তরুণদের স্বপ্ন দেখায় নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার ক্লাব

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম কয়েকটি সেমিস্টার স্বপ্নের মতো কেটে যায়। ক্লাস, আড্ডা, গান, নতুন বন্ধু—সবকিছু মিলিয়ে এক রঙিন জগৎ। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করে। ফাইনাল ইয়ারের দরজায় কড়া নাড়তেই মনের ভেতর উঁকি দেয় সেই চিরচেনা প্রশ্ন, ‘এরপর কী?’ ভালো সিজিপিএ আছে তো? কর্পোরেট দুনিয়ার কঠিন লড়াইয়ের জন্য কি প্রস্তুত? সিভিটা কি যথেষ্ট আকর্ষণীয়? ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠিকভাবে তুলে ধরতে পারব তো? এই হাজারো প্রশ্ন যখন শিক্ষার্থীদের মনে ঘুরপাক খায়, ঠিক তখনই একবুক সাহস আর একঝাঁপি সমাধান নিয়ে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার ক্লাব’।

একদল স্বপ্নবানের হাত ধরে শুরু

গল্পের শুরুটা ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। কয়েকজন দূরদর্শী শিক্ষার্থীর হাত ধরে যাত্রা শুরু করে এই ক্লাব। তাঁদের লক্ষ্য ছিল একাডেমিক বইয়ের পাতার জগৎ আর কঠিন বাস্তবতার করপোরেট জগতের মধ্যে একটি মজবুত সেতু তৈরি করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর আগেই যেন প্রত্যেক শিক্ষার্থী নিজের শক্তি ও দুর্বলতার জায়গাগুলো চিনতে পারেন এবং সে অনুযায়ী নিজেকে শাণিয়ে নিতে পারেন। সেই লক্ষ্য নিয়েই ক্লাবটি কাজ করে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ দক্ষতা, পাবলিক স্পিকিং, প্রেজেন্টেশন স্কিল থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তির নানা বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে।

শুধু কথায় নয়, কাজেও চ্যাম্পিয়ন

ক্যারিয়ার ক্লাব কেবল সেমিনার বা ওয়ার্কশপের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং একের পর এক বড় মাপের আয়োজন করে তারা প্রমাণ করেছে, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তারা কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

কেউ হয়তো দারুণ কোনো আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে চায়, কিন্তু কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। ঠিক তাদের জন্যই ক্লাবটি আয়োজন করেছিল ‘Inter-University Innovative Idea Contest’-এর মতো প্রতিযোগিতা। ইন্টারভিউ বোর্ড নিয়ে ভয়কে জয় করতে আয়োজন করেছে ‘Let’s Crack the Interview Board’-এর একাধিক মৌসুম। যারা কথা দিয়ে মঞ্চ মাতাতে চায়, তাদের জন্য ছিল বিভাগীয় পর্যায়ের পাবলিক স্পিকিং প্রতিযোগিতা ‘Voice of JKKNIU 2023’। আর যারা প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে নিজের ধারণা তুলে ধরতে পারদর্শী, তাদের জন্য ছিল ‘Presentation Battle 2022’।

তবে ক্লাবের সবচেয়ে বড় চমক ছিল জাতীয় পর্যায়ের বিজনেস কেস প্রতিযোগিতা ‘CaseSprint 2025’। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মেধাবী প্রতিযোগীদের সাথে লড়াই করে নিজেদের সেরা প্রমাণ করার এই সুযোগে পুরস্কারের অর্থমূল্যও ছিল বিশাল, পুরো ১ লাখ ১০ হাজার টাকা! এর মাধ্যমে জাককানইবি শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্যাম্পাসে বসেই পেয়েছে দেশসেরা মেধাবীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার অভিজ্ঞতা।

আর যাঁরা পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁদের জন্য ক্লাবটি ২০১৯ এবং ২০২৩ সালে আয়োজন করে দুটি সফল ‘Job Fair’। এর মাধ্যমে দেশের নামকরা সব কোম্পানিকে তাঁরা নিয়ে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায়।

দক্ষতা উন্নয়নে ‘টেক স্কুল’

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিগত দক্ষতা ছাড়া চলা প্রায় অসম্ভব। তাই তো ক্লাবটি চালু করেছে ‘Tech School Program’। গ্রাফিকস ডিজাইন, মাইক্রোসফট অফিসের খুঁটিনাটি, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ভিডিও এডিটিংয়ের মতো প্রয়োজনীয় সব কোর্স রয়েছে এখানে, যা শিক্ষার্থীদের চাকরির বাজারে এক ধাপ এগিয়ে রাখে।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ভবিষ্যতের জন্য নতুন রোডম্যাপ

ক্লাবের বর্তমান সভাপতি আবুল আবছার বাপ্পি স্বপ্ন দেখেন আরও বড় পরিসরে কাজ করার। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা ক্যারিয়ার ক্লাবকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি “ওয়ান-স্টপ ক্যারিয়ার সাপোর্ট সেন্টার”-এ পরিণত করতে চাই। আমাদের মূল লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতা, ইন্ডাস্ট্রির সাথে দীর্ঘমেয়াদি নেটওয়ার্ক, মেন্টরশিপ ও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের সুযোগ নিশ্চিত করা।’

এই স্বপ্নকে সত্যি করতে তিনি ও তাঁর দল কিছু দারুণ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:

মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সফল শিক্ষার্থীদের (অ্যালামনাই) সাথে বর্তমান শিক্ষার্থীদের সরাসরি যোগাযোগের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হবে। এর মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষার্থী একজন মেন্টরের অধীনে থেকে নিজের ক্যারিয়ারের পথ তৈরি করার সুযোগ পাবে।

বৃহৎ ক্যারিয়ার ফেস্টিভ্যাল: প্রতিবছর একটি বড় আকারের ক্যারিয়ার ফেস্টিভ্যাল বা এক্সপো আয়োজন করা হবে, যেখানে দেশের সেরা করপোরেট ব্যক্তিত্বরা আসবেন, ওয়ার্কশপ হবে এবং শিক্ষার্থীরা নেটওয়ার্কিংয়ের বিশাল সুযোগ পাবে।

শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারত্ব: বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা হবে, যেন শিক্ষার্থীরা সহজেই ইন্টার্নশিপ ও চাকরির সুযোগ পায়।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার ক্লাব এখন আর শুধু সংগঠনই নয়, বরং একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। যে আন্দোলন শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছে, কীভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়, কীভাবে সেই স্বপ্নের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়, আর কীভাবে সব ভয়কে জয় করে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে হয়, ‘হ্যাঁ, আমি পারব!’

*লেখক: অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়