ইলিশের দীর্ঘ যাত্রার রহস্য: শক্তির জোগান দেয় যেভাবে

ইলিশ মাছফাইল ছবি: প্রথম আলো

আমাদের গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ইচ্ছা ছিল ইলিশের জীবনরহস্য ছোট ছোট করে কয়েকটি ভাগে সহজ বাংলায় তুলে ধরা। যেন আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে এই গবেষণার ফলাফল পৌঁছানো যায়। সেই ভাবনার অংশ হিসেবে আজ তুলে ধরব পরিযায়নের প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান ইলিশ কীভাবে নিশ্চিত করে।

আমরা সবাই জানি, ইলিশ একটি পরিযায়ী মাছ। পৃথিবীতে স্বল্পসংখ্যক মাছ খাদ্যের সন্ধানে সমুদ্রে বিচরণ করে; কিন্তু প্রজননের প্রয়োজনে নদীতে যেসব মাছ যায়, সেগুলোর মধ্যে ইলিশ অন্যতম। উজানের দিকে দীর্ঘ এই যাত্রা মোটেও সুখকর নয়। হাজার কিলোমিটারের বেশি এই যাত্রাপথে নিরবচ্ছিন্ন খাদ্য ও শক্তির জোগান পথকে করে তোলে দুর্গম। অতুলনীয় স্বাদের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত স্যামন মাছও পরিযায়ী। নদী বা স্বাদু পানির ঝিরিতে প্রবেশের পর প্রজনন–পরবর্তীকালে অধিকাংশ স্যামনই আর সমুদ্রে ফিরতে পারে না, মানে মারা যায়। আর এর বড় কারণ প্রজননকালে যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম পরিচলনায় সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। ইলিশও যেহেতু লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে নদীতে আসে, প্রজনন সম্পন্ন করে এবং সমুদ্রে ফিরে আসে; তাই ইলিশের শক্তির এই অবিরাম প্রবাহ এক গোলকধাঁধাই বটে; কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ শক্তি ইলিশ কোথা থেকে পায়, এই প্রশ্নের উত্তর এত দিন অমীমাংসিতই ছিল। ইলিশ গবেষণায় এবার আমাদের চেষ্টা ছিল এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা।

বাংলাদেশের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংহাই ওশান ইউনিভার্সিটির যৌথ উদ্যোগে এবং অধ্যাপক চেন হং লির নেতৃত্বে আমদের টিম প্রায় ৯ বছর ধরে ইলিশ গোত্রীয় মাছের জীবনরহস্য ও পরিযায়ন কৌশল নিয়ে কাজ করে আসছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ইলিশের সম্পূর্ণ জিনোম (Complete set of DNA) ও ট্রান্সক্রিপ্টম (Complete set of RNA) প্রকাশিত হয় যা ইলিশ গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে (https://doi.org/10.3390/biom15030321) । আমরা ইলিশের শক্তি সঞ্চয় ও ব্যবহারের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে অবাক করার মতো কিছু তথ্য পেয়েছি। মূলত তিনটি উপায়ে ইলিশ এই দীর্ঘ যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান নিশ্চিত করে।

১. বিশেষ ধরনের চর্বি (ফ্যাট) উৎপাদন

ইলিশ যখন নদীতে আসে, তখন তার শরীরে একধরনের বিশেষ চর্বি বা ফ্যাটের উৎপাদন বেড়ে যায়। এই ফ্যাট হলো অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড (Unsaturated fatty acid), যা সাধারণ চর্বির চেয়ে বেশি কার্যকর।

সমুদ্রের মাছেরা সাধারণত খাদ্য থেকেই এই ফ্যাটি অ্যাসিড সংগ্রহ করে; কিন্তু নদীতে থাকা অবস্থায় ইলিশকে তা নিজেই তৈরি করতে হয়। তবে ইলিশ শুধু ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি করেই ক্ষান্ত হয় না, এটি তার কার্বন শৃঙ্খলকে আরও প্রসারিত করে লং চেইন পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড (LCPUFA) তৈরি করার হার বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

