ধানের দেশে, প্রাণের দেশে-১
ফসলে ভরা মাঠ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। আর ফসলে ভরা মাঠের পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষকের মুখ দেখতে পারা তো আমার কাছে দারুণ একটা ব্যাপার! এখন ফসলের ভরা মৌসুম। এ সময় গ্রামে যেতে পারা মানেই তো কৃষকের আনন্দ আর পরিতৃপ্ত মুখ দেখতে পারার মহা সুযোগ। আমার খুব ইচ্ছা করছিল এ সময় গ্রামে যাওয়ার, কিন্তু সুযোগ করতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত সুযোগটা এল। আমার ভাতিজি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তন্বী রহমানের বিয়ে ছিল ঈদের পরদিন। মদন উপজেলা শহরে তাদের বাসায় বিয়ের কাজ শেষ হতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। এরপর আর দেরি করলাম না, চলে গেলাম গ্রামের বাড়ি।
পরদিন ২৪ এপ্রিল, সকালে নাশতা শেষ করে ৯টায় হাওরের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে আমার ভাতিজা তিতাস (নেত্রকোনা সরকারি কলেজের প্রভাষক) ও ভাগনে মোবারক। হাওর দেখার জন্য দূরে যাওয়ার প্রয়োজন হলো না। বাড়ি থেকে বেরোলেই বেশ বড় জালিয়ার হাওর। এ হাওর আমাদের গ্রামসহ অনেক গ্রামের ভাত, মাছ, পাট আর নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুর অকৃপণ জোগানদার। বাড়ি থেকে বের হয়েই চোখ একেবারেই জুড়িয়ে গেল। যত দূর চোখ যায়, শুধু ধান আর ধান। সোনালি ধানের এমন ভান্ডার দেখে কার না ভালো লাগে। আমরা ছোটবেলায় অনেক বছর দেখেছি, খরার কারণে ধানের জমি খুব ক্ষতিগ্রস্ত হতো। অনেক সময় ধান হতোই না। সেসব বছর মানুষের কষ্টের কোনো সীমা থাকত না। এ ছাড়া সে সময় হাইব্রিড ধান ছিল না। অল্প পরিমাণে ধান হতো। কিন্তু এখন উন্নতজাতের ধানের চাষ হয়। পানি সেচেরও ভালো ব্যবস্থা আছে। আছে সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যবস্থা। ফলে ধানের ফলনও বেড়েছে কয়েক গুণ। তাই লোকসংখ্যা বাড়লেও আগের মতো খাদ্যের অভাব এখন আর নেই বললেই চলে।
অনেক দিন পর আমার চিরচেনা হাওরে গেলাম। আমার শৈশব–কৈশোর কাটানো হাওরের মধ্য দিয়ে হাঁটতে অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল। অসাধারণ লাগছিল আমার প্রিয় হাওরটিকে। এমনিতেই আমাদের দেশের মাটি খুব উর্বর, তাই একটু যত্ন নিলেই খুব ভালো ফসল পাওয়া যায়। কয়েক বছর ধরেই আমাদের প্রধান ফসল ধানের ফলন খুব ভালো হচ্ছে। এবারও তা–ই দেখলাম। পাকা ধানখেতের দিকে তাকালে মন হয় যেন সোনালি ধানের স্তূপ পড়ে আছে। এমন মন ভরানো দৃশ্য পৃথিবীর আর কোথায় পাওয়া যায়, তা আমার জানা নেই।
এবার আবহাওয়াও খুব চমৎকার। পাহাড়ি ঢল, আগাম বন্যা, শিলাবৃষ্টি প্রভৃতি কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় না থাকায় কৃষকেরা নির্বিঘ্নে ও স্বাচ্ছন্দ্যে ধান ঘরে তুলতে পারছেন। এরপরও এবার মন খারাপ হওয়ার মতো একটা বিষয়ও আছে, সেটা হলো, যেসব জমিতে ব্রি ধান ২৮–এর চাষ হয়েছে, সেগুলোর অনেক ক্ষতি হয়েছে, এমন অনেক ধানখেত আমি দেখেছি। আমার গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী দুই–তিনটি গ্রামের অনেকের সঙ্গে কথাও বলেছি, যাঁদের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁরা খুব কষ্ট পেয়েছেন। কষ্ট তো পাওয়ারই কথা। সারা বছর