‘নো অ্যানিমেল ওয়ার হার্মড’—বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে পশুপাখির ব্যবহার

ছবি: রয়টার্স

শুরুটা কোথায়। আমেরিকার বুনো পশ্চিমের কুখ্যাত আউট ল জেসি জেমস ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটে পালাচ্ছে। পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন ক্রমেই এগিয়ে আসছে। জেসি জেমসের ঘোড়া যেদিকে ছুটে চলেছে, সেখানে সমতল শেষ হয়ে খাড়া সত্তর ফুট নিচে নেমে গেছে খাদের অংশ। নিচে প্রবহমান নদী। কিন্তু ঘোড়াটিকে লাফ দিতে বাধ্য করা হলো। সওয়ারির ওপর বিশ্বাস থেকে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করে ঘোড়াটি লাফিয়ে পড়ল সত্তর ফুট ওপর থেকে। হয়তো ভেবেছিল নিচের পানিতে পড়ে সাঁতরে চলে যাবে নিরাপদ জায়গায়। কিন্তু ঘোড়ার ওজন তাকে আছড়ে ফেলল পানির নিচের শক্ত পাথরে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সাঁতরাতে ভুলে গিয়ে ডুবেই মারা গেল সে। পিঠে চড়া ব্যক্তিটির ক্ষতি বলতে কেবল মাথার টুপিটি হারিয়ে ফেলল সে। কিন্তু ঘোড়া হারাল তার প্রাণ। ঘটনাটি ‘জেসি জেমস’ শীর্ষক চলচ্চিত্রের প্রায় শেষ দৃশ্য। ১৯৩৯ সালে হলিউডের পরিচালক হেনরি কিং নির্মাণ করেছিলেন চলচ্চিত্রটি। সে সময় চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে ঘোড়াটির সঙ্গে এই নিষ্ঠুর আচরণ ও পরিশেষে তাকে হত্যা করা মেনে নিতে পারেননি একশ্রেণির দর্শক।

পশুপাখির অধিকার নিয়ে কাজ করা আমেরিকান হিউমেইন অ্যাসোসিয়েশন প্রতিবাদ করা শুরু করে। ফলে গঠিত হয় হিউমেইন হলিউড নামক অপর একটি সংস্থা।

হলিউডে নির্মিত কোনো চলচ্চিত্রে পশুপাখি ব্যবহার করা হলে তার সঙ্গে প্রাণিকল্যাণের সব নিয়ম অনুসরণ করা হলো কি না, তার প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিত করা গেল কি না, সেই সব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে এই সংস্থাটিই। প্রয়োজনে প্রাণিকল্যাণ নিশ্চিত করে একজন Animal Actor (অমানব প্রাণী শিল্পী) কে দিয়ে অভিনয় করানোর কাজে নির্মাতাদের সহযোগিতাও করে তারা। এবং তাদের দেওয়া সমস্ত নিয়মকানুন মেনে চলচ্চিত্রটিতে পশুপাখিকে দিয়ে অভিনয় করানো হলেই কেবল সার্টিফিকেট প্রদান করে সংস্থাটি। যার পরিপ্রেক্ষিতে একজন নির্মাতা তার চলচ্চিত্রে ডিসক্লেইমার দিতে পারেন, ‘No animals were harmed in the making of this film।’ প্রতিষ্ঠানটি হলিউড ছাড়াও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রের নির্মাণ প্রক্রিয়াতে পশুপাখির মানবিক ব্যবহারের সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে। আমেরিকান হিউমেইন অ্যাসোসিয়েশনের এ ডিসক্লেইমার সার্টিফিকেট অর্জন করতে হলে তাদের গাইডলাইন মেনে কাজ করতে হয়। তাদের প্রতিনিধিকে শুটিংয়ের সেট–এ উপস্থিত রাখতে হয়। অর্থাৎ এই ডিসক্লেইমার ইচ্ছা হলেই যে কেউ তার চলচ্চিত্রের শেষে ব্যবহার করতে পারেন না। এটি যেহেতু একটি সার্টিফিকেট, সেহেতু একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছ থেকে এটি অর্জন করতে হয়।  

