বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন ‘স্কিলস ডেভেলপমেন্ট মন্ত্রণালয়’

বিশ্বের অনেক দেশেই আছে এমন মন্ত্রণালয়ছবি: ফ্রিপিক

অবিরাম পরিবর্তনের এই যুগে পৃথিবী আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), অটোমেশন, রোবোটিকস—এসব প্রযুক্তি কাজের ধরনই নয়; বরং কর্মজীবনের মূল কাঠামোই বদলে দিচ্ছে। আজ যে দক্ষতা আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি, কাল সেটিই হয়তো অচল হয়ে যাবে। তাই শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন এখন শুধু ব্যক্তিগত নয়, জাতীয়ভাবে টিকে থাকার প্রশ্ন। বাংলাদেশের মতো তরুণসমৃদ্ধ একটি দেশের জন্য এই বাস্তবতা যেমন বিশাল সুযোগ তৈরি করছে, তেমনি বড় একটি চ্যালেঞ্জও বয়ে আনছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়েছি, কিন্তু এখনো এক ভয়াবহ বৈপরীত্যের মুখোমুখি বেকারত্ব ও শূন্য পদের সহাবস্থান।

প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন আশায় বুক বেঁধে। কিন্তু তাঁরা যেমন চাকরি খুঁজে পেতে হিমশিম খান, তেমনি অনেক প্রতিষ্ঠান বলে, ‘যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না’। এই বৈপরীত্য আমাদের সামনে এক নির্মম সত্য তুলে ধরে, আমাদের দেশে ঘাটতি জ্ঞানের নয়, দক্ষতার। এই ঘাটতি দূর করা এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে হলে আমাদের এখনই নিতে হবে সাহসী, রূপান্তরমূলক ও কৌশলগত পদক্ষেপ। আর সেটি হলো একটি ‘দক্ষতা উন্নয়ন মন্ত্রণালয়’ (মিনিস্ট্রি অব স্কিলস ডেভেলপমেন্ট) প্রতিষ্ঠা করা।

বিভক্ত এক ব্যবস্থা

আমাদের দেশের বর্তমান স্কিল ডেভেলপমেন্ট কাঠামো এককথায় বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত ও দুর্বল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন টেকনিক্যাল অ্যান্ড মাদ্রাসা এডুকেশন ডিভিশন (টিএমইডি) থাকলেও জাতীয় পর্যায়ের স্কিল উন্নয়নের কাজ ছড়িয়ে আছে নানা মন্ত্রণালয় ও সংস্থায়, যেমন এনএসডিএ, বিটিইবি, বিএমইটি, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ইত্যাদি। প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে কাজ করছে, কিন্তু একটি অভিন্ন দিকনির্দেশনা বা সমন্বয় ছাড়াই। এই বিচ্ছিন্ন ও আলাদা প্রচেষ্টার ফল কী হচ্ছে?
• নীতি প্রণয়ন ধীরগতির,
• কাজের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে,
• সমন্বয়হীনতা বাড়ছে, এবং
• শেষ পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়ছে।
ফলাফল হলো দেশি ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারের জন্য অপ্রস্তুত এক বিশাল কর্মশক্তি। আমাদের বুঝতে হবে, স্কিল ডেভেলপমেন্ট শুধু টেকনিক্যাল শিক্ষার অংশ নয়; এটি একটি জাতীয় আন্দোলন। যেখানে সাধারণ শিক্ষা, শিল্প খাতের চাহিদা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সবকিছুকে একটি অভিন্ন ও দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির অধীন আনতে হবে। বর্তমান কাঠামো সেই সমন্বিত শক্তি বা দূরদৃষ্টি রাখে না। তাই এখনই সময়, একে নতুনভাবে গড়ে তোলার।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

কেন প্রয়োজন আলাদা ‘স্কিলস ডেভেলপমেন্ট মন্ত্রণালয়’

১️। সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন: সব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রমকে এক ছাতার নিচে এনে জাতীয় স্কিলস রোডম্যাপ তৈরি করা যাবে।
২️। ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগ: চীনের ডুয়াল ট্র্যাক সিস্টেম বা জার্মানির অ্যাপ্রেনটিসশিপ মডেলের মতো ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সরাসরি যুক্ত করা সম্ভব হবে।
৩️। ডিজিটাল ও উদীয়মান স্কিলসের প্রসার: এআই, ডেটা সায়েন্স, সাইবার সিকিউরিটি , ফ্রিল্যান্সিং, গ্রিন জবস ইত্যাদি নতুন ক্ষেত্রগুলোয় প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হবে জাতীয় স্কেলে।
৪️। আন্তর্জাতিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি: বিশ্বে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ কোটির বেশি দক্ষ কর্মীর ঘাটতি হবে। একটি শক্তিশালী স্কিলস মন্ত্রণালয় এই বাজারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারবে।
৫️। নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি: উদ্যোক্তা উন্নয়ন, হোম-বেজড কাজ ও মাইক্রো ক্রেডিটের সঙ্গে স্কিলসকে যুক্ত করলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক উদাহরণ থেকে শেখা

সিঙ্গাপুর: স্কিলস ফিউচার সিঙ্গাপুর দেশের প্রতিটি নাগরিককে জীবনব্যাপী দক্ষতা অর্জনে উৎসাহিত করে।
জার্মানি: অ্যাপ্রেনটিসশিপ মডেলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ শেখেন।
চীন: ডুয়াল এডুকেশন সিস্টেমের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও ইন্ডাস্ট্রি একসঙ্গে কাজ করে।
এই সফল উদাহরণগুলো প্রমাণ করে, দক্ষতাই উন্নয়নের নতুন সংজ্ঞা। বাংলাদেশেরও সময় এসেছে এই সফল মডেলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজস্ব স্কিলস ইকোসিস্টেম তৈরি করার।

স্কিল ইজ দ্য নিউ কারেন্সি

একটি দেশ তখনই টেকসই হয়, যখন তার জনগণ উৎপাদনশীল, সৃজনশীল ও আত্মনির্ভর হয়। একজন দক্ষ মানুষ শুধু নিজের নয়, পুরো সমাজের অর্থনৈতিক মূল্য তৈরি করে। তাই স্কিলস ডেভেলপমেন্ট মন্ত্রণালয় শুধু একটি প্রশাসনিক কাঠামো নয়, এটি হবে জাতীয় মানবসম্পদ বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু।

মূল কথা

আজকের তরুণ প্রজন্মই হবে আগামী বাংলাদেশের ইঞ্জিন বা চালিকা শক্তি। তাঁদের হাতে থাকবে স্কিল, জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তব প্রয়োগের সক্ষমতা, আর নতুন পৃথিবী গড়ার সাহস। এখন সময় এসেছে আমরা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও নীতিগতভাবে ঘোষণা দেওয়ার ‘স্কিলস ডেভেলপমেন্ট কোনো প্রকল্প নয়, এটি একটি জাতীয় অগ্রাধিকার।’ এবং স্কিলস ডেভেলপমেন্ট মন্ত্রণালয় সেই অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করবে।
লেখক: কে এম হাসান রিপন, ড্যাফোডিল গ্রুপের স্কিলস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট ইকোসিস্টেমের নির্বাহী পরিচালক।