পরিশ্রম করে, নিজের সন্তানের মতো যত্ন আর পয়সা খরচ করে যেসব ধানগাছকে বড় করে তোলেন, সেগুলোকে যখন চোখের সামনে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখেন, তাঁরা কতটা যে কষ্ট পান, সেটা বলে বোঝানো কঠিন। আমার বাসায় আমি মাঝেমধ্যে মরিচগাছ, বেগুনগাছ ইত্যাদি রোপণ করি। এসব যদি কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মনটা খুব খারাপ হয়। আর তাই যে কৃষকের জমির অর্ধেক বা পুরো ধান (যা তাঁর পরিবারের সারা বছরের সম্বল) নষ্ট হয়ে গেছে, তাঁর কষ্টটা পুরোপুরি না বুঝলেও কিছুটা হলেও আমি বুঝি। তাই ফসলের মার খাওয়া কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে আমারও খারাপই লেগেছে।
আমরা কিছুদূর এগিয়ে দেখতে পেলাম, কয়েকজন লোক একটা জমির ধান কাটছেন। এটা তাঁদের নিজের জমি নয়। তাঁরা সবাই ছিলেন শ্রমিক। বিভিন্ন গ্রামের লোক তাঁরা। তাঁদের মধ্য থেকে তালুককানাই গ্রামের মো. হিরণ মিয়া, পাছ আলমশ্রী গ্রামের আজিম উদ্দিন ও বাউসা গ্রামের মো. বুরুজ মিয়ার সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা যে জমির ধান কাটছিলেন, সেখানকার ধানও ভালো হয়নি। ব্রি ধান ২৮-এর চাষ করা হয়েছিল এ জমিতে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, এ জমির শতকরা ৩০ ভাগ ধান নষ্ট হয়েছে। খরচ বাদ দিয়ে জমির মালিকের তেমন কোনো লাভ হবে না বলেই তাঁরা আমাকে জানিয়েছেন।
আরও কিছুদূর এগিয়ে আমাদের দেখা হলো বাউসা গ্রামের তরুণ মিয়ার সঙ্গে। তরুণ মিয়ার মনটা মনে হলো খুব খারাপ। তাঁর ৯০ শতাংশ জমির প্রায় সব ধান (ব্রি ২৮ জাতের ধান) নষ্ট হয়ে শুকিয়ে গেছে। তরুণ মিয়া জানালেন, তিনি ধান কাটবেন না। কারণ, ধান কাটার খরচ বাদ দিয়ে তাঁর কোনো লাভ তো থাকবেই না; বরং লোকসানের আশঙ্কাই বেশি।
আরও অনেক দূর হেঁটে আমরা গেলাম লাট মিয়ার টেকে (উঁচু ভিটার মতো জায়গা)। কয়েক বছরের চেষ্টায় হাওরের একেবারে মাঝখানে টেকটি গড়ে তুলেছেন আমার ফুফাতো ভাই মো. লাট মিয়া। তিনি বেশ নিচু একটি জমির মাটি কাটিয়ে পুকুর (আমাদের এলাকায় হাওরের এসব পুকুরকে পাগার বলে) খনন করে এর পাড়ে কয়েকটা গাছ (হিজল, জাম ইত্যাদি) লাগিয়েছেন, যেগুলো এখন বর্ষাকালেও ডোবে না। ক্লান্ত কৃষকেরা চৈত্র বা বৈশাখের প্রখর রোদে এই টেকে বিশ্রাম করার সুযোগ পান। এ ভিটাতেই আমাদের সঙ্গে কথা হয় বাউসা গ্রামের ২৪ কি ২৫ বছরের যুবক আহাদ মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাঁর ৭০ শতাংশ জমিতে ধান পেয়েছেন মাত্র ২০ মণ। তিনি আশা করেছিলেন ৭০ মণ ধান পাবেন। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ করলাম, তাঁর মুখে হাসিটা লেগেই আছে। ফসলের ক্ষতি তাঁর মুখের হাসিকে ম্লান করতে পারেনি। বেশ প্রাণচঞ্চল মনে হলো তাঁকে। আমার খুব ভালো লাগল। আসলে আমাদের দেশের কৃষকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই এটি। তাঁরা মার খান, আবার পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়ান। জীবনসংগ্রামে কখনো হার মানতে চান না। আমাদের অর্থনীতিকে তাঁরাই চাঙা করে রাখেন। চলবে...
*লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা
**নাগরিক সংবাদে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারবেন [email protected] এ