১৯২৫ সাল থেকেই হলিউডের চলচ্চিত্রে প্রাণীর ব্যবহার নিয়ে নানা সমালোচনা শুরু হয়। চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় অভিনীত পশুপাখির সঙ্গে করা নানা ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। ফলে ১৯৩০ সালে আমেরিকান হিউমেইন অ্যাসোসিয়েশন নামের সংস্থাটির ক্রমাগত প্রতিবাদ ও চাপের মুখে একটি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি তদন্ত করে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। যেখানে চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা নানা ধরনের প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের প্রমাণ পাওয়া যায়। ফলে মোশন পিকচার প্রডিউসারস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটরস অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে একটি সেন্সরশিপ বোর্ড গঠিত হয়। প্রাণিকল্যাণ বা প্রাণী অধিকার বিষয়ে বেশ কিছু নীতিমালা এ সেন্সরশিপ বোর্ডের নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও আমেরিকান হিউমেইন অ্যাসোসিয়েশনের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল যে এই বোর্ড বাস্তবিক অর্থেই প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতে পারবে কি না! ১৯৩৯ সালের হেনরি কিং নির্মিত জেসি জেমস চলচ্চিত্রে খাদের ওপর থেকে ঘোড়াকে ফেলে দিয়ে হত্যা করার ঘটনায় সংস্থাটি ব্যাপক প্রতিবাদে জড়িয়ে পড়ে। চলচ্চিত্রশিল্প–সংশ্লিষ্টদের অ্যাসোসিয়েশনকে বাধ্য করে চলচ্চিত্রে পশুপাখির ব্যবহারকে সংস্থাটির সরাসরি পর্যবেক্ষণ ও প্রাণিকল্যাণের নিয়মনীতির মধ্যে আনতে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র

এ তো গেল যুক্তরাষ্ট্রের হলিউডের কথা। শুরুটা সেখানেই। এবার আসি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে পশুপাখির ব্যবহার বা তাদের দিয়ে অভিনয় করানোর বিষয়ে। বর্তমানে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে নানা ফরম্যাটে তরুণ নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। নিঃসন্দেহে তাঁদের বেশির ভাগই অত্যন্ত মেধাবী কাজ করছেন। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছেন না। আলোকচিত্রের ফ্রেম, সমগ্র সিনেমার কম্পোজিশন, ভাষাসহ যতগুলো কারিগরি ও তাত্ত্বিক মাধ্যম রয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুনশিয়ানার পরিচয় দিতে প্রত্যেকেই বদ্ধপরিকর। একই সঙ্গে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নানা রকম সামাজিক দায়বদ্ধতাও তুলে ধরছেন অনেকেই। চলচ্চিত্র যেহেতু সমাজ ও মানুষের জীবনকে ঘিরেই নির্মিত হয়, সেখানে প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ আসবেই। সহচর প্রাণী হিসেবে আসবে কুকুর-বিড়াল বা পাখি। আসবে খামারের প্রাণী যেমন মাছ, মুরগি, গরু, ছাগল ইত্যাদি। এরা সবাই আমাদের জীবনের গল্পে অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন কাহিনিকার থেকে শুরু করে নির্মাতা, যে কেউই চাইবেন তাঁর চলচ্চিত্রটি বাস্তবতার কাছাকাছি আসুক।

আবেদন তৈরি করুক দর্শকের মনে। ফলে সমকালীন চলচ্চিত্রগুলোতে পশুপাখির ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেশি দেখা যায়। সচেতনভাবে আমরা এই অমানব প্রাণীদেরও সহশিল্পী বলছি। অভিনয়শিল্পী বলছি, যা প্রশংসনীয়। কিন্তু সহশিল্পী বা অভিনয়শিল্পী হিসেবে অন্যদের মতোই কী হবে, তার সঙ্গে বোঝাপড়া? সম্ভব সেটি? নিশ্চয়ই নয়। ধরুন, যে পথকুকুরটিকে একজন নির্মাতা তাঁর চলচ্চিত্রে ব্যবহার করছেন, তিনি নিশ্চয়ই তাঁর মতামত নিয়ে তাঁকে পারিশ্রমিক দিতে পারবেন না। অথবা শুটিং সেটে অপরিচিত মানুষের ভিড়ে ভীত হয়ে থাকা কোনো প্রাণীকে অভয় দিতে পারবেন না। প্রোডাকশনের কর্মীরা এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে প্রাণীটির ভালো–মন্দ বিবেচনা করার সময় তাঁদের থাকে না। সবাই এ ক্ষেত্রে বিশেষায়িত জ্ঞানও রাখেন না।

