরোনো দিনের এক বন্ধু, যে সব দেখেছে, সব জানে, কিন্তু কখনো কিছু বলে না—শুধু নীরবে তাকিয়ে থাকে, গভীর মমতায়।
কিন্তু নীরবতা কি সব প্রশ্নের উত্তর হতে পারে? নীলা নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল। জীবনের এতগুলো বছর যে কথাগুলো জমে ছিল তার ভেতর, সেই কথা কি কেউ শুনেছে? রাতের এই গভীর নীরবতা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখলেও তার মনের ভেতর কিছু একটার তীব্র অনুরণন বেজে চলেছে। যেন এক অদেখা হাত তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অন্য কোনো জগতে, যেখানে কষ্ট আর ব্যথার কোনো মানে নেই—শুধু শান্তি, অবিনাশী শান্তি।
নীলার মনে হলো, এই রাত আর চাঁদের আলো তাকে সেই অন্য পৃথিবীর পথে ডাকছে, যেখানে প্রতিটি আত্মা একদিন পৌঁছে যায়। তবে কি সে সত্যিই চলে যাবে? নাকি এই পৃথিবীর আলোয়, এই বাতাসে, সে থেকে যাবে এক অপূর্ণ গল্পের সাক্ষী হয়ে?
বুকের গভীরে জমে থাকা কাব্যিক সেই প্রশ্নের উত্তর যেন হারিয়ে যায় পূর্ণিমার আলোতে, যেখানে নীলা আর চাঁদের নীরব সংলাপ চলতেই থাকে।
অবশেষে রেলিংয়ের ওপারে ধীরে ধীরে শরীরটা ঝুলিয়ে দিল নীলা। একটা মুহূর্তের জন্য মনে হলো, যেন আকাশ তাকে নিজের কোলে টেনে নিচ্ছে। চাঁদের আলো তার গায়ে পড়ে থাকা আলতার লাল রঙের সঙ্গে মিশে গেল। সেই পতনের মুহূর্তটা যেন সময়ের বাইরে কোথাও আটকে রইল—একটা চিরন্তন স্তব্ধতা, যেখানে সময় আর বাস্তবতার কোনো অস্তিত্ব নেই। নিচে পড়ার শব্দ হয়তো হলো, কিন্তু সেই শব্দ যেন এতটাই ক্ষীণ, যেন রাতের গভীরতায় তা কখনোই পুরোপুরি শোনা যাবে না।
নীলার আঙুলে লাগানো আলতা ছাদের রেলিংয়ে গাঢ় লাল দাগ রেখে গেল। সেই লাল রং, যেন জীবনের একমাত্র চিহ্ন, অন্ধকারের দিকে ছুড়ে দেওয়া এক শেষ সাক্ষী। কাল সকালে পুলিশ এসে সবকিছু দেখে যাবে, আর সেই লাল দাগটা নিঃশব্দেই বলে যাবে, একটা অমীমাংসিত গল্পের সমাপ্তি। নীলা জানত, তার গল্পের কোনো শেষ নেই, কোনো সমাধান নেই। যা ছিল, তা কেবল এক নীরব প্রতীক্ষা আর যা থাকল, তা কেবল চাঁদের আলোয় ম্লান হয়ে যাওয়া এক গল্প।
পূর্ণিমার চাঁদ নীরবে তাকিয়ে রইল। সেই চাঁদ, যা নীলার শৈশবে ছিল আশার প্রতীক, যা তার কৈশোরের রূপকথার সঙ্গী ছিল, আজ সেই চাঁদই যেন নির্বিকার। চাঁদ জানে না কীভাবে থামাতে হয়। চাঁদ তো কেবল নীরব দর্শক, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই পৃথিবীর সব শূন্যতা, অপূর্ণতা আর কষ্টের সাক্ষী। চাঁদ শুধু দেখে, কিছু বলে না। পূর্ণিমার আলো পড়ে থাকে আর সেই আলোয় হারিয়ে যায় জীবনের বাকি গল্পগুলো।
নীলা শেষবারের মতো নিজেকে মুছে ফেলল। চাঁদ জানে, পৃথিবী জানে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না।
যেন পৃথিবীর আলো নিভে গেছে তার জন্য, শুধুই এই ক্ষীণ চাঁদের আলোয় সে টিকে আছে। আকাশ জানে, এই মুছে যাওয়া কেবল শরীরের নয়; এ যেন এক আত্মার বিলীন হয়ে যাওয়া, এক গল্পের শেষ, যা শুরু হয়েছিল নীরবতার মধ্যে, আর শেষ হলো আরও গভীর নীরবতায়।
চাঁদ জানে, পৃথিবী জানে—সবাই জানে—তবু কেউ কিছু বলে না। জীবন তো এমনই, যেখানে একসময় সব শব্দ, সব অভিযোগ, সব চিৎকার নির্বাক হয়ে যায়। নিঃশব্দে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটা যেন চাঁদকেও নিরুত্তর করে রাখে। নীলার অন্তর্গত কষ্ট, অপূর্ণ স্বপ্নগুলো তার সঙ্গে মিলিয়ে যায়, বাতাসের মতো অদৃশ্য হয়ে যায়। পূর্ণিমার আলোয় নীলার ছায়া মিশে গেছে, যেমন করে নদীর জল মিশে যায় সাগরে—নিঃশব্দ, অব্যক্ত। কে জানে, সেই শূন্যতার মধ্যে হয়তো এক অনন্তকালের শান্তি লুকিয়ে আছে, হয়তো সব প্রশ্নের উত্তর সেখানেই।
জীবনের শেষ সুরটা ধীরে ধীরে স্তব্ধ হলো, আর নীলা মিলিয়ে গেল সেই গভীর রাতের চাঁদের তলে, যেখানে কোনো শব্দ নেই, কেবল নির্জনতার মহিমা।
*লেখক: কে এম ফারহাত স্নিগ্ধ, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, মিরপুর, ঢাকা
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]