কালি–তুলিতে রাস্তার সংস্কৃতি
রাজধানীর আফতাবনগরের জহুরুল ইসলাম সিটির তোরণ। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শুরুটাও এখানে। বাঁদিকে লম্বা লাল দালানের সারি। সাধারণত ফরাসউদ্দিন ভবন ঘেঁষে আমি এই এলাকায় প্রবেশ করি। কিন্তু ব্যত্যয় ঘটল আজ। আমার নজর কেড়ে নিল রাস্তার বিপরীত দিকের দেয়ালটি। এখানে তারা লিখে যাচ্ছে নির্বাচিত কথাগুলো।
আমার গলায় একটি ব্যাগ ঝোলে। দাঁড়াই ওদের কাছাকাছি।
ওরা লিখে যাচ্ছে। ‘শোনো মহাজন, আমি নইতো একজন... আমরা অনেক জন।’
তারা একদল নয়। দুই–তিন ভাগে রাস্তার দেয়ালে এঁকে যাচ্ছে দ্রোহের পদ্য।
ওরা আমাকে স্বাগত জানায়। হ্যাঁ, শোনার বুঝি গল্প আছে অনেক।
আফরিদা তাসনিন এশা। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। তার কাছেই জানতে পারলাম, এই উদ্যোগ ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির। এ জন্য আহ্বান করা হয়েছে সংলগ্ন কলেজগুলোকে। আমার কনিষ্ঠ কন্যাও পড়ে এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। হন্তদন্ত হয়ে উঠল তাকে জানতে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রথম বর্ষে। শোনামাত্র আগ্রহ দেখাল ও আমাদের সঙ্গে থাকবে।... নিশ্চয়ই। ওদের সঙ্গে ‘তুমি’ বা ‘তোমরা’ সম্বোধন পাকা হয়ে গেল।
এশা থাকে আপুর বাসায়। ওই সময় আসতে দেওয়া হয়নি তাকে। বলল, দ্রোহের জুলাই গেল সমান্তরালে রেখে। রক্ত ঝরল। আবু সাঈদ বীরের মতো জীবন দিলেন। মুগ্ধ আত্মত্যাগের মহিমা দেখালেন। এভাবে চলল। ...আমরা হয়ে রইলাম ঋণী।
তারপর শুরুটা? তারই আদরে সিক্ত প্রথম বর্ষের নোশিন। হঠাৎ করেই ও বলল, ‘আমরা তো কিছু একটা করতে পারি আপু!’ ভাবাল তাকে। এরই মধ্যে এশা উল্লেখ করল আরও দুজনের নাম। এর একজন রিয়াসাত মাহমুদ। পাস করে গেলেও অনুপ্রেরণা তার। অন্যজন চতুর্থ বর্ষের আকিব আফসার। তারাও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের, বুঝলাম। তারপরই ওরা কোমর বেঁধে নামল।
সংঘাত আর সহিংসতার পটভূমিতে প্রকাশের হাতিয়ার এই রাস্তার লিখন। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মানুষের পক্ষে আওয়াজ তোলা। এ বেলায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। শিল্পী এস এম সুলতান তাঁর কর্মে হাজির করেন কর্মীর সবল আর স্বাস্থ্যবান হাত। এরাও দেখাচ্ছে গোটা গোটা অক্ষর। লিখে যাচ্ছে, ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট।’
প্রতিবাদে ফেটে পড়ার আর্তি। এশাদের এই যেসব কাজ, এর পরিকল্পনা নিয়েছে যৌথভাবে। সে দ্বিতীয় বর্ষের রাতুলকে নিয়ে বিষয়বস্তু নির্বাচনে বসেছে আলাদা সময়ে। পাশের দলটি এসেছে ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে। দ্বাদশ বর্ষের শিক্ষার্থী ওরা। মৌ আর শোভন তখন তুলির আঁচড় দিয়ে যাচ্ছে। আরেক দলে আবুজর গিফারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। হাবিবা পুরোভাগে। ওরাও দ্বাদশ বর্ষের। ইচ্ছা করছে আঁকতে, বলল সুপ্রভা। সতীর্থ ওরা কালি মেশাচ্ছে। নুসরাত জাহান, অপি—অন্তরঙ্গ ছোঁয়া তাদের। রক্তের ঋণ বলে কথা!
সারা দেশের চিত্র এটি এখন। প্রজন্ম নেমে পড়েছে রাস্তায় শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে। তারা পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর দিয়েছে। বর্ণাঢ্য করে তুলছে পরিবেশকে। তারই আরেক অংশ দেয়াল লিখনে। মারিয়া, আবদুল্লাহ আল নোমান এতক্ষণ নীরব ছিল। ওরা নড়েচড়ে উঠল। কারণ, কাজ এখনো বাকি।
গতকাল ছিলাম আফতাবনগরের ভেতর পথে দুই নম্বর রোডে। সেখানেও কাজ করছে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তকিউদ্দীন আহমেদ চয়ন ও রুমাইয়া হোসেন কথা। ইম্পেরিয়াল কলেজের প্রাচীর ধরে তারই গায়ে তারা দেয়ালচিত্র আঁকছে। সমাজের ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে সবাইকে একই সমতলে আনার জন্য তারা চালিয়ে যাচ্ছে সর্বাত্মক চেষ্টা। যোগাযোগ, সংলাপ—একইভাবে বিভাজন মোকাবিলায় দেয়ালচিত্র হতে পারে কার্যকর হাতিয়ার। অন্তত ফারদিন অমিও এমনটাই বলতে চাইল।
আবির, মফিজ রহমান রিমু থেমে নেই। তুলিতে টান দিচ্ছে। দেয়ালে দেখাচ্ছে একা নয়, শত শত মানুষের সমাহার। নাকি হাজারো! ছাত্র–জনতার সন্নিবেশ মনে হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে দেখছে দূরের কোনো নির্মাণ। বুঝি, যেতে হবে বহুদূর!
শোভন বাদ পড়ে যাবে বলে দৌড়ে আসে। ও হ্যাঁ, ওরা এসেছে মাহবুবুর রহমান মোল্যা কলেজ থেকে। নিজের জায়গাটিকে পাকাপোক্ত করতে মুঠোফোনটা সামনে আনে। দেখায়, ওদের ইনস্টিটিউটের শহীদ জিহাদ হাসানের ছবি। আমি ওর গায়ে হাত বোলাই।
শিল্পীর ভাবমূর্তি সাধারণত কোমল প্রকৃতির। তবে দেয়ালচিত্রের শিল্পীরা মনে হয় জলদস্যুদের মতো একটু বেশি। তারা তাদের ভূখণ্ড রক্ষা করে। যে জায়গা তারা ছবি আঁকার জন্য চুরি করে, তারা তা প্রবলভাবে রক্ষা করে। এশা কিংবা কথারা বোধ হয় ওই জাতেরই। রাস্তার সংস্কৃতি রক্ষায় ওদের প্রস্তুতি দেখে তা–ই মনে হলো।
*নিমাই সরকার: প্রকৌশলী
*নাগরিক সংবাদে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]