ফলে যতই একজন অমানব প্রাণীকে শিল্পী বলা হোক, তার কনসেন্ট নেওয়া বা পুরোটাই অভিনয় এবং তার কোনো ক্ষতি কেউ করবে না, এটি বোঝানোর কোনো উপায় নেই। কুকুর বা বিড়াল বা কোনো পোষা প্রাণী হলে লাগবে তার অভিভাবকের নৈতিকভাবে সচেতন উপস্থিতি। চলচ্চিত্রে পশুপাখির ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা দরকার। একই সঙ্গে পশুপাখির প্রতি নৈতিক মূল্যবোধের জায়গাটিও সমুন্নত রাখা জরুরি।  

ধরুন, কোনো চলচ্চিত্রে শালিক পাখি দেখানো হচ্ছে। ছবিতে এ পাখি ব্যবহার নিয়ে কথা বলতে গেলে কয়েকটি বিষয়ে বলা যায়। প্রথমত, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১২ অনুযায়ী শালিক পাখি ধরা, আটক, কেনাবেচা করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের সময় পাখিটি ধরে এনেছে বা আগে করেছে। পাখিটিকে ধরে এবং আটক করে অথবা বিক্রি করে বা কিনে আনতে পারেন। আর নির্মাতাকে নিশ্চিত করতে হয় যে পাখিটিকে শুট করার সময় তাকে ভয় পাওয়ানো হয়নি, খাবার ও পানি দেওয়া হয়েছে এবং চুপচাপ বসিয়ে রাখার জন্য তার সঙ্গে কোনো নিষ্ঠুরতার পথ বেছে নেওয়া হয়নি। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করার কাজই হলিউডের হিউমেইন অ্যাসোসিয়েশন করে থাকে এবং সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রগুলো যে সতর্কতা (ডিস্ক্লেইমার) দেওয়া হয়েছিল, সেটি কারা সার্টিফাই করেছিল? নির্মাতা নিজেই যদি হয়ে থাকেন, তাহলে বিষয়টির কোনো বৈধতা থাকে না। তাহলে বাংলাদেশে কে দেবে এই সার্টিফিকেট? এখানেই আমাদের অনেক কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে।

আমাদের করণীয়

কোনো ধরনের বৈধ সার্টিফিকেশন ছাড়াই চলচ্চিত্রে পশুপাখির ব্যবহার বহু সমালোচনার প্রশ্নে ফেলবে বাংলাদেশের নির্মাতাদের। বাংলাদেশের প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯ প্রসঙ্গে তো বটেই, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রদর্শন করতে গিয়েও নানা রকম নীতিগত প্রশ্নে বিদ্ধ হতে পারে আমাদের চলচ্চিত্র। ফলে বিষয়টি আর হেলাফেলা করে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড তৈরি হচ্ছে, এটি একটি সুখের খবর। এ বোর্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তর এবং প্রাণিকল্যাণ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয় দরকার হবে। দরকার হতে পারে প্রাণিচিকিৎসকদের উপস্থিতি। প্রয়োজনে প্রাণী নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মাধ্যমে একটি বিশেষায়িত দল গঠন করা যেতে পারে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সার্টিফিকেশন বোর্ডকে এসব বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য।  

পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে আন্তরিক যোগাযোগ স্থাপন করার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাধ্যমগুলোর মধ্যে চলচ্চিত্র একটি। কাজেই বাংলাদেশের চিন্তাশীল নির্মাতা, শিল্পী ও এই শিল্পের সঙ্গে অর্থলগ্নিকারি ব্যক্তিরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো নিষ্কলুষ চলচ্চিত্র উপহার দেবে এটিই কাম্য।

*লেখক: রাকিবুল হক এমিল, স্থপতি ও প্রাণী অধিকারকর্মী