প্রশ্ন হতে পারে, কেন এই বিশেষ ধরনের ফ্যাট? এর দুটি প্রধান কারণ রয়েছে—

* সাধারণ চর্বির চেয়ে LCPUFA ভাঙতে (বিটা অক্সিডেশন) বেশি সময় লাগে। এর ফলে শক্তি দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষিত থাকে।

* এক অণু LCPUFA ভেঙে ছোট চেইনযুক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি (ATP) উৎপন্ন হয়।

অর্থাৎ, LCPUFA উৎপাদন করে ইলিশ এক ঢিলে দুই পাখি মারে—শক্তিকে দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণ করে এবং একই সাথে প্রতিটি অণু থেকে অধিক পরিমাণে শক্তি সংগ্রহ করতে পারে।

২. শর্করার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার—

প্রাণিদেহে যখন খাদ্যের অভাব হয় বা যখন আমরা রোজা বা উপোস থাকি বা সুনির্দিষ্ট করে বললে, যখন শর্করার জোগান থাকে না, তখন আমাদের দেহে গ্লুকোজ উৎপাদিত হয় মূলত গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায়। আমরা অত্যন্ত আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, সমুদ্রের তুলনায় নদীতে গলুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়া অধিকতর সক্রিয়।

তার মানে দাঁড়ায় এই যে নদীতে বা প্রজননকালে হয় সে খাবার গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখে, অথবা ইলিশের উপযোগী খাদ্য নদনদীগুলোত নেই; কিন্তু পরিস্থিতি যা–ই হোক, সুদীর্ঘ এই যাত্রা যদি সম্পন্ন করতে হয়, তবে কোনোভাবেই অবশিষ্ট বা সীমিত আকারের এই গ্লুকোজের পুরোটা শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

আমরা জানি যে গ্লুকোজ যখনই ইনসুলিনের সংস্পর্শে আসে, তখন ভেঙে শক্তি উৎপাদন করে। এমতাবস্থায় আমরা দেখতে পাই, নদীতে ইলিশ তার ইনসুলিন–সম্পর্কিত একাধিক জিনের কার্যকারিতা সমুদ্রের তুলনায় অনেক কমিয়ে নিয়ে আসে। যার ফলে শরীরে গ্লুকোজ নিঃশেষ হয়ে যায় না; বরং গ্লুকোজের ভারসাম্য বজায় রাখে।

৩. প্রোটিন উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া—

সর্বশেষ আমরা লক্ষ্য করলাম, ইলিশ মাছ নদীতে অবস্থানকালীন সমুদ্রের তুলনায় লিপিড উৎপাদনের হার বাড়লেও প্রোটিন উৎপাদের হার কমিয়ে দেয়। সমস্ত EiF জিন, যেগুলো প্রোটিন সংশ্লেষণের জন্য অত্যাবশ৵কীয়, সেগুলোর কার্যকারিতা ব্যাপক মাত্রায় কমে আসে। আমরা জানি যে প্রোটিন সংশ্লেষণ এই পুরো প্রক্রিয়া শক্তির বিবেচনায় একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া এবং যেহেতু এই দীর্ঘযাত্রার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শক্তির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করা, তাই ইলিশ শক্তি সংরক্ষণের সম্ভাব্য সব উপায়ই অবলম্বন করে। প্রোটিন উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে ইলিশ সেই অতিরিক্ত শক্তিটুকু অন্য অতীব প্রয়োজনীয় কাজে লাগায়।

এ গবেষণা প্রমাণ করে, ইলিশের জীবনরহস্য আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি জটিল এবং অভিযোজনক্ষমতা সত্যিই অসাধারণ। এই জ্ঞান ইলিশসম্পদ সংরক্ষণ এবং এর প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্রগুলো আরও ভালোভাবে বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: কিশোর কুমার সরকার, সহকারী অধ্যাপক, কলেজ অব ফিশারিজ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্স সাংহাই ওশান ইউনিভার্সিটি

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]